সমস্ত কেরালা জামিয়াতুল উলামা কেরালার সুন্নি আকীদার উদ্ধার
নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র যুগেই ইসলাম ধর্মের জাহাজ প্রথম কেরালার উপকূলে এসে ভিড়েছিল। ইয়েমেন, আরব দেশসহ মুসলিম এলাকা থেকে অনেক মানুষ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই সবুজ উপকূলে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে তারা কেরালায় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং এক ধরনের জ্ঞানবিপ্লব ঘটান। সাধারণ মানুষের জ্ঞান ও শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তারা দারস (ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র), ওথুপল্লি (ধর্মীয় শিক্ষার মাদ্রাসা) ইত্যাদি বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং এর মাধ্যমে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জাইনুদ্দিন মাখদুম, মম্পুরম থাঙ্গাল, উমর ক্বারী প্রমুখ বহু বিশিষ্ট আলেম ও পণ্ডিতের মাধ্যমে এই ঐতিহ্য পরবর্তীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আঠারো শতকের দিকে যখন বিদেশি শাসকরা ভারতকে দখলে নেয়, তখন ভারতীয় মুসলিমদের দৃষ্টি তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরোধের দিকে চলে যায়। কিন্তু সেই প্রতিকূল সময়েও তারা তাদের প্রাপ্ত বিশ্বাস ও ধর্মীয় চর্চাগুলো আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সেগুলোর সংরক্ষণ ও প্রচারে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
ঐক্যসংঘ এবং পাণ্ডিত্যধারার সংঘাত
মালাবার বিদ্রোহে অংশগ্রহণের অভিযোগে গ্রেফতারের ভয়ে কে. এম. মৌলভি কোডুঙগল্লুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কিছু পারিবারিক সমস্যা মীমাংসার উদ্দেশ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে একটি ছোট সংগঠন গঠন করেন। এই দলের মূল সদস্য ছিলেন ভাক্কম মৌলভি, এম. সি. সি. মৌলভি, টি. কে. মুহাম্মদ মৌলভি এবং স্বয়ং ভাক্কম মৌলভি। ভাক্কম মৌলভি ‘আল-মনার’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন, যেটি রশীদ রেজা সম্পাদিত ছিল। তিনি সেই পত্রিকায় প্রচারিত চিন্তাধারা কেরালায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই সংগঠনটিকে ব্যবহার করেন। ১৯২৩ সালে ঐক্যসংঘ তাদের প্রথম সম্মেলন আয়োজন করে, যেখানে এই সব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ্যে আসে। তখনই অনেক আলেম ও ধর্মীয় পণ্ডিতের কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়। এই বিরোধিতা কাটিয়ে উঠতে এবং জনসাধারণের সমর্থন পাওয়ার জন্য তারা ১৯২৪ সালে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। তারা কেরালার অনেক পণ্ডিতদের গুরু ও ভেল্লুরের ‘বাকিয়াতুস সালিহাত’ মাদ্রাসার প্রধান আবদুল জব্বার হজরতের কেরালায় আমন্ত্রণ জানায়। সেই সময় তারা আলুয়ায় দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করে। হজরতের উপস্থিতিকে সামনে রেখে তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালায়। এতে ধর্মীয় পণ্ডিতদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয় এবং তারা অনুভব করেন যে এই নতুন ধারার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।
১৯২৫ সালে ঐক্যসংঘ তার তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন কোঝিকোডের হিমায়াতে আয়োজন করার পরিকল্পনা করে। এই ঘোষণার পরেই ধর্মীয় পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে ঐক্যসংঘের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা শুরু হয়। এই বিরোধিতার অগ্রভাগে ছিলেন প্রখ্যাত আলেমরা — আহমদ কোয়া শালিয়াথি, পাঙ্গিল আহমদ কুট্টি মুসলিয়ার, আচিপ্রা কুঞ্জি মুহাম্মদ মুসলিয়ার এবং পল্লিপুরম আবদুল কাদের মুসলিয়ার প্রমুখ।
তাঁরা কোঝিকোডে অনুষ্ঠানের স্বাগত কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং হিমায়াতের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঐক্যসংঘের মতাদর্শ সম্পর্কে সাবধান করে দেন এবং এই বিষয়ে জনগণকেও সচেতন করেন। অন্যদিকে, ঐক্যসংঘের বিপক্ষে একটি সুসংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পণ্ডিতরা ‘ভারাক্কল মুল্লা কোয়া থাঙ্গালের’ বাসভবনে একত্র হয়ে গভীর আলোচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় কোঝিকোড জুমার মসজিদে একটি পণ্ডিত সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এই সম্মেলনে কে. পি. মুহাম্মদ মীরান মৌলভিকে সভাপতি এবং পারোল হুসাইন মৌলভিকে সম্পাদক করে একটি নতুন পণ্ডিত সংগঠন গঠন করা হয়। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল— ঐক্যসংঘের বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত মতাদর্শগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং 'সুন্নত জামাআতের' সঠিক বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া। তারা সিদ্ধান্ত নেয় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা কর্মসূচি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সেইসঙ্গে কোঝিকোড টাউন হলে একটি বৃহৎ আলেম সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়।
এই আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন পাঙ্গিল আহমদ কুট্টি মুসলিয়ার। প্রথমেই তিনি তাঁর শায়েখ তথা গুরু, ভালাকুলামের কোয়া মুটি মুসলিয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মহান সেই ব্যক্তি সংগঠন গঠনের জন্য পূর্ণ সমর্থন জানালেও, বয়সের কারণে নিজে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে জানান। পরিবর্তে তিনি বলেন, তাঁর ছেলে আবদুল বারি মুসলিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে। এরপর আবদুল বারি মুসলিয়ার আহমদ কুট্টি মুসলিয়ারের সঙ্গে একত্রে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যোগ দেন। তারা কেরালার বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ দারস বা ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র সফর করে, সেখানকার আলেমদের আন্দোলনের সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পানাাইকুলামের পুথিয়াপ্পিল আবদুর রহমান মুসলিয়ার ও মুহাম্মদ মীরান মুসলিয়ার। তখনকার সময়ে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি প্রকাশ্যে আসতে দ্বিধা বোধ করতেন। তাদের জনসমক্ষে এনে, সময়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে রাজি করাতে অনেক পরিশ্রম ও চেষ্টা করতে হয়েছিল।
সমস্ত কেরালা জামিয়াতুল উলামা প্রতিষ্ঠা
১৯২৬ সালের ২৬শে জুন (হিজরি ১৩৪৪, যুল-হিজ্জা ১৫) একটি ঐতিহাসিক সম্মেলনের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হয়। সায়্যিদগণ ও আলেমরা দূরদূরান্ত থেকে কোঝিকোডে একত্রিত হন। বহু জ্ঞানী ও মর্যাদাসম্পন্ন পণ্ডিতদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান অত্যন্ত গৌরবজনকভাবে শুরু হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সায়্যিদ আবদুর রহমান বাফাখি থাঙ্গালের মামা সায়্যিদ হাশিম চেরুকুঞ্জি কোয়া থাঙ্গাল। কেরালায় বিভ্রান্তিকর ও বিভাজনমূলক নতুন মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে, এই সভায়ই গঠিত হয়েছিল এক মহান সংগঠন— সমস্ত কেরালা জমিয়াতুল উলামা। এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন সায়্যিদ বাআলভি ভরক্কল মুল্লা কোয়া থাঙ্গাল। সহ-সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন পাঙ্গিল আহমদ কুট্টি মুসলিয়ার, ভালাকুলাম আবদুল বারি মুসলিয়ার, এবং তিরুআল্লির কে. পি. মুহাম্মদ মীরান মুসলিয়ার। সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন পল্লিবাড়ি মুহাম্মদ মুসলিয়ার। যুগ্ম সম্পাদক হন ভি. কে. মুহাম্মদ মাওলভি এবং জার্মান আহমদ মুসলিয়ার। এছাড়াও, ৪০ জন বিশিষ্ট আলেম ও পণ্ডিতকে মুশাওয়ারা (পরামর্শ পরিষদ) সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। যেহেতু এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন সর্বজনসম্মানিত আলেমগণ, তাই কেরালার মুসলিম সমাজ অত্যন্ত আন্তরিকভাবে ‘সমস্ত’কে গ্রহণ করে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই এই সংগঠন এমন এক বিশাল অবস্থানে পৌঁছায় যে, কোনো পরিচয় ছাড়াই প্রতিটি মালয়ালি মুসলিমের কাছে তার নাম ও মর্যাদা সুপরিচিত হয়ে ওঠে।
১৯২৬ সালে গঠিত এই সংগঠন ১৯৩৪ সালে একটি সরকারিভাবে লিখিত গঠনতন্ত্র (সংবিধান) তৈরি করে। সেই গঠনতন্ত্রের "উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য" অংশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়—"পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের প্রকৃত মত ও বিধান অনুসারে প্রচার ও বিস্তার করা।" সংগঠনের শুরু থেকেই এই লক্ষ্যপূরণে সমস্ত বিভিন্ন দিক থেকে দৃঢ়, সময়োপযোগী ও বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং কেরালার মুসলমানদের সামনে তা বাস্তব রূপে উপস্থাপন করে আসছে। এক শতাব্দী পূর্ণ করতে চলা এই বিশাল কার্যক্রমকে আমরা চারটি মূল বিভাগে ভাগ করে দেখতে পারি।
প্রথম পর্যায় (আদর্শ একত্রীকরণ) সমস্থ কেরালা জামিয়াতুল উলামা হল মালয়ালমভাষী অঞ্চলের মূলধারার মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি আন্দোলন। বিদআতের সমর্থকরা যখন ইসলামী সংস্কৃতির উপর তাদের ডানা মেলে ধরেছে, তখন মূলধারার মুসলমানরা সর্বদা ইসলামী সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। ইমাম আশ'আরী (রহ.) আহলুস-সুন্নাহর পক্ষে লড়াই করতে এগিয়ে এসেছিলেন যখন মুতাজিলা উম্মাহর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যখন আহলেহাদ ও দেওবন্দবাদ উত্তর ভারতে তাদের অপবিত্রতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন আ'লা হযরত সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করেছিলেন এবং সুন্নি আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন। যখন আইক্যা সংঘ জনগণের মনে বিদআতের বিষাক্ত বীজ রোপণের চেষ্টা করেছিল, তখন এখানকার আলেমরা সমস্থ কেরালা জামিয়াতুল উলামা সংগঠিত ও গঠন করেছিলেন। অতএব, সংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়টি মূলত আদর্শকে শক্তিশালী করা এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরকে রক্ষা করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল।
প্রথম দিকে, সমস্ত সংগঠন তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য মূলত বিভিন্ন সম্মেলনের মাধ্যমে কাজ করত।
১৯২৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি তানুরে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর একই বছরের ৩১শে ডিসেম্বর মোল্লুরে দ্বিতীয় সম্মেলন এবং ১৯২৯ সালের ৭ই জানুয়ারি ভল্লাপ্পুঝা চেম্মনকুঝিতে তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই তৃতীয় সম্মেলনেই সংগঠনের নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘আল বায়ান’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৩০ সালের ১৭ই মার্চ মান্নারকাডে চতুর্থ সম্মেলন এবং ১৯৩১ সালের ১১ই মার্চ ভেলিয়ানচেরিতে পঞ্চম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৩৩ সালের ৫ই মার্চ ফারোকে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বার্ষিক সম্মেলনটি সমস্ত কেরালার ইতিহাসে নানা দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত আলেম মাওলানা শিহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াথি। এই সম্মেলন বানচাল করার জন্য ওহাবি মতাদর্শের অনুসারীরা নানা কৌশল নিয়েছিল। তারা ১৯৩৩ সালে ‘কেরালা জমিয়াতুল উলামা’ নামে একটি সংগঠন গঠন করে সরকারিভাবে রেজিস্টার করিয়েছিল। এরপর তারা দাবি করে যে, তাদের অনুমতি ছাড়া ফারোকে ‘কেরালা জমিয়াতুল উলামা’ নাম ব্যবহার করে সভা করা বেআইনি এবং এই অভিযোগে তারা আইনি নোটিশ পাঠায়। তবে তারা যে নোটিশ পাঠায় তাতে ‘সমস্ত’ শব্দটি ছিল না, বরং শুধুমাত্র ‘কেরালা জমিয়াতুল উলামা’ উল্লেখ ছিল। এই কারণে, সুন্নি পক্ষ থেকে জবাব দিয়ে জানানো হয় যে, ফারোকের সম্মেলনটি হচ্ছে ‘সমস্ত কেরালা জমিয়াতুল উলামা’-র অন্তর্ভুক্ত, যার ‘কেরালা জমিয়াতুল উলামা’ নামে গঠিত সংগঠনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এই শক্ত জবাবের পর, ওহাবি পক্ষকে পিছু হটতে হয়।
এই সম্মেলনটি ছিল অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচিত ও মনোযোগ আকর্ষণকারী। সম্মেলনের প্রথম প্রস্তাবটি ছিল ওহাবিদের সম্মেলন বানচাল করার চেষ্টার তীব্র নিন্দা জানিয়ে। তৃতীয় প্রস্তাবে ‘হীলাতুর রিবা’ নামে পরিচিত পদ্ধতির মাধ্যমে সুদকে হালাল করার জন্য ঐক্যসংঘের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে তুলে ধরা হয়। চতুর্থ প্রস্তাবে পরিষ্কারভাবে জানানো হয় যে, কাদিয়ানিরা মুসলিম নয় এবং তাদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া অথবা মুসলিম কবরস্থানে তাদের দাফন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাদিয়ানিরা মুসলিম নয়—এই ঘোষণা ১৯৬৯ সালে সৌদিতে অবস্থিত মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ প্রকাশ্যে দেয়। একই বছরে পাকিস্তানের জামশাদাবাদ সিভিল কোর্টও তাদের অমুসলিম ঘোষণা করে রায় দেয়। অথচ ‘সমস্ত’ ১৯৩৩ সালেই কাদিয়ানিবাদ ইসলাম বহির্ভূত বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে এই সংগঠন মুসলিম বিশ্বে অনেক আগেই স্পষ্ট ও নির্ভুল অবস্থান গ্রহণ করেছিল, যা কোনও অতিরঞ্জন নয়।
পঞ্চম প্রস্তাবে বলা হয়, মাদ্রাসাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের সচেতন করা দরকার, কারণ নতুন মতাদর্শের লোকজন এসব ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করছে। ষষ্ঠ প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ইবনে হাসান, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কায়্যিম, ইবনে আবদুল ওহহাব, জামালউদ্দিন আফগানি, মুহাম্মদ আবদু, রশীদ রিদা প্রমুখদের সম্পর্কে পূর্ববর্তী ইসলামী পণ্ডিতদের দেওয়া ফতোয়া ও সিদ্ধান্তগুলি পড়াশোনা এবং শিক্ষাদান পরিহার করা, যাতে তাদের মতাদর্শের বিপদ তুলে ধরা হয়েছে। সপ্তম প্রস্তাবে সমস্তর কর্মকাণ্ডে যিনি দীর্ঘদিন সহায়তা করে আসছিলেন সেই মান্নারক্কাড কাল্লাডি মোয়িত্তুট্টি সাহেবের মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করা হয়। সম্মেলনের সভাপতি শালিয়াথি নিজেই পেশ করেন অষ্টম প্রস্তাব, যেখানে সুন্নি ও অসুন্নি মুসলমানদের মাঝে একটি স্পষ্ট ভেদরেখা টানা হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়: “কেরালার মুসলমানদের মধ্যে বহু বছর ধরে চালু থাকা এবং বর্তমানে চলমান যেসব ধর্মীয় রীতিনীতি নিচে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলেমগণের মতে শরিয়াহ-সম্মত এবং কেউ যদি এগুলোকে ধর্মবিরোধী বা শিরক বলে দাবি করে, তবে তারা সুন্নি নয়। সেইসঙ্গে তারা ইমাম, খতীব ও ক্বাজীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পদগুলোর জন্য যোগ্যতর নয়।—এই সম্মেলন যে সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করা হয় তা হলো:
১. প্রিয়নবী, আউলিয়া, সৎলোক ইত্যাদিদের মর্যাদা, অবস্থান, অধিকার, বরকত ইত্যাদি মাধ্যমে তাওয়াস্সুল (অর্থাৎ তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করা) করা, তাঁদেরকে সরাসরি ডেকে সাহায্য চাওয়া, তাঁদের নাম ধরে আহ্বান করা, এবং তাঁদের ব্যবহৃত বস্তু বা নিদর্শন দ্বারা বরকত লাভের চেষ্টা করা।
২. প্রিয় নবী, অলিয়া ও অন্যান্য মুসলমানদের জন্য সওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করা, মানত করে মুরগি, ছাগল ইত্যাদি কুরবানি দেওয়া, তাঁদের জন্য কুরআন তেলাওয়াত করা ও পড়ানো, মুসলিম প্রিয় ব্যক্তিকে দাফনের পর কবরে বসে তালকীন (অর্থাৎ ঈমান ও প্রশ্নোত্তর শেখানো) পাঠ করা এবং অন্যান্য স্থানে বসে কুরআন পড়া বা পড়ানো।
৩. কবর যিয়ারত করা, কবরবাসীদের সালাম দেওয়া, তাঁদের জন্য দোয়া করা এবং তাঁদের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা।
৪. কুরআনের আয়াত, হাদীস, এবং অন্যান্য পবিত্র নাম ব্যবহার করে ঝাড়ফুঁক করা, তাবিজ লেখা ও বেঁধে দেওয়া, দড়ি বা পানি তদবীর করে দেওয়া, ‘বুর্দা’ কাব্য পাঠ করে ঝাড়ফুঁক করা।
৫. কাদেরিয়া, শাজিলিয়া, রিফাইয়া ইত্যাদি সহীহ তরীকাগুলোর যোগ্য ও সত্য শায়েখদের মাধ্যমে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করা, একা কিংবা সম্মিলিতভাবে বৈঠকে বসা, ‘রাতীব’ (ধর্মীয় পাঠ) পালন করা, তরীকার যিকরসমূহ পাঠ করা, দালাঈলুল খায়রাত, হিজবুন্নববী, আসমাউন্নবী, আসমাউল বাদরিয়্যীন, হিজবুল বাহর ইত্যাদি ধর্মীয় গ্রন্থ ও যিকরসমূহ পাঠ করা, এবং যিকর গণনার জন্য তসবিহ মালা ব্যবহার করা।
৬. ‘মনকূস’ প্রকারের মাওলিদ পাঠ করা, বদরিয়্যতুল বায়ত, বদর মাল, মুহিয়্যুদ্দীন মাল, রিফাই মাল ইত্যাদি মানতের গজল বা ভক্তিমূলক গান পাঠ করা এবং গাওয়া।
এর পাশাপাশি আরও নানা প্রস্তাব ও বিষয়বস্তু দিয়েও ফারোক সম্মেলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মনোযোগ আকর্ষণকারী। প্রতিটি সময়ে যখন নতুন নতুন মতবাদ ও চিন্তাধারা সামনে আসে, তখন ধর্ম (দীন)-এর প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের সামনে তুলে ধরা ছিল প্রতিটি সম্মেলন ও তার প্রস্তাবগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য। এই সত্যই প্রতিফলিত হয়েছে সপ্তম সম্মেলনে শালিয়াথি উপস্থাপন করা অষ্টম প্রস্তাবে। এভাবেই প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি প্রস্তাব এবং কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘সমস্ত’ তার দায়িত্ব পালন করে এসেছে। এই কারণেই, প্রতিটি প্রস্তাব সাধারণ মানুষ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করত, কারণ তারা জানত—এগুলি সদাচারী ও বিশ্বস্ত আলেম সমাজের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসেছে।
সমস্ত কেরালার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হলো সংগঠনের ষাটতম বার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মহা-সম্মেলন। ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১, ২ এবং ৩ তারিখে, "ভরক্কল মুল্লা কোয়া থাঙ্গাল নগর" নামে নামকরণ করা সম্মেলন শহরে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ লাখের কাছাকাছি মানুষ সেখানে একত্রিত হয়ে যেন নতুনবাজার (পুতিয়াঙ্গাড়ি) এলাকায় এক ‘দুধের সাগর’ সৃষ্টি করেছিল। আলেম সমাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, ‘সূর্যের মতো দীপ্তিমান’ বলে খ্যাত ‘শামসুল উলামা’ (রহ.)-এর ভাষণ ছিল সেই সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ জনগণের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সেই ভাষণের একটি অংশ নিচে উপস্থাপন করা হচ্ছে:
"হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরে যদি কোনো নবী আসতে হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে শরিয়তসহ আসতে হবে। শরিয়ত ছাড়া কীসের নবী আসবে? কিসের ভিত্তিতে কেউ নবী বলে দাবি করতে পারে? কেউ যদি বলে নবী আছে, কিন্তু শরিয়ত নেই—তাহলে তার মানে কী দাঁড়ায়? এ কারণেই আমরা নতুন নবুওয়তের দাবিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি। শুধু প্রত্যাখ্যান করাই নয়, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা খাদিয়ানিবাদ এবং সেই জাতীয় অন্য সব নবুওয়ত দাবিকেও আরব সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি।"
নতুন ধরনের বিদআত ও বিভ্রান্তিকর মতবাদ যখনই সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখনই ‘সমস্ত’ সাহসের সঙ্গে তার সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে এবং সমাজকে সঠিক পথে ধরে রাখতে সামনে এগিয়ে এসেছে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলাপ্পুঝায় অনুষ্ঠিত ৯০তম বার্ষিক সম্মেলনসহ—এ পর্যন্ত ‘সমস্ত’ এই রকম ২৮টি বৃহৎ সম্মেলন আয়োজন করেছে। আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা রাখার প্রথম পর্যায় অতিক্রম করে, যখন সংগঠন অন্যান্য অগ্রগতিমূলক পরিকল্পনার দিকে এগিয়ে যায়, তখনও এই বিষয়ে সমস্ত সব সময়ই প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলন ও তরিকা (আধ্যাত্মিক পথ) বিশ্লেষণ করে জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব সমস্ত সবসময় গুরুত্বসহকারে পালন করে এসেছে।
কোরূর, চোট্টূর, শামসিয়া ইত্যাদি আন্দোলনের প্রকৃত রূপ উন্মোচন করা এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত মুশাওয়ারার সভায় হায়দ্রাবাদ থেকে আগত নুরিশা তরিকার আধ্যাত্মিক শোষণের দিকটি তুলে ধরে সমাজকে সতর্ক করা, এই দায়িত্ববোধেরই অংশ ছিল। বহু বছর আগে, ইউসুফ সুলতান নামক একজন ব্যক্তি আলুয়া থেকে আত্মিক ব্যবসা নিয়ে সামনে আসেন। তখনও সমস্ত তাদের বিভ্রান্তিমূলক কার্যকলাপ শনাক্ত করে, ২০০৬ সালের ২৯ মার্চ ঘোষণা করে যে আলুয়া তরিকা ভুয়া এবং তা মুসলিম সমাজ থেকে সতর্কতার সঙ্গে বর্জন করা উচিত। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতা ও দুরবস্থা দূর করতে ১৯৬৪ সালে যখন মুসলিম এডুকেশনাল সোসাইটি (এম.ই.এস) গঠিত হয়, তখন সমস্ত সংগঠনটি সমর্থন করেছিল। কিন্তু পরে কিছু ধর্মীয় সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব থাকা ব্যক্তি এর নেতৃত্বে প্রবেশ করে শরিয়তের বিরুদ্ধে কথা বলতে ও উপহাস করতে শুরু করে। এই অবস্থায় ধর্মের রক্ষাকারী হিসেবে পণ্ডিতদের এই সভা—সমস্ত—এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ২৭শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত সমস্তর মুশাওয়ারা সভায় এম.ই.এস-এর শরিয়ত-বিরোধী কার্যকলাপ নিয়ে সমাজকে সচেতন করা হয় এবং তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলা হয়।
সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থা একটি সমাজকে পশ্চাৎপদ করে দেয়—এই ঐতিহাসিক সত্যকে উপলব্ধি করেই সমস্ত উগ্রপন্থী সংগঠনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের জন্য এগিয়ে আসে। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে কলুষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা কাজে লাগিয়ে সমাজে উগ্র চিন্তাধারার বীজ বপন করার চেষ্টা কিছু লোক করে। তখন সমস্ত ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো সাহসের সঙ্গে সেই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এই ধরণের কিছু কঠিন সিদ্ধান্তের কারণে সংগঠনের পক্ষে কিছু ক্ষতি হলেও, সমস্ত তা ত্যাগ করে এগিয়ে যায়—কারণ, গোটা উম্মাহ্র (মুসলিম সমাজের) নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। খুব শীঘ্রই এই অবস্থান যে সঠিক ছিল, তা সমাজের মঙ্গল ও কল্যাণ চাওয়া সকলেই স্বীকার করে নেয়।
সংলাপসমূহ
আদর্শে স্থিরতা আনতে বা তা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমস্ত যে এক গুরুত্বপূর্ণ পন্থা গ্রহণ করেছিল, তা ছিল— সংলাপ বা বক্তৃতাভিত্তিক বিতর্ক। সংগঠন গঠনের পরবর্তী প্রাথমিক সময়ে বিশেষ করে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক বা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
কোঝিকোড সংলাপ
সমস্ত কেরালার ব্যানারে অনুষ্ঠিত প্রথম সংলাপটি হয় কোঝিকোডে। এই সংলাপের উদ্দেশ্য ছিল— কেরালায় ওহাবি ভাবধারার প্রতিনিধিত্বকারী ঐক্যসংঘের প্রকৃত অবস্থান সমাজের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। ঐক্যসংঘের পক্ষে ছিলেন মনাপ্পাড় কুঞ্জ আহমদ হাজি, কে. এম. সিথি সাহেব এবং ই. কে. মৌলভি, যারা একত্র হয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। অপরপক্ষে ছিলেন আহমদ কোয়া শালিয়াথির নেতৃত্বাধীন সমস্ত কেরালার দল। এই সংলাপে দুই পক্ষের মধ্যে মতভেদগুলো উন্মোচিত হয়।
নাদাপুরাম সংলাপ
মুজাহিদ ও সমস্ত কেরালার মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় একটি ছিল নাদাপুরামে। ১৯২১ সালের মালাবার বিদ্রোহের পর মুজাহিদ চিন্তাধারার একজন প্রচারক আবদুল্লাকুট্টি মৌলভি কুট্টিয়াদি এলাকায় আসেন এবং সেখানে বিদআতের (ধর্মে নবউদ্ভাবিত প্রথা) প্রচার শুরু করেন। বিষয়টি ঐ অঞ্চলের আলেমদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এবং তাঁরা এর বিরুদ্ধে সরব হন।
একটি অনুষ্ঠানে, তাঁর বক্তৃতার সময়, শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মরুথোঙ্গারা ক্বারী, যিনি কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কিন্তু বক্তা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে পুরো বক্তব্য থামিয়ে দেন। এরপরই সেখানে একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল "ইস্তিগাসা" (আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া) ও "তাওয়াস্সুল" (নবী বা অলির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দোয়া করা)। সেই সংলাপের পর এলাকার জনগণ প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
কোডিয়াথুর বিতর্ক
তরাবির নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে সংগঠিত একটি আলোচনার নাম এই বিতর্ক। এই আলোচনা তৈরি হয় তখন, যখন মুজাহিদ নেতা পরপ্পুর আবদুর রহমান মাওলভি মুসলিম সমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ও সর্বজনগ্রাহ্য বিশ রাকাত তারাবির নামাজকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। কেরালা জামঈয়াতুল উলামা নামে পরিচিত এক ওহাবি আলেম সংগঠনের নেতারা, বিশেষ করে ই. কে. মাওলভি ও এম. সি. সি. আবদুর রহমান মাওলভি, তাদের বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে এই মতবাদ প্রচার করছিলেন। এর প্রেক্ষিতে, সুন্নি মতাদর্শের পক্ষে রইসুল মুহাক্কিকিন কণ্ণিয়থ আহমদ মুসলিয়ার (রহ.) এবং পারাভন্না মুহিউদ্দিন কুট্টি মুসলিয়ার (রহ.) সক্রিয়ভাবে সামনে আসেন। অপরদিকে, মুজাহিদ পক্ষের হয়ে মাঠে নামেন এম. সি. সি. আবদুর রহমান মাওলভি এবং পরপ্পুর আবদুর রহমান মাওলভি। বিতর্কটি শুরু হয় এই দাবির ভিত্তিতে যে, তরাবির নামাজ আট রাকাতই হওয়া উচিত। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিতর্কে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, তরাবির রাকাত সংখ্যা বিভিন্ন হতে পারে—এই বক্তব্য বিরোধীপক্ষকেই স্বীকার করে নিতে হয়।
কার্যাবট্টম ও মীঞ্চান্দ বিতর্কপ্রচেষ্টা
কার্যাবট্টমে অনুষ্ঠিত সমস্তর ১৬তম বার্ষিক সম্মেলনের প্রেক্ষিতে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওহাবিরা সেখানে একটি বিতর্ক সভা আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু বিতর্কমঞ্চের নিয়মিত মুখ পাঙ্গিল আহমদ কুট্টি মুসলিয়ার তখন অসুস্থ ছিলেন, ওহাবিরা ধরে নিয়েছিল যে বিরোধীপক্ষ দুর্বল, তাই সহজেই জয়লাভ করা সম্ভব হবে। এমন পরিস্থিতিতে, ওহাবি বাগ্মী এক বিকৃত মতাদর্শে ভরপুর বই লেখেন যার নাম ছিল আত্তাওহীদ। তার জবাবে সমস্তর নেতা মূসা মুসলিয়ার আল-খওলুস সাদীদ ফি রাদ্দিত্-তাওহীদ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
এই পাল্টা জবাব প্রকাশের পর, ওহাবিরা বুঝে যায় তাদের পরিকল্পিত জয় এতটা সহজ হবে না। তারা ধীরে ধীরে সেই বিতর্ক থেকে পিছু হটে যায়। পরে, সমস্তর পক্ষ থেকে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয় যে, তারা ১৭তম বার্ষিক সভায় বিতর্ক করার জন্য মঞ্চ নির্ধারণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু ওহাবিরা নানা অজুহাত দেখিয়ে সেই বিতর্কে অংশ না নিয়ে পিছিয়ে যায়।
পূনুর বিতর্ক:
সুন্নি মতবাদের প্রচারে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনকারী পতি আবদুল কাদের মুসলিয়ার পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিতর্ক ছিল এটি। হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই বিতর্কে তাওয়াসসুল (মধ্যস্থতা) এবং ইস্তিগাসা (আল্লাহ ছাড়া অন্যের সাহায্য প্রার্থনা) বিষয়ে তীব্র তর্ক-বিতর্ক হয়। এই বিতর্ক এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, তা মুজাহিদ মতাদর্শের ভেতরেও বিভ্রান্তি ও মতানৈক্যের সৃষ্টি করেছিল। এছাড়াও, সমস্ত তার স্থির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, সকল বিভ্রান্তিকর ও বিভ্রান্তিমূলক মতাদর্শের বিরুদ্ধে অসংখ্য যুক্তিবহ বিতর্কের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। নান্দনগর, ভাজাক্কাদ, নড়ক্কাভ, রণদথানি, থানালুর, কোট্টাপ্পুরম এবং চেক্কান্নুর মৌলভির বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত বিতর্কগুলো এই প্রচেষ্টার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
এই মতবাদের পক্ষে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন অনেক আলেম — যেমন: ভানিয়মপালম আবদুর রহমান মুসলিয়ার, ই.কে. হাসান মুসলিয়ার, কুট্টানাড়ের কে.ভি. মুহাম্মদ মুসলিয়ার, এম.এম. বশির মুসলিয়ার, ও নাট্টিকার ভি. মুসা মুসলিয়ার। তারা এই ধর্মীয় ও বৌদ্ধিক লড়াইয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। পরবর্তী সময়ে, শুধুমাত্র মতাদর্শ চর্চা ও ধর্মীয় বিতর্ক পরিচালনার উদ্দেশ্যে এস.কে.এস.এস.এফ.-এর অধীনে ইস্তিকামা নামে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। আজও ইস্তিকামা এই ধরনের চিন্তাশীল ও ধর্মীয় আলোচনার ক্ষেত্রে সক্রিয় ও দৃশ্যমান উপস্থিতি বজায় রেখেছে।
মনে রাখবেন, দারুল হুদা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি বেঙ্গল অফ ক্যাম্পাস কোনও ভাবেই ওহাবি বা আহলে হাদীস চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠান নয়। এটি সুস্পষ্টভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র, যার মূল ভিত্তি ঐতিহ্যবাহী সুন্নি আকিদা ও মানহাজ। এই প্রতিষ্ঠান সরাসরি সংযুক্ত রয়েছে এই প্রাচীন এবং বিশ্বস্ত সংগঠন সমস্ত কেরালা জামিয়াতুল উলামার সঙ্গে—যারা যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ ভারতের ধর্মীয় ও শিক্ষাগত অঙ্গনে আহলুস সুন্নাতের সত্য পথ এবং আকিদা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দারুল হুদা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি সেই ধারারই একটি উজ্জ্বল শাখা, যা ইসলামের মূলসূত্র এবং প্রেমভক্তিপূর্ণ ধারাকে তুলে ধরতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।