শবে বরাতের তাৎপর্য
শা’বান মাসের ১৪ ও ১৫ই রাত শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাত বলে অবিহিত। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি; ‘শবে বরাত’ অর্থ মুক্তির রজনী। ‘শবে বরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারকাত’। ইসলাম ধর্ম সংস্কৃতি অনুসারে শা’বান মাসের ১৪ ও ১৫ রাত্রিদ্বয়ে এক বছরের জন্য রিজিক নির্ধারন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনের বিভিন্ন জাগায় উল্লেখ করেছেন। যেমন সূরা তাওবার প্রথম আয়াত- بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ অর্থাৎ (সম্পর্কচ্ছেদ করা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ) এই রাত কে ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ’ বলা হয় অর্থাৎ বরকতময় রাত এবং এই রাতকে ‘লাইলাতুল শক’ বলা হয় অর্থাৎ ধন সম্পদ বন্টন করার রাত। বিশেষ করে এই রাতে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়ে এই দিনটিতে আল্লাহর এবাদতে মগ্ন থাকা উচিৎ কেননা আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জ্ত সূরা দুখানের চতুর্থ আয়াতে উল্লেখ করেছেন -
فيها يفرق كل أمر حكيم
“ওই রাতে বণ্টন করে দেয়া হয় প্রতিটি হেকমতময় কাজ”।
এই রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন। কেননা আল্লাহ সূরা দুখানে ইরশাদ করেছেন, “আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক (বরকতময়) রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী।” এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরিকৃত হয়। এইখানে আল্লাহ তার পাপী বান্দাদেরই সর্তক করেছেন এবং এই পবিত্র রাতেই মহান আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বান্দাকে তার রিযক বন্টন করেন। এই জন্য মুসলিমদের কাছে এই রাত গুরুত্বপূর্ণ। সাইয়িদুল কাওনাইন হজরত মহাম্মাদ (সাঃ) এক হাদিসের মধ্যে ইরশাদ করেছেন:
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لِأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعَرِ غَنَمِ كَلْبٍ
“অবশ্যই আল্লাহ তাবারক ও তাআ’লা শাবান মাসের ১৫ই রাতে দুনিয়ার নিকটতম আকাশে অবতীর্ণ হন এবং বানু কালব গোষ্ঠীর ছাগলগুলির চুলের আয়ত্বের বেশি মানুষের গুনাহ কে ক্ষমা করেন।”
হাবীবুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন:
عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا، فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا، فَيَقُولُ: أَلَا مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ أَلَا مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلَا مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلَا كَذَا أَلَا كَذَا، حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.
“যখন শাবান মাসের ১৫ই রাত আসে তখন সেই রাতে তোমরা কিয়াম করো ও দিনের বেলায় রোজা রাখো, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, এবং আল্লাহ তাআলা বলেন: কেউ কি আছে যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিব? এমন কেউ কি আছে যে রিযক চায় এবং তাকে রিযক দেব? যদি সে কষ্ট পায় তাহলে আমি তাকে সুস্থ করে দেব, এবং এনুরূপ যতক্ষণ পর্যন্ত সূর্য উদয় না হয়ে যায়।”
قال الشافعي: وبلغنا أنه كان يقال: إن الدعاء يستجاب في خمس ليال في ليلة الجمعة، وليلة الأضحى، وليلة الفطر، وأول ليلة من رجب، وليلة النصف من شعبان.
শাফিয়ী (রাঃ) বলেছেন: আমায় খবর পৌঁচেছে যে বলা হয়: পাঁচটি রাতে আল্লাহ তাবারক ওয়া তাআ’লা নিজের বান্দার দুয়ার খুব শিগ্রই উত্তর দেন - শুক্রবারের রাত, আল-আযহার রাতে (কুরবানীর রাতে), ফিতরের রাত (রমজানের ঈদের রাতে), রজবের প্রথম রাত এবং মধ্য শা'বানের রাত।
শবে বরাতের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মুহাদ্দিস ও তাবেয়ীরাও অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন যেমন আতা বিন এসার (রহঃ) বলেছেন :
وقد قال عطاء بن يسار: ما من ليلة بعد ليلة القدر أفضل من ليلة النصف من شعبان
অর্থাৎ: মধ্য শাবানের রাতের চেয়ে লাইলাতুল কদরের পর আর কোনো রাত উত্তম নয়।
হাদিসে নবাবীতে যে কথা গুলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা থেকে বোঝা যায় যে এই রাতটি ওই ব্যাক্তিদের জন্যে রহমত হয়ে এসেছে যারা সর্বদা কুকর্মে ও গুনহাই লিপ্ত থাকে। আমাদের উপর অপরিহার্য যে এই রাতে কিয়ামুল লাইল করে ইহকাল ও পরকালের জন্যে আল্লাহ নিকটবর্তী হয়ে প্রার্থনা করা। কেননা আল্লাহ তাবারক ওয়া তাআ’লা এই রাতে নিজের বান্দাদের জন্য অপেক্ষায় থাকেন এবং যে ব্যাক্তি এই রাতে আল্লাহর কাছে পিপাসা হয়ে আসে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জ্বত তাকে পিপাসাহীন হয়ে ফিরিয়ে দেন এবং যেই ব্যাক্তি খালি হাতে আসে আল্লাহ তার হাত পরিপূর্ণ করে ফিরিয়ে দেন। এই প্রসঙ্গে কবি এক উর্দু পদ্যের মাধ্যমে বলেছেন:
وہ سنتا ہے سب کی دعا کرتو دیکہو
تم اپنے نصیب آزما کر تو دیکہو
سیاہی گناہوں کی دہل جاۓ دل سے
تم انکہو سے آنسو بہا کر تو دیکہو
শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয়
যা যা করা উচিত :
ক) নফল নামাজ:
(১) তাহিয়্যাতুল অজু, (২) দুখুলিল মাসজিদ, (৩) আউওয়াবিন, (৪) তাহাজ্জুদ, (৫) সালাতুত তাসবিহ, (৬) তাওবার নামাজ, (৭) সালাতুল হাজাত, (৮) সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া।
(খ) নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা।
(গ) পরের দিন নফল রোজা রাখা
(ঘ) কোরআন শরিফ:-
(১) সুরা দুখান ও (২) অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা।
(ঙ) দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া।
(চ) তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা।
(ছ) দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা।
(জ) কবর জিয়ারত করা।
(ঝ) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।
যা যা করা উচিত নয়:
(১) আতশবাজি, পটকা ফোটানো, (২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা করা, (৩) অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস করা, (৪) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, (৫) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো, (৭) হালুয়া-রুটি বা খাওয়াদাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে গাফিল থাকা।