মুর্শিদাবাদের সহিংসতা এবং ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫: একটি গভীর বিশ্লেষণ
ভূমিকা
অত্র এপ্রিল মাসে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি, শামসেরগঞ্জ এবং ধুলিয়ান ব্লকে ওকাল (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সহিংসতায় রূপ নেয়, যা ৮ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে। ৮ এপ্রিল, জঙ্গিপুরে প্রতিবাদের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে অশান্তি শুরু হয়, যা সুতি ও শামসেরগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। ১১ এপ্রিল, পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় যখন সুতি, শামসেরগঞ্জ এবং ধুলিয়ানে প্রতিবাদকারীরা জাতীয় সড়ক ১২ উমরপুরে অবরোধ করে, রেল সম্পত্তি ভাঙচুর করে এবং শামসেরগঞ্জের ঘোষপাড়া বাজারে দোকান ও বাড়িঘরে হামলা চালায়। সুতি ও শামসেরগঞ্জে রেলপথে বিক্ষোভকারীদের ধরনার ফলে রেল যোগাযোগ ব্যাহত হয়। ১২ এপ্রিল, সহিংসতা চরমে পৌঁছায়, বিশেষ করে ধুলিয়ান ও শামসেরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের মাধ্যমে। এই দিন তিনজনের মৃত্যু হয়: ধুলিয়ানের জাফরাবাদে হরগোবিন্দ দাস ও তার ছেলে চন্দন দাস জনতার হাতে নিহত হন, এবং সুতিতে পুলিশের গুলিতে আহত ইজাজ আহমেদ শেখ (১৭) মারা যান। এই সময়ে জনতা আগুনজনি, লুটপাট এবং সম্পত্তি ধ্বংসের মতো কার্যকলাপে জড়িত হয়। ১২ এপ্রিলের পর এই তিনটি ব্লকে আর কোনো উল্লেখযোগ্য সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি, তবে পুলিশ গ্রেপ্তার ও তদন্ত অব্যাহত রাখে। এই ঘটনাগুলি মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং ওকাল আইন নিয়ে চলমান বিতর্ককে আরও জটিল করেছে।
এই আন্দোলন নিছক একটি আইন-বিরোধী প্রতিক্রিয়া নয় — বরং এটি বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসা ধর্মীয় এবং সামাজিক অধিকারের প্রতিরক্ষায় একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। ওয়াকফ বোর্ড মুসলিমদের একান্ত ধর্মীয় ও জনকল্যাণমুখী সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান। এই সম্পত্তিগুলি মসজিদ, কবরস্থান, মাদ্রাসা কিংবা দরিদ্র মুসলমানদের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। নতুন সংশোধনের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিমদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা, দানকারীকে কঠিন শর্তে বাঁধা, এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেওয়ার ফলে মুসলমানদের মধ্যে এটি তাদের নিজস্ব ধর্মীয় স্থাপত্যের উপর সরকারের অনুপ্রবেশ হিসেবে ধরা পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটেই ধুলিয়ান, সামসেরগঞ্জ এবং সুঁটি-১ ব্লকে প্রতিবাদের সূচনা হয়। যদিও কিছু স্থানে এই প্রতিবাদ সহিংসতার রূপ নেয়, তবে তা মূলত হতাশা, বঞ্চনা ও গভীর অবিশ্বাস থেকে উদ্ভূত। দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম সমাজের একটি বড় অংশ রাষ্ট্রের নীতিমালায় নিজের অস্তিত্ব ও অধিকারকে উপেক্ষিত মনে করে এসেছে। এই সংশোধনী সেই বেদনা ও আশঙ্কাকে আরও গভীরতর করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে, এই আন্দোলনকে কেবল সহিংস দাঙ্গা বলে চিহ্নিত করা অন্যায় হবে। বরং এটি একটি দীর্ঘদিনের উপেক্ষার প্রতিক্রিয়া, একটি আতঙ্কগ্রস্ত জাতিগোষ্ঠীর ক্রন্দন, যারা মনে করছে—তাদের ধর্মীয় অধিকার, আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্যের উপর এক প্রবল আঘাত নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতিকে বুঝতে হলে, আমাদের দরকার সহানুভূতির দৃষ্টি, এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে আন্তরিক সংলাপ ও পর্যালোচনার আবহ।
এই ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু, বহু আহত এবং ১৫০-এর বেশি গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। এই আইনটি ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনায় স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে প্রণীত হলেও, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি তাদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় অধিকারের উপর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই নিবন্ধে আমরা ওয়াকফ কী, আইনের পরিবর্তন, মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্বেগ, মুর্শিদাবাদের সহিংসতার বিবরণ, বাইরের লোকদের জড়িত থাকার দাবি, দায়িত্ব এবং প্রতিবাদের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করব। শেষে, আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব।
ওয়াকফ কী?
ওয়াকফ হল ইসলামি শরিয়তের একটি গভীর ধর্মীয় ও সামাজিক ধারণা, যেখানে একজন মুসলিম তাঁর সম্পত্তি—যেমন জমি, ভবন বা অন্যান্য সম্পদ—আল্লাহর নামে ধর্মীয়, শিক্ষামূলক বা দাতব্য উদ্দেশ্যে চিরকালের জন্য উৎসর্গ করেন। এই সম্পত্তি, যা ওয়াকফ নামে পরিচিত, মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়, যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, এতিমখানা, হাসপাতাল বা দরিদ্রদের জন্য আশ্রয় নির্মাণে। ওকালের মূল উদ্দেশ্য হল সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য একটি স্থায়ী সমর্থন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা ইসলামের দান, সেবা এবং সম্প্রদায়কেন্দ্রিক চেতনাকে প্রতিফলিত করে। ভারতে, ওয়াকফ সম্পত্তি কেন্দ্রীয় ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫-এর অধীনে ওয়াকফ বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়, যা এই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। এই সম্পত্তির মোট মূল্য আনুমানিক ১০০,০০০ কোটি টাকা, যা ভারতের রেলওয়ে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর তৃতীয় বৃহত্তম সম্পত্তি ধারক হিসেবে গণ্য হয় (Waqf Amendment Act, 2025)। ঐতিহাসিকভাবে, ওয়াকফ ব্যবস্থা ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুঘল আমলে, সম্রাটরা ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য জমি বরাদ্দ করতেন, যা মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দাতব্য কাজের জন্য ব্যবহৃত হতো। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লির জামা মসজিদ বা হায়দ্রাবাদের মক্কা মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা ওয়াকফ সম্পত্তির অংশ, যা শতাব্দী ধরে সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে আসছে।
ব্রিটিশ শাসনকালেও ওয়াকফ সম্পত্তি স্বীকৃত ছিল, যদিও তাদের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এই সম্পত্তির স্বায়ত্তশাসনকে কিছুটা সীমিত করেছিল। আধুনিক ভারতে, ওয়াকফ সম্পত্তি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক মাদ্রাসা ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে পরিচালিত হয়, যা দরিদ্র মুসলিম শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে। তবে, ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনা বিতর্কমুক্ত নয়। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং অবৈধ দখলের অভিযোগ প্রায়ই উঠে, যা ওয়াকফ বোর্ডের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিছু সমালোচক মনে করেন, এই সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য সংস্কার প্রয়োজন, তবে সংস্কারের প্রক্রিয়া যেন মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারের উপর আঘাত না হয়, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। ওয়াকফ সম্পত্তির এই বিশাল গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক পটভূমি মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পটভূমি বুঝতে সাহায্য করে, যেখানে সম্প্রদায়ের ভয় তাদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় পরিচয় হারানোর সঙ্গে জড়িত।
ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫: মূল পরিবর্তন
২০২৪ সালের আগস্টে লোকসভায় প্রবর্তিত এবং ২০২৫ সালে পাস হওয়া ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধনী হিসেবে এসেছে। এই আইনের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি, যা বোর্ডের স্বায়ত্তশাসনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা যাচাইয়ে সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যার ফলে জেলা কর্মকর্তাদের অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা আরোপ করা হয়েছে, যা সম্পত্তি হস্তান্তরের ঝুঁকি বাড়ায় বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইনটি "ওয়াকফ বাই ইউজার" ধারণা বাতিল করেছে, যার অধীনে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ভিত্তিতে সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃত হতো, ফলে ঐতিহাসিক সম্পত্তির মালিকানা প্রমাণ জটিল হয়ে পড়েছে। এছাড়াও, শুধুমাত্র পাঁচ বছর ধরে ইসলাম পালনকারী এবং সম্পত্তির মালিক ব্যক্তিরাই ওয়াকফ ঘোষণা করতে পারবেন, যা নতুন ওয়াকফ গঠনের প্রক্রিয়াকে সীমিত করে। অবশেষে, "ওয়াকফ-আল-আউলাদ" বা পারিবারিক ওকালে উত্তরাধিকারীদের, বিশেষ করে মহিলাদের, অধিকার নিশ্চিত করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যা সম্পত্তির বণ্টনকে আরও স্পষ্ট করার লক্ষ্যে করা হয়েছে। সরকার দাবি করে যে এই পরিবর্তনগুলি দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা দূর করবে, তবে সমালোচকরা এটিকে মুসলিম সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তবে,সমালোচকরা এটিকে মুসলিম সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি এবং ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্বেগ
মুসলিম সম্প্রদায় এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের প্রধান উদ্বেগগুলি হল:
- ঐতিহাসিক সম্পত্তির ঝুঁকি: অনেক মসজিদ, মাজার এবং কবরস্থানের কাছে শতাব্দী প্রাচীন দলিল নেই, যা এই আইনের অধীনে মালিকানা হারানোর ঝুঁকি তৈরি করে ।
- সরকারি হস্তক্ষেপ: সরকারের বর্ধিত নিয়ন্ত্রণ মুসলিম সম্পত্তি হস্তগত করার ভয় সৃষ্টি করেছে।
- বৈষম্যমূলক উদ্দেশ্য: বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী এই আইনকে সংবিধানের উপর আক্রমণ এবং মুসলিমদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার অস্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন।
- সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রেক্ষাপট: মোদি সরকারের অধীনে মুসলিমদের উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই আইনের প্রতি ভয় আরও তীব্র হয়েছে।
মুর্শিদাবাদে সহিংসতা: ঘটনার বিবরণ
২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল জঙ্গিপুরে প্রাথমিক সহিংসতার পর, ১১ এপ্রিল মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সহিংস রূপ নেয়। প্রধান ঘটনাগুলি হল:
- মৃত্যু: তিনজন নিহত—হরগোবিন্দ দাস ও তার ছেলে চন্দন দাস শামসেরগঞ্জে জনতার হাতে খুন হন; ইজাজ আহমেদ শেখ (১৭) সুতিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
- আহত: ১৮ পুলিশ কর্মী আহত; দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
- গ্রেপ্তার: ১১ এপ্রিল রাতে ১১৮ জন এবং ৮ এপ্রিল ২২ জন গ্রেপ্তার হন।
- ধ্বংসযজ্ঞ: জঙ্গিপুরে যানবাহনে আগুন, সুতি ও শামসেরগঞ্জে রেলপথ অবরোধ, আজিমগড়ে রেল সম্পত্তি ভাঙচুর।
- পুলিশের পদক্ষেপ: পুলিশ চার রাউন্ড গুলি চালায়; ডিজি রাজীব কুমার দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দেন।
- আদালতের হস্তক্ষেপ: কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী (CAPF)মোতায়েনের নির্দেশ দেয়; ছয় কোম্পানি বিএসএফ মোতায়েন করা হয়।
বাইরের লোকদের জড়িত থাকার দাবি
মুর্শিদাবাদের সহিংসতার পেছনে বাইরের লোকদের জড়িত থাকার দাবি বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। কিছু স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করেছেন যে বহিরাগতরা, বিশেষ করে হিন্দু ব্যক্তিরা মুসলিম সেজে, প্রতিবাদকে সহিংসতায় রূপ দিয়েছে। এই দাবি প্রথম আলোচনায় আসে যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন যে সহিংসতা "পূর্বপরিকল্পিত" ছিল এবং এর পেছনে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির হাত রয়েছে। তিনি জানান, বাইরের (বিহার থেকে আগত) দুষ্কৃতীরা স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, যা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে হিংসাত্মক করে তুলেছে। তবে, এই অভিযোগের সমর্থনে কোনো কঠিন প্রমাণ এখনও প্রকাশিত হয়নি। বিজেপি নেতা সুভেন্দু অধিকারী এই দাবির বিপরীতে পাল্টা অভিযোগ করেছেন, বলেছেন যে সহিংসতার ফলে ৪০০-এর বেশি হিন্দু ধর্মীয় নিপীড়নের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসকে দায়ী করে বলেন, স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উস্কানিই এই সংঘর্ষের কারণ। এই পরস্পরবিরোধী দাবিগুলি তদন্তকে জটিল করে তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ একটি বিশেষ তদন্ত দল (SIT) গঠন করেছে, যারা সিসিটিভি ফুটেজ, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং স্থানীয় সাক্ষীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করছে। মমতার দাবি রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়েছে, কারণ এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি আঙুল তুলেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জঙ্গিপুর ও শামসেরগঞ্জে অচেনা মুখ দেখা গেছে, যারা ভিড়ের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। তবে, এই দাবি এখনও তদন্তাধীন, এবং প্রমাণের অভাবে এটি গুজব হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। এই অভিযোগগুলি মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সংবেদনশীলতাকে আরও তীব্র করেছে, যেখানে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ইতিমধ্যেই উচ্চ পর্যায়ে ছিল। তদন্তের ফলাফল এই ঘটনার প্রকৃতি এবং দায়িত্ব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সহিংসতার জন্য দায়ী কে?
মুর্শিদাবাদের সহিংসতার দায়িত্ব কার, তা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্ক তীব্র হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনই এই অশান্তির মূল কারণ, এবং বিজেপি ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, রাজ্যে এই আইন প্রয়োগ হবে না এবং সরকার শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তৃণমূল নেতা সৌগত রায় জানিয়েছেন, মমতা মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে, বিজেপি তৃণমূলকে "মুসলিম তোষণ" নীতির জন্য দায়ী করেছে, দাবি করে যে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছে। বিজেপি নেতা সুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেছেন, তৃণমূলের সমর্থনে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে, যার ফলে বহু হিন্দু গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। তবে, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে দায় নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, প্রতিবাদের নামে স্থানীয় দুষ্কৃতীরা সুযোগ নিয়ে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। সুতিতে পুলিশের গুলিতে এক কিশোরের মৃত্যু এবং জঙ্গিপুরে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়, যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করলেও প্রশাসনের প্রাথমিক ব্যর্থতার সমালোচনা থামেনি (CAPF Deployment)। রাজনৈতিক দলগুলির এই পারস্পরিক দোষারোপ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়েছে। স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, ওয়াকফ আইন নিয়ে প্রাথমিক অসন্তোষ স্থানীয়ভাবে জন্ম নিলেও, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এটিকে হিংসাত্মক রূপ দিয়েছে। দায়িত্ব নির্ধারণে তদন্তের ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ হবে, তবে এই ঘটনা প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে তুলে ধরেছে।
দাঙ্গা কি ন্যায্য ছিল?
মুর্শিদাবাদের সহিংসতা ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের গভীর উদ্বেগ থেকে উদ্ভূত হলেও, এটি প্রতিবাদের যুক্তিযুক্ত বা উপযুক্ত মাধ্যম ছিল না। সম্প্রদায়ের ভয়—যেমন ঐতিহাসিক সম্পত্তি হারানো এবং ধর্মীয় অধিকারের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ—বৈধ এবং গুরুতর। তবে, সহিংসতা তিনজনের মৃত্যু, ১৮ পুলিশ কর্মীর আহত হওয়া, এবং যানবাহন ও রেল সম্পত্তির ধ্বংসের মতো মর্মান্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। এই ক্ষতি সম্প্রদায়ের উদ্বেগ প্রকাশের উদ্দেশ্যকে দুর্বল করেছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যেমন সমাবেশ, সংলাপ বা আইনি চ্যালেঞ্জ, আরও ফলপ্রসূ হতো। সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যে এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে, যা একটি গঠনমূলক পথ প্রদান করে (Supreme Court Hearing)। সহিংসতা শুধুমাত্র জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতিই করেনি, বরং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়েছে, যা মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিপন্ন করেছে। কিছু প্রতিবাদকারী হয়তো মনে করেছিলেন যে সহিংসতা তাদের কণ্ঠস্বরকে জোরালো করবে, কিন্তু এটি বিপরীত ফল দিয়েছে—প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা এবং গ্রেপ্তারের মাধ্যমে প্রতিবাদ দমন করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য, বিডিও অফিস এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরে হামলা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয় — এটা স্পষ্টভাবে বলার বিষয়। সরকার বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকতেই পারে, এমনকি তা যুক্তিসম্মতও হতে পারে, কিন্তু এই ক্ষোভ প্রকাশের পথ হওয়া উচিত শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে থাকা প্রতিবাদ কর্মসূচি। সরকারি দপ্তর, বিশেষ করে ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস (BDO), মূলত সাধারণ মানুষের পরিষেবা দেওয়ার জন্য কাজ করে। এই অফিস ধ্বংস করলে আসলে ভুক্তভোগী হয় সেই সাধারণ মানুষই, যারা সেখানে রেশন কার্ড, প্রকল্পের ফর্ম, সাহায্যপ্রাপ্তি বা অন্যান্য সরকারি সুবিধার জন্য আসেন। অর্থাৎ, এমন হামলার ফলে প্রতিশোধের বদলে সমাজের দুর্বল মানুষরাই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এছাড়া, এই ধরনের হামলা প্রশাসনের কাছে একটি অজুহাত তৈরি করে কঠোর দমননীতির। ফলে, সৎ ও গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের কণ্ঠও দমন হতে পারে। প্রশাসনের প্রতিনিধি যেমন বিডিও, তার ওপর হামলা হলে সেটি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার লঙ্ঘন, এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোরই প্রতিফলন।
তবে এটাও মানতে হবে, এমন ঘটনা তখনই ঘটে যখন দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অবিশ্বাস এবং অবহেলার বোধ জমতে জমতে বিস্ফোরণের রূপ নেয়। তাই সরকারের দায়িত্ব—এমন পরিস্থিতি তৈরি না হতে দেওয়া। সংলাপ, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক নীতি এই ক্ষোভ প্রশমনের উপায়। এছাড়া, সহিংসতা রাজনৈতিক দলগুলির হাতে পড়ে, যারা এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। শান্তিপূর্ণ পথে প্রতিবাদ করলে সম্প্রদায়ের উদ্বেগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও কার্যকরভাবে উঠে আসতো। সহিংসতার পরিবর্তে সংলাপ ও আইনি লড়াই সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় টেকসই সমাধান দিতে পারতো।
আমার দৃষ্টিভঙ্গি
মুর্শিদাবাদের সহিংসতা এবং ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন নিয়ে বিতর্ক একটি জটিল ও সংবেদনশীল বিষয়, যা ভারতের ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। আমার মতে, মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্বেগ—বিশেষ করে তাদের ঐতিহাসিক সম্পত্তি ও ধর্মীয় অধিকার হারানোর ভয়—বৈধ এবং শোনার দাবি রাখে। সরকারের উচিত এই উদ্বেগগুলি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে, আইনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে খোলামেলা সংলাপে প্রবেশ করা। ওয়াকফ সম্পত্তির স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না, তবে এই সংস্কারগুলি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সম্মান করা উচিত। একইভাবে, প্রতিবাদকারীদের সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ ও আইনি পথে তাদের মতামত প্রকাশ করা উচিত।
সহিংসতা কেবল জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি করে এবং সম্প্রদায়ের বৈধ দাবিকে দুর্বল করে। মুর্শিদাবাদের ঘটনা আমাদের শেখায় যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এড়াতে সকল পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সংলাপ অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলির উচিত এই সংকটকে ভোটের রাজনীতির হাতিয়ার না করে সমাধানের পথ খোঁজা। আমি মনে করি, স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় গুরু এবং সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই উত্তেজনা কমানো সম্ভব। ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্য রক্ষায় সকলের দায়িত্ব রয়েছে, এবং মুর্শিদাবাদের এই ঘটনা আমাদের সেই দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। মুর্শিদাবাদের সহিংসতা এবং ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন নিয়ে বিতর্ক ভারতের ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। শান্তিপূর্ণ সংলাপ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সংকট সমাধান সম্ভব। সকল পক্ষের উচিত শান্তি ও ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া, যাতে ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন থাকে।