মসজিদ :- মুসলিম উম্মাহর নিউক্লিয়াস

মুসলিমদের ঐক্যের সূতিকাগার মসজিদ। ইসলামের স্বর্ণযুগে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে মসজিদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। নবুওয়াত ও খেলাফত শাসনকালে রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন প্রণয়ন ও বিচার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য স্বতন্ত্র কোন রাজভবন, সংসদ ভবন ও বিচার রায়ের অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ হতো মসজিদ প্রাঙ্গনে। মসজিদে নামাজ আদায়কালে ধনী-গরিব, বড়-ছোট, মালিক- শ্রমিক, সকলে একই কাতারে সরিবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়ার কল্যাণে মুসলমানদের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে। হিন্দুদের মন্দির, খ্রিস্টানদের গির্জা, বৌদ্ধদের প্যাগোডা, ইহুদিদের সিনাগগ ও শিখদের গুরুদুয়ারের মতো মসজিদ গতানুগতিক কোন উপাসনাগৃহ নয়; বরং এটা একটা মুসলিম উম্মাহর ব্যক্তি জীবন হতে শুরু করে- সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু।

সমাজে মসজিদের ভূমিকা:- 

সমাজে মসজিদের ভূমিকা অসীম। এবং সমাজে মসজিদের ভূমিকা কেমন হবে- তা ঠিক করে দিয়েছেন রসূলুল্লাহ ﷺ। মদিনার প্রধান মসজিদ মসজিদে নববী। সেখানে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জামায়াতের নামাজের নেতৃত্বে দিতেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ। মসজিদে নববী ছিল সমস্ত সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, মুসলিম উম্মাহর নিউক্লিয়াস।মসজিদে নববীশুধু যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় এবং জুমার জামাত অনুষ্ঠানের কেন্দ্র ছিল তাই নয়; আত্মাশুদ্ধিমূলক কর্মসূচির পাশাপাশি জাগতিক সমস্যা সমাধানে   মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।

পৃথিবীর সবচেয়ে সংগঠিত ধর্ম ইসলাম। ইসলাম শুধু একটি আধ্যাত্মিক আচার- অনুষ্ঠানের নাম নয়। একটি জীবন দর্শন। একটি পরিপূর্ণ অনুশাসন। মুসলিম সম্প্রদায়ের সমাজ ইমারত গড়ে উঠেছে মসজিদকে কেন্দ্র করে। বর্তমান প্রায় প্রতিটি মসজিদে একজন- দু'জন সর্বদা কর্মী থাকেন। ইমাম মুয়াজ্জিন। তাদের প্রধান কাজ মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আজান নামাজের আয়োজন সম্পাদন করা। পাড়ার শিশুদের তরুণদের ইসলামের মৌলিক ধর্মতত্ব বিষয়ে শিক্ষা দান করা। পাড়ার মানুষের জন্ম মৃত্যু বৈষয়িক জীবনে ইসলামী অনুশাসন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। যেন সমাজের প্রতিটি প্রজন্ম মসজিদ থেকেই দিনের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

মসজিদমুখী প্রজন্ম গড়ে তুলতে করণীয় :- 

সত্যিকারার্থে আপনি যদি একটি নামাজি সমাজ কিংবা নামাজী প্রজন্ম দেখতে চান, তাহলে শিশু তরুণদের মসজিদমুখি করতে হবে। যে প্রজন্ম অভ্যাসগতভাবেই মসজিদ-মুখী, সে প্রজন্ম স্বাভাবিকভাবেই কল্যাণকামী হয়। অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম যদি মসজিদে না চেনে, তাহলে তারা বিকল্প জায়গা খুঁজে নেবে এবং বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে। সমাজে কিশোর অপরাধ এবং যুবকদের অনৈতিক কাজ ধর্ষণ বিস্তার তার চাক্ষুষ প্রমাণ। তাই সুন্দর অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে মসজিদমুখি প্রজন্ম গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

তরুণদের মসজিদমুখি করার জন্য ছোট বয়স থেকেই তাদের মসজিদে নিয়ে আসতে হবে। আস্তে আস্তে মসজিদের আদবগুলো  শেখাতে হবে। বাচ্চারা যেহেতু নতুন জামা পড়তে ভালোবাসে, তাই মসজিদে আসার জন্য তাদের নতুন জামা কিনে দেওয়া যেতে পারে অথবা অপেক্ষাকৃত ভালো জামাটি পড়ানো যেতে পারে- এতে তাদের আগ্রহ প্রবল হবে।

বাচ্চারা সাধারণত একটু দুষ্টু স্বভাবের হয়। তারা সুযোগ পেলেই হাসি, কান্না ছোটাছুটি হইহুল্লো করতে ভালোবাসে। আর এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, তারা এর ভালো মন্দ প্রভাব বুঝতে পারে না।এক্ষেত্রে অভিভাবকদের একটু সজাগ হতে হবে। মসজিদে যাতে তারা এসব না করে, এজন্য বাড়িতে তাদের বোঝাতে হবে। নিয়মিত বোঝালে তারা একসময় মসজিদের পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে পাশে নিয়ে নামাজে দাঁড়ানো। এতে তারা দুষ্টুমি করার সুযোগ পায় না, আর পেছনের কাতারে পাঠিয়ে দিলে তারা আরো বেশি করে দুষ্টুমি করার সুযোগ পায়। মসজিদে আসা- যাওয়ার পথে গল্পচ্ছলে তাদের মসজিদের আদব-কায়দা ইসলামের বিভিন্ন বিষয় শিখিয়ে দিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে এটা আমাদের ইবাদতগৃহ, এটা পবিত্র জায়গা। এখানে দুষ্টুমি করতে হয় না। এখানে নীরবে সুন্দর পরিবেশে ভদ্রভাবে আল্লাহর ইবাদত- বন্দেগী করতে হয়। এভাবে বুঝিয়ে বললে ধীরে ধীরে মসজিদের আদব সম্পর্কে ওরা সচেতন হয়ে উঠবে।

মনে রাখবেন বড়দের নামাজী বানানো খুব কঠিন, কিন্তু ছোটদের মসজিদমুখি করা খুবই সহজ। তাই দাওয়াতি কাজের একটা বড়ো সময় ছোটদের পেছনে ব্যয় করা উচিত। রসূলুল্লাহ সাঃ নিজেও শিশুদের মসজিদে নিয়ে আসতেন এবং তাদের দুষ্টুমি সহ্য করতেন। তিনি যখন সেজদায় যেতেন, তখন তিনার প্রিয় নাতি ইমাম হাসান হুসাইন তিনার কাঁধে চড়ে বসতেন। ফলে তিনি সেজদা থেকে উঠতে পারতেন না, তবুও তিনি নাতিদের সঙ্গে রাগ বা খারাপ আচরণ করতেন না।

যে সমাজের মসজিদগুলো শিশু- কিশোরদের পদচারণায় মুখর থাকে। সেই সমাজ মুসল্লির অভাব হয় না। আমরা যদি মসজিদে অধিক পরিমাণে কিশোর, তরুণ- যুবকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারি। তাহলে রাতারাতি সমাজ বদলে যাবে। মাদকসেবি কমে যাবে, যুবকদের অনৈতিক কাজ, ধর্ষণ বন্ধ হবে। আমরা পাব মসজিদমুখি এক আলোকিত তরুণ প্রজন্ম।

শ্রেষ্ঠ তিন মসজিদের গল্প:- 

ইসলামে তিনটি মসজিদের মর্যাদা সবচাইতে বেশি, হাদিসে অন্যান্য মসজিদের ওপর এই তিনটি মসজিদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। এই তিনটি মসজিদ ঐতিহাসিকভাবে শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব অর্জন করে আছে। নবী-রাসূলদের পথধূলি ধন্য এই তিনটি মসজিদে সালাত আদায়ের বাসনা প্রতিটি মুমিন হৃদয়। মসজিদ তিনটি হল:- মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, এবং মসজিদে আকসা। দুটিতে মুসলমানদের অবারিত সুযোগ থাকলেও একটি রয়েছে দখলদার ইহুদিদের অধীনে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত :- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেনবিশেষ সওয়াবের উদ্দেশ্যে এই তিনটি মসজিদ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও ভ্রমণ করা নিষিদ্ধ।আর সেগুলো হলো :- মসজিদে হারাম,মসজিদ নববি, এবং মসজিদুল আকসা। (সহিহ বুখারী :- ১১৮৯)

মসজিদুল হারাম:- 

মসজিদুল হারাম পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদ- যা পবিত্র কাবাকে ঘিরে অবস্থিত। কাবাকে বলা হয় বাইতুল্লা বা আল্লাহর ঘর। এটাই পৃথিবীর প্রথম ঘর। হজ ওমরাহ কারিগণ এই ঘরকে ঘিরে তাওয়াফ করে থাকেন। এই মসজিদ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর ইসরা সংঘটিত হয়েছিল। এই মসজিদের আঙিনায় রয়েছে মাকামে ইব্রাহিম এবং জমজমের কূপ। পাশেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাফা- মারওয়া পাহাড়। যারা এই মসজিদের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করবে,তারা নিরাপদ।  পবিত্র মসজিদ গোটা মানবসভ্যতার মিলনকেন্দ্র।

মসজিদে নববী :- 

আল্লাহর রাসূল এর নিজ হাতে গড়া মদিনার অন্যতম স্থাপনামসজিদে নববীবিশ্বনবী যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন শহরটির নাম ছিলইয়াসরিবনবীজির আগমনের পরপরই এই ইয়াসরিব  নামটি পরিবর্তন করে 'মদিনা' রাখা হয়। এটি বর্তমানেমদিনায় মুনাওয়ারাহিসাবে পরিচিত। মসজিদে নববীর অবস্থান মদিনা শহরের কেন্দ্রস্থলে। গুরুত্বের দিক দিয়ে দেখলে মসজিদুল হারামের পরপরই এই মসজিদের স্থান। মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছিল ইতিহাসের প্রথম মুসলিম সমাজ কল্যাণরাষ্ট্র। মসজিদ শুধু নামাজ পড়ার জন্যই ছিল না; বরং এটি ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে মুসলমানরা ইসলামের যাবতীয় জ্ঞান শিক্ষা লাভ করত। সাহাবীদের দ্বীন শেখানো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ বিশ্বনবী মসজিদে নববীতে বসেই আনজাম দিতেন। সাহাবীরা এখানেই তিনার কাছে কুরআন শিখতেন। আবার এর প্রাঙ্গনে চলত যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রস্তুতিসভা।আক্ষরিক অর্থেই মসজিদ ছিল জীবন্ত প্রাণবন্ত। মদিনার সোনালী সমাজ বিনির্মাণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল এই পবিত্র মসজিদ। রাসূলুল্লাহ এর পর খেলাফায়ে রাশেদের যুগ পর্যন্ত মসজিদে নববী ছিল ইসলামিক খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে গোটা মুসলিম বিশ্ব পরিচালিত হতো।

মসজিদুল আকসা :- 

মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস ইসলামিক তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। যেটি জেরুজালেম শহরে অবস্থিত। এটা মুসলমানদের কাছেবাইতুল মুকাদ্দাসবাআল আকসামসজিদ নামে পরিচিত। ইসলামি স্থাপনার প্রাচীন এই নমুনাটি মুসলমান, খ্রিস্টান ইহুদি তিন ধর্মবলম্বীদের কাছেই সমানভাবে পবিত্র গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের কাছে আল আকসা মসজিদ নামে পরিচিত স্থাপনটি ইহুদিদের কাছেটেম্পল মাউন্টনামে পরিচিত। আল আকসা হচ্ছে ইসলামের প্রথম কিবলা এবং মক্কা মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র স্থান। শেষ জামানার ঘটনাবলীর কারণে এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই অঞ্চলেই দাজ্জাল ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন ঘটবে। বিশ্বনবী মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকেই তিনি উথ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম মিরাজ গমনের প্রাক্কালে এই মসজিদে সকল নবী- রাসূলদের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এতে তিনিইমামুল আম্বিয়াঅর্থাৎ সকল নবীর ইমাম এবংসাইয়েদুল মুরসালিনতথা সব রসূলদের নেতা হিসাবে স্বীকৃত হন। এলাকাটি অসংখ্য নবী- রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত। প্রাচীনকাল থেকেই অঞ্চলটি ওহী অবতরণের স্থল, ইসলামের কেন্দ্র, ইসলামী সংস্কৃতির চারণভূমি এবং ইসলামে প্রচারের লালনক্ষেত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। আল আকসা মসজিদের গুরুত্বের আরও একটি বড় কারণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে টানা ১৬ বছর পর্যন্ত আকসা মসজিদে ছিল মুসলিমদের কিবলা।



মোদ্দ কথা :- 

মসজিদ ইসলামী সভ্যতার নিদর্শন ঈমানের ইস্পাত কঠিন দুর্গ। দুর্গ একদিকে যেমন মুসলমানদের ঞান-বিজ্ঞানের বাতিঘর, তেমনি ইবাদত বন্দেগির মিহরাব এবং তাওহীদের বাণী প্রচারের কেন্দ্র। মসজিদ হলো সেই বিদ্যালয়, যেখানে থেকে গড়ে উঠেছিল এই উম্মাহর প্রথম প্রজন্ম। মসজিদেই ছিল সেকালে জ্ঞান চর্চার সর্বোচ্চ কেন্দ্র। মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা সোনালী সভ্যতা বিনির্মাণ করেছে। মসজিদকেন্দ্রিক যে চেতনা, তা থেকে সুকৌশল আমাদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা আমরা নিজেরাই মসজিদ থেকে দূরে সরে গেছি। এজন্য আমাদের মগজগুলো হয়েছে শয়তানের আড্ডাখানা। আমরা হারিয়েছি আমাদের স্বর্ণালী অতীত। যশ, খ্যাতি, মান- সম্মান; এমনকী স্বাচ্ছন্দ্রে বাঁচার অধিকারক ও। বিনিময়ে বরণ করেছি অজ্ঞতা, কুসংস্কার, দীনতা- হীনতা, হিংসা, বিভেদ, লাঞ্ছনা- বঞ্চনা পরাধীনতার শৃঙ্খল। যদি এই পরাধীনতার শৃঙ্খলকে দুমড়ে- মুচড়ে আবার সেই আলোকিত সমাজের স্বপ্ন দেখতে চাই, তাহলে মসজিদকেই আমাদের কেন্দ্র বানাতে হবে। সেখানেই ফিরে যেতে হবে। কারণ, সেখানে রয়েছে রহমত, বরকত ঐক্যের যাবতীয় উপাদান। আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে মসজিদকেই বানাতে হবে আমাদের সামাজিক ধর্মীয় মিলনায়তন। মসজিদ হোক মুসলিম উম্মাহর নিউক্লিয়াস।





Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter