আমাদের অধঃগতির কারণ: কিছু অপ্রিয় সত্যকথা
উম্মাতে মুসলিমার অধঃপতনের বহুবিধ কারণগুলোর অন্যতম যে উম্মাতের মধ্যে ব্যাপকহারে শির্ক-বিদআত তুল্য কর্মকাণ্ডের প্রচার-প্রসার, তাতে সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা হকের সঙ্গে বাতিলকে মিশিয়ে ফেলতে নিষেধ করেছেন কুরআনুল কারীমের একাধিক সূরায়। উম্মাতে মুহাম্মাদীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ধর্মীয় ব্যাপারে কিতাবধারী ইহুদী নাসারাদের এই শ্রেণীরই বাড়াবাড়ির কারণে তাদের পদস্খলন ঘটেছিল। উম্মাতে মুহাম্মাদীকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআন জানিয়ে দিয়েছে যে, দ্বীন ইসলামকে সমস্ত দৃষ্টিতে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। ইবাদতের নামে, উৎসবের নামে, দুআ-দরূদের নামে এতে নতুনভাবে কোনো কিছুই যুক্ত করার কোনো গুঞ্জায়েশই নেই। কুরআন আল্লাহ তাআলার সর্বোত্তম বাণী এবং প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) এর জীবনাদর্শই মুমিন মুসলিমের জন্য একমাত্র অবলম্বন। দুনিয়া হতে বিদায় হওয়ার আগে বর্তমান ও ভবিষ্যতের উম্মাতকে রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লাম) এই ভাষায় হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন -
'তোমরা আমার কথা ভালোভাবে বুঝে নাও। আমি আমার দায়িত্ব পৌঁছিয়ে দিয়েছি। তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি, যাকে তোমরা যতদিন পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে ধারণ করে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত কিছুতেই পথভ্রষ্ট হবেনা। সে দুটো জিনিস হলো, আল্লাহর কুরআন এবং আমার জীবনাদর্শ।'
বোঝা যাচ্ছে যে, উপরোক্ত দুটি অবলম্বনীয় উপাদান ছাড়া অন্য কোথাও হতে ইবাদত বন্দেগীর নামে অনুপরিমাণও কোনো কিছু সংগ্রহ করা চরম বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা। এরই নাম দ্বীন ইসলামে অবস্থা বিশেষে শির্ক-বিদআত, যার শেষ মঞ্জিল জাহান্নাম। রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) সম্পূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ 'জীবন সিলেবাস' উপহার স্বরূপ প্রদার করার পরে পরেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরে অন্যকিছু মানতে যাওয়ার অর্থই হলো, পরিপূর্ণ দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা। সুরাহ মায়েদার ৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলার সতর্কবাণী-
قُلْ يَاهْلَ الْكِتٰبِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ.
অর্থৎ "বলো, হে আহলে কিতাব। নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে তোমরা অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করোনা এবং সেই লোকদের মন-মর্জির ও কল্পনা-বিলাসের অনুসরণ করোনা, যারা তোমাদের পূর্বে গুমরাহ হয়ে গিয়েছে এবং বহুলোককে পথভ্রষ্ট করে ছেড়েছে তথা 'সাওয়াউস সাবীল' হতে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে।"
কুরআন ও সুন্নাহ: দ্বীনের পূর্ণতা এবং নতুন কিছু যোগ করার শাস্তি
'সাওয়াউস্ সাবীল' এর অর্থ হলো, আল্লাহ প্রবর্তিত মানুষের জন্য জীবন ধারণের সহজ সরল পথ। অর্থাৎ কুরআনের অন্য এক ভাষায় 'সিরাতিম মুস্তাকিম' সঠিক সরল সুদৃঢ় জীবনপথ। উম্মুল কুরআন অর্থাৎ সূরাহ ফাতিহায় আল্লাহ তাআলা এ পথেরই পথিক হওয়ার জন্য মানুষকে সর্বোত্তম প্রার্থনা শিখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন যে, যারা এ পথে চলেছে একমাত্র তাঁরাই কামিয়াব হয়েছে। আর এই সর্বোত্তম জীবন পথের পথিকদের ঐকান্তিক প্রার্থনা হলো - রাহমান ও রাহীম আল্লাহ্ 'আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।'
স্পষ্ট হয়ে গেল যে, দ্বীনে নতুন কিছু যোগ করার অর্থই হলো, 'সিরাতিম মুস্তাকিম' হতে ভিন্ন হয়ে পড়া। নিজে বরবাদ হওয়া, অপরকেও বরবাদ করে ফেলা। এ এক মস্ত ফিৎনা। ফিৎনা মানেই মহাবিপর্যয়। আল্লাহ তাআলারই ভাষায়, 'ফিৎনা হলো নরসংহার হতেও সাংঘাতিক অভিশাপ।' এজন্যই সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাঁর মুমিন-মুসলিম বান্দাহদের এ ভাষায় সতর্ক করে দিয়েছেন।
وَٱتَّقُواْ فِتۡنَةٗ لَّا تُصِيبَنَّ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنكُمۡ خَآصَّةٗۖ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ
অর্থাৎ “এবং দূরে থাকো সেই ফিৎনা হতে, যার অশুভ পরিণাম বিশেষভাবে কেবল সেই মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, তোমাদের মধ্যে যারা পাপকাজ করেছে। আর জেনে রেখো, আল্লাহ বড়োই কঠোর শাস্তিদাতা।'
এ একটা মস্ত সতর্কবাণী। ফিৎনার অশুভ পরিণাম - অর্থাৎ যথোপযুক্ত শাস্তি কেবলমাত্র ফিৎনাকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা মিল্লাত ও উম্মাতকেই অর্থাৎ যারা নির্দোষ ও ভালোমানুষ, তাদেরকেও গ্রাস করে ফেলবে। এটা মহাবিভীষিকাময় কঠোর শাস্তি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, নির্দোষ ভালো মানুষরাও আযাবে-গযবে ফাসবে কেন? এর যথার্থ জবাব দিতেও কুরআনুল কারীম প্রস্তুত রয়েছে।
সূরাহ 'আরাফ-এর ২১ রুকুর প্রথম চারটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে নিষিদ্ধ শনিবারের প্রসিদ্ধ ঘটনাটি। মুসলিমরা ঈমানের দাবি করবে, আর আল্লাহ তাআলা তাদের ঈমান আমলের পরীক্ষা নেবেন না, ইসলাম বলে যে এটা হতে পারেনা। শনিবারীয় পরীক্ষার রূপরেখাটি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন
'... সেখানকার লোকেরা শনিবার দিন আল্লাহর আদেশ নিষেধের বিরুদ্ধে কাজ করতো। ওদিকে মাছ শনিবার দিনই উচ্চ হয়ে উপরিভাগে তাঁদের সম্মুখে আসতো। শনিবার ছাড়া অন্য কোনোদিনই আসতো না। এরূপ এজন্যই হতো যে, আমি তাদের না-ফরমানীর কারণে তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছিলাম।'
এরপরের বয়ান অনুযায়ী, সেই জনপদের ঈমানওয়ালা মানুষরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়- (ক) আল্লাহর নিষেধ সত্বেও মাছ ধরার দল, (খ) নিষিদ্ধ কাজ করতে নিষেধকারীর দল, (গ) নিষিদ্ধ কাজ করতে দেখেও নিষেধ না করার মানুষের দল। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা যে, আল্লাহর আযাব হতে কেবলমাত্র আত্মরক্ষক ও নিষেধকারী দলটিই রক্ষা পেয়েছিল। পূর্ণ হঠকারী ও বিদ্রোহীরা রূপান্তরিত হয়েছিল বানরে, আর নিধেষ না-কারীর দল 'যালিম' ঘোষিত হয়ে অন্য এক আযাবে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। কুরআন মাজীদে বিগত যুগ-যমানার বহু ঘটনা মনোজ্ঞভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং বার বার বলা হয়েছে যে, এসব ঘটনাতে উম্মাতে মুসলিমার জন্য শিখবার অনেক কিছুই মওজুদ রয়েছে।
উপরোক্ত ঘটনাটিতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হলো, নিষিদ্ধ কাজ হতে স্বয়ং বাঁচা এবং সেইসঙ্গে হঠকারী ও বিদ্রোহীদেরও বাঁচাবার চেষ্টা করা। যারা স্বয়ং বাঁচে কিন্তু ডুবন্তকেও বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করেনা, অনীহা উপেক্ষা প্রদর্শন করে, অনুতপ্ত হয়না, বরং মনে প্রাণে উদাসীন, তারা বিশ্বপ্রভুর ভাষায় 'যালিম' এবং সেজন্যই বিদ্রোহীদের সাথে সাথে তারাও তাদের পাপানুযায়ী আযাবেরই অধিকারী। স্বয়ং বাঁচো এবং অন্যকেও বাঁচাবার যথারীতি চেষ্টা করো, ইসলাম এরই নাম দিয়েছে 'আমর বিল মারুফ অন্নাহী আনিল মুনকার।' এ প্রসঙ্গে প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর নির্দেশের সারাংশ হলো, চোখের সামনে মন্দ কাজ হতে দেখলে মুখ দিয়ে, হাত দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা জরুর করতে হবে। অবস্থা বিশেষে এতটা করতে না পারলে অন্ততঃ হৃদয় হতে মন্দকে, মন্দকারীকে ঘৃণা করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি এতটুকুও দায়িত্ব পালন না করে, তবে বুঝতে হবে যে, তার হৃদয়-মন হতে ঈমানের সুগন্ধটুকুও শেষ হয়ে গেছে। ঈমানরূপী মহাদৌলতের সুরক্ষার জন্যই কুরআন ও হাদীসে উপরোক্ত ফরযতুল্য দায়িত্বটির প্রতি মুমিন বান্দাদের বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ্য:
'আমি রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) কে এরশাদ করতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: যখন লোকদের এই অবস্থা হবে যে, তারা মন্দকাজ হতে দেখবে কিন্তু তা পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেনা, যালিমকে যুলুম করতে দেখবে কিন্তু তার হাত ধরবেনা, তখন এটা অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ তাঁর গযব দ্বারা সকলকেই বেষ্টন করবেন। আল্লাহর শপথ, ভালো কাজের হুকুম দেওয়া ও মন্দ কাজ হতে মানুষকে বিরত করা তোমাদের অপরিহার্য কর্তব্য। অন্যথায় আল্লাহ তাআলা তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে খারাপ লোকদেরকে তোমাদের ওপর আধিপত্যশীল রূপে চাপিয়ে দেবেন এবং তারা তোমাদের কঠোর-যন্ত্রণা দেবে। এ অবস্থায় তোমাদের সৎ লোকেরা আল্লাহর দরবারে দুআ করবে, কিন্তু তা কবুল হবেনা।' অতঃপর আর উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে এবারে আমরা আমাদের মিল্লী জীবনের সার্বিক রূপরেখা এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামুহিক সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তার মূল্যায়ন করে দেখতে পারি। ধর্মকর্মের নামে আমাদের সমাজে অজস্র বেদ্বীনি আকীদা আমল যগযুগান্ত ধরে চালু নেই কি?
ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতিতে বিভ্রান্তি
হুসায়েন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং তাঁর নির্দোষ-নিরস্ত্র সঙ্গী সাথীদের (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) বলিদানের ঘটনাটিকে প্রত্যেক বছর উম্মাতে মুসলিমার এক বিরাট অংশ যেভাবে পালন করার রীতি-পদ্ধতি এখতিয়ার করে চলেছে, সেটাকে মুশরিকানা আকীদা তরীকা ছাড়া অন্য কি আর বলা যেতে পারে? ইসলামের ইতিহাসে জান-জীবন বলিদানের এমন বিস্ময়কর ও দুঃখদায়ক ঘটনা আরও বহু রয়েছে। প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) তো কোনোটাকেই এভাবে ইয়াদ করতে পরামর্শ দেননি। শবে বারাত পালনের নামে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে ঘরে ঘরে আলো জ্বালানোর যে রেওয়াজ ও পলে পলে পটকা বাজির যে নমুনা, সবই কি মুশরিকানা আকীদারই অন্ধানুকরণ নয়? মুহাক্রমের ঢোল-বাজনা তো দুর্গাপূজার ঢোল-ঢাককে পরাস্ত করে দিচ্ছে। যারা এসব করেনা বলে অহংকার দেখায়, অন্যদের তুলনায় নিজেদেরকে উত্তমভাবে, তারাও কিন্তু অন্যান্যদের মতই সুদ ঘুষ আত্মসাৎ হতে পরহেজ করেনা। তারা কি জানেনা যে, শরীয়ত গর্হিত কোনো পথ-পদ্ধতির ইবাদত যেমন কবুল হয়না, ঠিক তেমনি হারাম-খানেওয়ালারও দুআ ইবাদত কিছুই কবুল হয়না। দেখা যাচ্ছে যে, যারা শির্ক-বিদআত হতে আত্মরক্ষা করতে সচেতন, তারা কিন্তু অন্যদিকে অর্থাৎ আয়-উপার্জনে হারাম-হালালের তামিজ করতে সতর্ক নয়।
উম্মাহর তিন শ্রেণি: কে কোথায় দাঁড়িয়ে?
সাফ কথা, গোটা উম্মাত একালেও মোটামুটিভাবে তিনভাগে বিভক্ত। বানর হয়ে যাওয়াদের মতনই আমাদেরও একটা দল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর আদেশ নিষেধ মান্য করার ব্যাপারে পুরোপুরি বিদ্রোহী বেপরোয়া। দ্বিতীয় দলটি এদের কুকর্মের ব্যাপারে মৌন খামোশ, অথবা এদের ডরে ভয়ে গোপনে গোপনে সাহায্যকারী। তৃতীয় দলটিতে প্রকৃত সমাজসুধাকররা রয়েছেন যাঁদের সংখ্যা ও প্রভাব প্রতিপত্তি নিশ্চিতভাবেই অত্যল্প। অত্যল্প এই কারণে যে, বিগত কয়েক শ' বছর হতে আমাদের ওলামায়ে দ্বীন ও অন্যান্য দ্বীনদার ব্যক্তিবর্গ নানা মতভেদ ও মনোভেদ বশতঃ বহু অবাঞ্ছিত দলে-উপদলে বিভক্ত। স্বসমাজের সংশোধনের জন্য প্রয়োজন হয় সুপরিকল্পিত কার্যক্রমে সমস্ত শ্রেণীর সত্যনিষ্ঠ মানুষদের অবিচল আস্থা বিশ্বাস ও একতা। হকপন্থী মানুষরাই যেখানে নিজেদের সংকীর্ণতা অনুযায়ী মাসজিদ, মাদ্রাসা ও পাক কালামের তাফসীর তর্জমা এবং রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর হাদীসকে, এমনকি দ্বীনি সংগঠনগুলোকেও যথেচ্ছভাবে ভাগাভাগি করে নিয়েছে, সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে বাতিলপন্থীদের মোকাবিলা করা যেতে পারে কি? আসল কথা, হক-এর স্বভাব টিকে থাকা আর বাতিলের স্বভাব মিটে যাওয়া কিন্তু শর্ত এই যে, হকপন্থীদের মধ্যে একতা ও একাগ্রতা অত্যাবশ্যক। এর অভাবে হক ও হকপন্থীরা দুর্বল হতে বাধ্য। এজন্যই আল্লাহ তাআলা সাবধান বাণী শুনিয়েছেন一
وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَنَٰزَعُواْ فَتَفۡشَلُواْ وَتَذۡهَبَ رِيحُكُمۡۖ وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّـٰبِرِينَ
অর্থাৎ "আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ করোনা। অন্যথায় তোমাদের মধ্যে দুর্বলতার সৃষ্টি হবে এবং তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি শেষ হয়ে যাবে। ধৈর্য সহকারে সব কাজ আঞ্জাম দাও। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন" (৮:৪৬)।
মিল্লাতের দ্বীনদার ব্যক্তিবর্গ একালে বহুধা বিভক্ত এবং তাঁদের শীর্ণজীর্ণ এভাব প্রতিপত্তি নিজ নিজ মাসলাক মাযহাব ও দলমতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদিও যাবতীয় মতভেদ ও মনোভেদের মীমাংসার পথ-পদ্ধতির ইসারা সূরাহ আন্ নিসার ৫৯ নং আয়াতে এবং সূরাহ আল্ হাশরের ৭ নং আয়াতে সুস্পষ্টভাবে মওযুদ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُوا۟ ٱلرَّسُولَ وَأُو۟لِى ٱلْأَمْرِ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَـٰزَعْتُمْ فِى شَىْءٍۢ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌۭ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসূলের এবং সেইসব লোকদের যারা তোমাদের মধ্যে সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো ব্যাপারে মত বৈষম্য দেখা দেয়, তবে মনোভেদকে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ ও রাসূলের দিকে, - যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহভীরু ও পরকাল বিশ্বাসী হয়ে থাকো। এটাই সঠিক কর্মনীতি ও শেষ পরিণতির পক্ষে উত্তম” (৪:৫৯)। আল্লাহ বলেন-
وَ مَا أَتْكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَتَكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.
অর্থাৎ "রাসূল তোমাদেরকে যা কিছু দান করেন তা তোমরা গ্রহণ করো আর যে-সব হতে তোমাদের বিরত রাখেন, তা হতে তোমরা-পরহেয করো। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা” (৫৯:৭)।
আমাদের সম্মানীয় ওলামায়ে দ্বীন খুব ভালোভাবেই অবগত যে, কুরআন এবং হাদীসে ঐক্যানুভূতি ও সঙ্ঘবদ্ধতার সমস্ত সুশিক্ষা বর্তমান, প্রয়োজন কেবল 'অ-ম্যায় ইউকা সুহহা নাফসিহী ফা-উলায়িকা হুমুল মুফলিহুন।'
দিলকে দরিয়া বানিয়ে দিলেই কল্যাণ ও সাফল্য মুঠির মধ্যে এসে যাবে, ইন্শাআল্লাহ। এক আধটু নগন্য স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও কি আমরা বাতিলের যথার্থ মোকাবিলার জন্য ইসলামী ঐক্যানুভূতি ও সঙ্ঘবদ্ধতা গড়ে তুলতে পারিনা? যদি না পারি তবে আমাদের মনে রাখা কর্তব্য যে, আল্লাহর অটল বিধানানুযায়ী উম্মাতের ওপর এমনও আযাব গযব আসতে পারে, যা কেবল পাপী মুসলিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, গোটা উম্মাতকেই তার দুফল ভোগ করতে হবে। দুনিয়ার যত্রতত্র হয়েও চলেছে সেটাই। আমরা এখন জনসংখ্যায় ও মালে দৌলতে বিরাট বিপুল হওয়া সত্বেও ইহুদী-নাসারা-মুশরিক ও নাস্তিকদের তল্পীবাহক নয়তো কি? ওদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিনা কি?
উপসংহার: আত্মবিশ্লেষণ ও প্রত্যাবর্তনের আহ্বান
সত্যের খাতিরে আজ আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের মধ্যে শির্ক-বিদআত, হারামখোরী, নিন্দা-কুৎসা, মতভেদ-মনোভেদ ইত্যাদি যে সকল সাংঘাতিক পাপ বিপুলভাবে চালু রয়েছে, সবেরই মূলে নিহিত রয়েছে পবিত্র কুরআন-হাদীসের নির্ভেজাল সুশিক্ষাকে জ্ঞানতই অস্বীকার করে কম-বেশী আত্মপূজায় মগ্ন হওয়া। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন, - আমীন।