কুরআন আলোকে আফ্রিকার সাবীয় রাজ্য

কুরআনের ৩৪তম অধ্যায় যথা সূরা সাবার ১৫-১৯ নম্বর আয়াতসমূহ:

১৬- নিশ্চয়ই সাবার জন্য তাদের ভূমিতে নিদর্শন ছিল, দুটি বাগান - ডানে ও বামে। 'আপন প্রতিপালকের রিযক আহার করো এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। পবিত্র শহর এবং ক্ষমাশীল প্রতিপালক।'

১৬- অতঃপর তারা মুখ ফিরিয়ে নিল সুতরাং আমি তাদের উপর প্রবল বন্যা প্রেরণ করলাম এবং তাদের বাগানসমূহের পরিবর্তে দুটি বাগান তাদেরকে প্রদান করেছি, যেগুলোর মধ্যে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল এবং ঝাউ গাছ আর অল্প কিছু কুল গাছ।

১৭- আমি তাদেরকে এ বলে দিলাম - তাদের অকৃতজ্ঞতার শাস্তি। এবং আমি কাকে শাস্তি দিই? তাকেই, যে অকৃতজ্ঞ।

১৮- আমি স্থাপন করেছিলাম তাদের মধ্যে, এবং ওই শহরগুলির মধ্যে, যেগুলিতে আমি কল্যাণ রেখেছি রাস্তার মাথায় মাথায় কত শহর। আর সেগুলোর মাঝখানে ভ্রমণ বিরতির পরিমাণ দূরত্ব রেখেছি। 'সেগুলোতে ভ্রমণ কর রাত ও দিনসমূহে নিরাপদে।' 

১৯- সুতরাং তারা বলল, 'হে আমার প্রতিপালক! আমাদের সফরের মধ্যে দূরত্ব স্থাপন করো।' এবং তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে ফলে আমি তাদের কাহিনীতে পরিণত করে দিয়েছি এবং তাদেরকে পূর্ণ মানসিক দুঃখ ধারা বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছি। নিশ্চয় তাতে অবশ্যই নিদর্শনাদি রয়েছে প্রত্যেক বড় ধৈর্যশীল ও প্রত্যেক বড় কৃতজ্ঞের জন্য।

এছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় যেমন সূরা নামল এবং ক্বাফ সাবা শহরের বর্ণনা হয়েছে। তাছাড়াও হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনাতেও সাবা শহর ও সম্পর্কিত ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এর ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক গুরুত্ব অনেক। নিম্নে একটি অনুবাদিত প্রবন্ধের পরিচ্ছেদ রাখা হলো।

 

মারিবের প্রাচীন গ্রেট ডাম - কুরআন কি বলে?

এই বাঁধটি প্রায় ছয়শ মিটার প্রসারিত এবং তার যুগের বৃহত্তম বাঁধগুলির মধ্যে একটি। এই বিশাল কাঠামো মৃত মরুভূমিকে একটি সুন্দর মরূদ্যানে পরিণত করেছিল। কীভাবে বাঁধের ধ্বংসের ফলে বিরাট রাজকীয় প্রাচীন সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘটে এবং তার পর্যালোচনা কুরআনেও প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রাচীন বিশ্বের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং অলৌকিকতা

গ্রেট ড্যাম দক্ষিণ আরবের বৃহত্তম শহর মারিবের চারপাশে একশত বর্গ কিলোমিটারের বেশি বালুকাময় মাটিতে সেচ দেওয়া সম্ভব করে তুলেছিল। মারিব ইয়েমেনের প্রাচীনতম শহর। সমগ্র আরব অঞ্চলের মধ্যে উক্ত শহরের সবচেয়ে অসাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে।

মারিব প্রাচীনকালের মহা সাম্রাজ্য  সাবীয় রাজ্যের (Sabaean Kingdom) রাজধানী ছিল।  ঐতিহাসিকরা একে 'সভ্যতার দোলনা' (Cradle of Civilizations)  বলে অভিহিত করেছ। যীশু খ্রিস্টের (ঈসা আলাইহিস সালাম) জন্মের সাত শতাব্দী আগে এখানে বিখ্যাত মারিব বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পরিমাপে দশ কিলোমিটার দীর্ঘ, কয়েকশ তালা উঁচু এবং অসংখ্য খাল সমন্বিত বিশাল জলবাহী এক বিশাল কাঠামো।

হাজার বছর ধরে এই সৌধের স্থাপনাটি আরবের অন্যতম বিস্ময়। আশ্চর্যের কিছু নেই, যেহেতু মরুভূমির জল সমৃদ্ধির কথা।  এই ডাম অঞ্চলটিকে সমৃদ্ধ ফসল চাষ, দুর্দান্ত ফুলের বাগান তৈরি করতে এবং মাছ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এই কারণেই, সাবীয় রাজ্য প্রাচীনকালের অন্যতম ধনী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বাণিজ্য সাম্রাজ্য ছিল।

৬ষ্ঠ শতাব্দীতে নবী মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্মের বছর বাঁধটি ভেঙে যায় (ঘটনাটি ইসলামিক পরিভাষায় সাইল আল-ইরাম বলে পরিচিত)। ফলে শহরটিতে ধ্বংসের সাথে সাথে এক মহিমান্বিত প্রাচীন সভ্যতার মৃত্যুর ধেয়ে আসে।  কিছু মানুষ পরিত্রাণের জন্য পালায়ন করে, অন্যরা মারা যায়।  সময়ের শেষে এই মহারাজ্য ছিল বালির খপ্পরে। এটি ইসলামী বিশ্বের এমন একটি মহৎ ঘটনা যা কুরআনেও প্রতিফলিত হয়েছে (আয়াতগুলি পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে)।

সাবীয় রাজ্য

মারিব শহরটি সাবা রাজ্যের রাজধানী ছিল। জেরুজালেমে রাজা সলোমনের (সুলাইমান আলাইহিস সালাম) সাথে সাক্ষাৎ করার পর এই বিশেষ রাজ্যের রানী এক কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে যে কীভাবে সে মহিমান্বিত জ্ঞানী শাসকের জন্য মূল্যবান উপহারের পুরো কাফেলা নিয়ে এসেছিল (কুরআনের সূরা নামালেও ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে)। সে সময়ের প্রচুর সোনা, মূল্যবান মশলা ও তেল ছিল।

রানী সুলায়মানের (আলাইহিস সালাম) কাছে ধাঁধা তৈরি করে যাচাই করেন যে সত্যিই তিনি জ্ঞানী কি না। রাজা সব সমাধান করেন।  তিনি সাবার রানীকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন এবং তাকে উদ্বিগ্ন সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করে দেন।

দুর্ভাগ্যবশত, এই ঘটনা ছাড়া সাবার রাণীর অস্তিত্বের আর কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। পরে আরবি গ্রন্থের পাশাপাশি ইথিওপিয়ান কিংবদন্তীতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।  যাইহোক, এই ধরনের উদার উপহারগুলি সম্পূর্ণরূপে সাবিয়ান সাম্রাজ্যের সম্পদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

মশলার সাম্রাজ্য

স্পাইস রুট বা মশলার রাস্তা ধরে বাণিজ্যের কারণে সাবায়িয়ান সাম্রাজ্য অত্যন্ত ধনী হয়ে ওঠে। এই রাস্তাটি আরবের দক্ষিণে এবং গাজা বন্দরের মধ্যে চলত।  এটি ধূপের পথ (Path of Incense) নামেও পরিচিত ছিল।  মারিব এমন একটি কেন্দ্র যেখানে বণিকরা বিশ্রাম এবং পণ্য বিনিময়ের জন্য থামত।

দুটি দুর্লভ এবং সবচেয়ে মূল্যবান পুরাকীর্তি পণ্য - ধূপ এবং গন্ধরসের সুগন্ধযুক্ত রেজিনের জন্য মারিব বাজার অধিপতি ছিল।  এই এলাকায় বেড়ে ওঠা গাছের রস থেকে এগুলো পাওয়া যায়।  এই পদার্থগুলি প্রাচীন বিশ্বে আচার ও চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত।

ধূপ এবং গন্ধরসের ঐশ্বরিক ঘ্রাণ বিশ্বজুড়ে রাজকীয় দরবারে ব্যবহৃত হত।  এই গাছগুলি অত্যন্ত খরা সহনশীল।  যাইহোক, এই গাছপালা যত্নশীল রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।  খেজুরের সাথে সাথে, এই ফসলগুলি সাবীয় রাজ্যের অর্থনীতির মেরুদণ্ড স্বরুপ ছিল।

মরুভূমিতে কৃষির বিকাশ? সাবিয়ানদের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিভার জন্য এটি সম্ভব হয়েছিল।  তারা একটি বিস্তৃত সেচ ব্যাবস্থা তৈরি করেছিল যার মধ্যে কূপ এবং খালের হচ্ছে বিশেষ।  এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল মারিব বাঁধ।

বাঁধটির নির্মাণে মর্টার এবং পাথর পদার্থ ব্যাবহার করা হয়।  বালাক ওয়াদি আধানের পাহাড়ের বিশাল গিরিখাত জুড়ে অবস্থান করে ছিল গ্রেট ড্যাম।  প্রাপ্য তথ্য অনুসারে, বাঁধের উচ্চতা ছিল দেড় ডজন মিটার এবং দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় এক কিলোমিটার।  অবশ্য, যখন প্রথম বাঁধটি ১৭৫০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল, তখন এটি বিশাল এবং চিত্তাকর্ষক ছিল না।  ৭ম শতাব্দীতে পুনঃনির্মাণ হয়।  বাঁধের ঘেরের চারপাশে গাঁথনি দ্বারা সংযুক্ত বিশাল পাথর এবং চুন স্তম্ভ ছিল যা আজ পর্যন্ত টিকে আছে।

বিরাট সাম্রাজ্যের পতন

মারিব বাঁধটি কয়েক শতাব্দী ধরে সাবীয় দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে।  পরবর্তীকালে হিমিয়ার রাজ্যের শাসকরা এতে নিয়োজিত হন।  তারা বাঁধটিকে আরও মজবুত ও শক্তিশালী করে তোলে।

দুর্ভাগ্যক্রমে, সময়ের সাথে সাথে, বিশাল কাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করে।  সমস্ত জ্ঞান এবং জটিল জলবাহী প্রকৌশল পদ্ধতি, যার জন্য সাবায়িয়ান রাজ্য এত বিখ্যাত ছিল, আস্তে আস্তে বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।  বাঁধটি সঠিক অবস্থায় রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।  অবশেষে, ৫৭০ সালে মারিব বাঁধ ভেঙে পড়ে।

পণ্ডিতরা এখনও কি ঘটেছে তার কারণ সম্পর্কে একমত হতে পারেনি। কেউ মনে করেন ভারী বর্ষণ এর জন্য দায়ী।  অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে ভূমিকম্প পাথরের কাজকে খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।  ইতিহাসে ইঁদুরের কোথাও উল্লেখ্য করা হয় (কুরআনের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রতিপালকের অকৃতজ্ঞতা প্রদান কারণ যা পূর্বে আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে)।

সেচ ব্যবস্থা বেহাল।  এই সময়ের মধ্যে, মারিব গন্ধরস এবং লোবান বাজারে তার আধিপত্য হারিয়ে পরে।  ধীরে ধীরে শহর হ্রাস পেতে থাকে।  জনসংখ্যা আরবের অন্যান্য অঞ্চলে চলে যায়।

আজ, মারিবে শুধুমাত্র সামান্য গম চাষ হয় এবং বর্ষাকালে জরি, তিল ও বিভিন্ন ধরণের পশুখাদ্য ফসল উৎপন্ন হয়। পুরাতন শহরটি বেশিরভাগই ধ্বংসস্তূপে। কাছাকাছি যে আধুনিক শহরটি উদ্ভূত হয়েছে তা তার পূর্বের স্বভাবের ছায়া মাত্র। এটি প্রাচীনকালের মহান সাম্রাজ্যের রাজসিক গৌরব এবং কল্পিত সমৃদ্ধির একটি শান্ত প্রতিধ্বনি হিসাবে কাজ করে।

(প্রবন্ধটির দ্বিতীয় অংশটি afrinik.com ওয়েবসাইটে ইংরেজি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়। লেখক মূল প্রবন্ধের সঙ্গে প্রথম ভাগে কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি সংযুক্ত করেছেন।)

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter