কখনও এনআরসি, তো কখনও বুলডোজার তো এবার বাল্যবিবাহ! রাজনীতির বেড়াজালে অসমীয়া মুসলিম বিপাকে

কখনও এনআরসি, তো কখনও বুলডোজার আবার কখনও বাল্যবিবাহ। আবার তারা করে আসছে ডিটেনশন ক্যাম্প, তো কখনও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছেদের সন্ত্রাস। আবার কখনও ‘অধিগ্রহণকারী’, তো ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘অবৈধ অভিবাসী’র মতো অপমানজনক, মিথ্যা মানহানিকর মন্তব্য এবং হুঙ্কার। স্পষ্ট যে ইত্যাদি সকল সমস্যার বেড়াজালে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ই লক্ষবিন্দু। অসমের রাজনৈতিক চক্করে, অসহায় মুসলমানদের জীবন অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন। হিংস্র রাজনীতির কাণ্ডে অসমীয়া মুসলিমদের নিত্যদিনের কর্ম - এক বিপাক থেকে আর এক বিপাকে। এক দুঃখীর ভাষায়: পৃথিবী বিস্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, সংকোচিত মনে হচ্ছে।    

 

এনআরসি: এক অবিদিত বেদনা

২০১৮ সালের দ্বিতীয় এনআরসি খসড়া প্রকাশ থেকে আজ প্রযন্ত রাজনীতির উস্কানিতে সকল প্রশাসনিক কর্মকান্ড মনে হচ্ছে অসমীয়া মুসলিম যথা মিয়াদের বিরুদ্ধে - তাদের বহিরাগত প্রমান করতে। সরকারের চেহারা বদল হলেও, ব্যবহার বদলে না। পার্টির পরিবর্তনে কি এতই চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে - অবিশ্বাসনীয়। 

   জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি (National Register of Citizens) ১৯৫১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে প্রয়নিত হয়। এটি সকল ভারতীয় নাগরিকের এক পঞ্জী বা রেজিস্টার স্বরূপ। প্রস্তাবিত হয় যে এর মাধ্যমে অবৈধ অভিবাসনের অবসান সম্ভব। এনআরসি তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত বা আপডেট করার উপায় হচ্ছে: ১৯৫১ বা ১৯৭১-এর মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যে কোনও ভোটার তালিকা বা অন্য গ্রহণযোগ্য নথিতে নাম থাকা। তবেই প্রমাণিত হবে যে সে ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু সীমান্ত রাজ্য অসম ছাড়া অন্য কোনও রাজ্যে এক আইনী পঞ্জিকা প্রণয়ন করা হয়নি।  

   কিন্তু যখন ৩১ আগস্ট ২০১৯-এ এর চূড়ান্ত অনুলিপি প্রকাশ করা হয় অসমের পরিণীতি রাজ্যবাসীসহ সকল দেশবাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে যেখানে প্রায় ১৯ লক্ষের বেশি সংখ্যায় (১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন) আবেদনকারীর নাম বাদ পরে যায়। ৩ কোটি ৩০ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৬১ জন জনসংখ্যার মধ্যে ৩ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় (ইন্ডিয়া টুডে)। ১৯৭১ সালের আগে থাকা ডকুমেন্টগুলি প্রমাণ করার নিছক প্রচেষ্টায় এইসকল বহিষ্কৃত জনগণদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হয়।

  তার পর আবার ২০১৯-এর ১২ই ডিসেম্বরে পাস হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (Citizenship Amendment Act, 2019) যা আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এক শ্রেণীর অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদান করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বাদ পরে যায় মুসলিম সম্প্রদায়। কি একটি বৈষম্য!   

   স্পষ্ট, উদ্দেশ্য হল একটি ধর্মীয় মাপকাঠি দ্বারা নাগরিকত্ব প্রদান করা। মনে পরে যায় নাৎসিদের দ্বারা ১৯৩৫ সালের রাইখ নাগরিকত্ব আইন (Reich Citizenship Law, 1935) যাতে জাতিগত ভিত্তিক আদর্শিক নীতিগুলি আইনাবদ্ধ করা হয়। অনুরূপ চোখের সামনে ভেসে উঠে মুসলমানদের উৎখাত করার পরে স্পেনের পরবর্তী ফলাফলের পূর্বাভাস।

   বলাবাহুল্য, দেশবাসী চুপচাপ কান বুঝে সব সহ্য করেনি।  দেশজুড়ে দেখা গিয়েছিলো বিক্ষোভ। যুবক থেকে বৃদ্ধ, বিশেষ করে ছাত্রদল আর নারীশক্তি, সবাই অংশগ্রহণ করেছিল।  অনেক রাজ্য সরকারের নেতৃত্বে উক্ত আইনের বিরুদ্ধে বিধানসভায় পাল্টা রেজোলিউশন পাস করা হয়। 

 

বুলডোজার সন্ত্রাস

বুলডোজার নির্মাণের প্রতীক। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা এবং স্বেচ্ছাচারী প্রশাসনের প্রদর্শনীতে তা এখন ধ্বংস ও বিচ্ছেদের উপকরণ মনে হচ্ছে । কখনও অবৈধ নির্মাণ বা বেআইনি দখল বা উন্নয়ন উদ্দেশ্যের নামে নির্বিচারে দরিদ্র-অসহায় পরিবার-নীড়ে চলছে উচ্ছেদ অভিযান। আর্তনাদে উন্মাদনায় ছুটে বেড়াচ্ছে বাসাহারা বেশিরভাগ মুসলমান। 

   সম্প্রতিক, গত মঙ্গোলবার (১৪ই ফেব্রুয়ারী) সোনিতপুর জেলার বুরহা চাপরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে অধিগ্রহণ সাফ করার জন্য উচ্ছেদ অভিযান চালায় অসম সরকার। দ্য টেলিগ্রাফ সংবাদপত্র অনুসারে সরকার ‘১,৮৯২ হেক্টর জমির উপর দখলমুক্ত করার’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেখানে ‘হাজার হাজার মানুষ কয়েক দশক ধরে অবৈধভাবে বনভূমি দখল করে আসছে।’ একই সংবাদপত্রের খবর প্রায় ১০০টি বুলডোজার, খননকারী, ট্রাক্টর এবং নিরাপত্তা কর্মীদের একটি দল উক্ত স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে। 

   আল-জাজীরা রিপোর্ট করে যে ২০২১ সালে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী পদে আসার পর সিদ্ধান্ত নেয়: “... আমাদের ভূমি এবং অসমীয়া পরিচয়কে দখলদার ও অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে অসমের সমস্ত অংশ থেকে অধিগ্রহণকারীদের উচ্ছেদ করা হবে।” সরকারে উদ্দেশ্যগোলক থেকে কিছুই বার হয়নি - ঘর বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ইত্যাদি।  এসবের পর আবার একই ধাবা লাগে এরা যে অবৈধ অভিবাসী।

যে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তুলেছে হয়তো সে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে নয়তো শেষ প্রযন্ত প্রাণ হারিয়েছে।  খুব কম সংখ্যক মানুষ ঘর ফেরত পেয়েছে।  তাছাড়া, অবৈধ অভিবাসীদের জন্য তো আছে বিশ্ব বিখ্যাত ডিটেনশন ক্যাম্প। 

 

বাল্যবিবাহ রোধ পরিবার বিচ্ছেদ

অসম সরকার এবার সোজাসুজি সংসার বিচ্ছেদের চক্রান্তে। ভারতে বাল্যবিবাহ আইনগতভাবে নিষেধ।  তবুও কিন্তু কেউ না জানে অবগত হয়ে, কারও পরিবার প্রয়োজনে, কেউ বা বাধ্য হয়ে, কখনও আবার কোনো সমাজ-সংস্কৃতি অনুসরণ করে বা অন্য কোনো কারণে দেশের প্রত্যেক প্রান্তে এখনও বেশ পরিমানে তা প্রচলিত। (বাল্যবিবাহ নিয়ে ইসলাম ধর্মীয় বিধান ও মাপকাঠি এখানে অবর্ণিত থাকলো।)       

   কিন্তু বাল্য বিবাহ নিষেধাজ্ঞা আইন  (Prohibition of Child Marriage Act, 2006) ও পকসো এক্ট (Protection of Children from Sexual Offenses Act, 2012)  ব্যবহার করে বাল্যবিবাহ রোধের নামে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও তাদের পরিবার সদস্যদের মধ্যে যে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালিয়েছে অসম সরকার তা নিন্দনীয়। প্রশাসনের এই অপরিকল্পিত উদ্দ্যেগ যাদের বিয়ে হয়ে শান্ত-সম্বল সংসার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে নতুন করে বিশৃঙ্খলা তৈরী করা ছাড়া আর কিছু নয়। পুলিশ অভিযুক্ত বেক্তিদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ায়, কারাগার দ্বারের সামনে তাদের মহিলা ও ছোট বাচাদের আর্তনাদ দেখে মনে হচ্ছে - নির্যাতন ছাড়া আর কিছু নয়। খবরে এসেছে কিছু মহিলা বিরহ-বেদনায় সন্ত্রস্ত হয়ে আত্মহত্যাও করে ফেলেছে।  

   ফেব্রুয়ারী ১৩-এর মধ্যে ৩০১৫ জনেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয় (আর্টিকেল-১৪ ওয়েবসাইট)। শুধু বিবাহের বরকে নয়; অভিবাবক, ধর্মগুরু ও অন্নান্য সংযুক্ত ব্যাক্তিদেরও ওপর মামলা চলে। যদিও স্পষ্টতই মুসলিমরা কড়া নজরে, বেশ কয়েকজন অন্য ধর্মীয়দেরও ছাড়েনি রাজ্য প্রশাসন। গত ১০ ফেব্রুয়ারী ডেক্কান হেরাল্ড সংবাদ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বলা হয়: “বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আসাম সরকারের দমন-পীড়ন একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার চেয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত পুলিশি পদক্ষেপ।”    

   অনেকেই অসম সরকারে এই বিদ্বেষমূলক পদক্ষপের সমালোচনা করেছে। তাছাড়া সাংবিধানিক দিক দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে তা নিন্দিত। অসম হাইকোর্ট রায় দে যে রাজ্য সরকারের এই গণগ্রেফতারের পদ্ধতি জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। 

   বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পদ্ধতি গণগ্রেফতার নয়; বরং প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রয়োজনীয় সঠিক সচেতনতা প্রচার প্রয়োজন। এতে রাজনীতি নয়; সমাজ কল্যাণের সুচিন্তা দরকার। বিদ্বেষ নয়; ভালোবাসা দিয়েই সম্ভব, সাম্প্রদায়িকতা নয়; আন্তরিকতা হওয়া চায়।   

 

কিন্তু হায়! অসম শুধু স্বপ্ন দেখে  

পুরানো পাঠ পুনরায় দেখার সময়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাধ্যাকর্ষণ মধ্যযুগীয় অসমের সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে প্রশমিত করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত, এই অঞ্চলের বহুত্ববাদী রশ্মিকে সিক্ত করার উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক কিছু বিরোধী শক্তির সময়মত আবির্ভূত হয়েছে। রাজনৈতিক রোষে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।  ফলে মানুষ অসহায় ও বাস্তুচ্যুত বোধ করে, আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বিঘ্নিত হয় এবং মানবতার ঐক্য নষ্ট হয়। আজান ফকির এবং শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের রাজ্যে বিঘ্নিত পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার জন্য, তাদের শিক্ষার প্রতি আবার মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। ভালোবাসার পাঠ দিয়ে জনগণের হৃদয় ও মনকে আবার নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একে অপরের সাথে আবার তাদের ফিরনি বা প্রসাদ ভাগ করে নেওয়াই একমাত্র সমাধান। অতঃপর, শীঘ্রই বা পরে, আবার আন্তঃধর্মীয় ঐক্য, বহুসংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রঙ দেখা দেবে। কারও সঙ্গে কোন অত্যাচার হবেনা; সবাই সুবিচার ভোগ করবে। 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter