সুখময় জীবনের প্রতি কুরআনের দেখানো উত্তম পথ
নস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ সময় ধরে মানবজাতির সম্পর্কে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন যে মানুষেরা তাদের সঠিক আনন্দ ও পরিপূর্ণতা পাওয়ার বিষয় থেকে নিয়মিতভাবে দূরে থাকে। তারা তাদের সঠিক আনন্দ ও পরিপূর্ণতাদায়ক বিষয়গুলিকে চিনতে পারেনা। বিজ্ঞানীরা চূড়ান্ত করেছেন যে মানুষেরা সাধারণত বিশ্বাস করে যে ভুল জিনিসগুলি তাদের স্থায়ীভাবে সুখী করবে। ফলস্বরূপ, লোকেরা প্রায়শই এমন কিছু ঘটানোর জন্য কাজ করে যা আসলে তাদের খুশি করে না।
একটি পবিত্র ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে কুরআন শরিফ স্পষ্ট বিবরণ সহ বেশ কয়েকটি ঘটনার ভবিষ্যৎবাণী করেছে। এমন একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক আয়াত হল, “কেবল আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তার রহমত দ্বারা তারা যেন আনন্দিত হয়, তারা যা কিছু সংগ্রহ করছে তার চেয়ে এটি উত্তম” (সূরা ইউনুস)।
আজকাল, মানুষ সুখী হওয়ার জন্য অর্থ, অনুসারী এবং ধনসম্পদ সংগ্রহ করে। কিন্তু অবশেষে তারা সুখ পেতে ব্যর্থ হয়। মহান আল্লাহ তাআলা মানুষের সুখ বর্ধক বিষয়গুলিকে ভুল বোঝার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আগেই বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তাআলার বানীকে সংগ্রহ করে সেইমত জীবন গঠন করা সেইসব থেকে অনেক উত্তম যা তারা সংগ্রহ করতে ব্যস্ত।
সম্ভবত আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেশি চাওয়া লক্ষ্য হচ্ছে সুখ। সুখ, প্রশান্তি, তৃপ্তি এবং দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ থেকে মুক্তির লক্ষ্য অর্জন করতে আমরা সারাজীবন সংগ্রাম করি। উনিশ শতকের শেষার্ধে ইতিবাচক মনোবিজ্ঞান বা পসিটিভ সাইকোলজি আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে এটি সমাজে অগণিত সুখ বর্ধক ক্রিয়াকলাপকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে, যেগুলোকে কুরআন শরিফ ইতিমধ্যেই একটি সুখী এবং সুন্দর জীবনের কারণ হিসাবে বিবেচিত করেছে।
সোনজা লিউম্বোমিরস্কি তার বই “দ্য হাউ অফ হ্যাপিনেস” –এ একটি পাই চার্ট তত্ত্ব তুলে ধরেছেন, যাতে দেখানো হয়েছে যে প্রত্যেক মানুষের খুশি হওয়ার বৈশিষ্ট্য ৫০ শতাংশ জিনগতভাবে, ১০ শতাংশ জীবন পরিস্থিতি দ্বারা এবং বাকি ৪০ শতাংশ মানুশ যা করে এবং ভাবে তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
যেহেতু মানুষ তাদের জিনে পরিবর্তন করতে সক্ষম নয় এবং তাদের পরিস্থিতির উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই তাই বিজ্ঞান তার দীর্ঘ সময়ের পরীক্ষানিরীক্ষার ফলস্বরূপ বাকি ৪০ শতাংশ –এর সুবিধা গ্রহণ করে একটি সুখী এবং পরিপূর্ণ জীবন পরিচালনার জন্য কিছু ইচ্ছাকৃত কার্যকলাপের সাহায্য নিতে নির্দেশ করেছে।
চমকপ্রদ বিষয় হল এই যে বিজ্ঞান খুশি বর্ধক বিষয়গুলির মধ্যে কুরআন যা আগেই বলে দিয়েছে তার বাইরে নতুন কিছুই খুঁজে পাইনি। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যারা ইমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করেছে তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সুসংবাদ”। (ইউনুস)
যদিও একজন সত্যিকারের মুমিনের চূড়ান্ত সুখ আখেরাতের জগতে অপেক্ষা করছে তবুও সে তার গন্তব্য জান্নাতে যাওয়ার পথে একটি আনন্দময় ও তৃপ্তিদায়ক জীবনযাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আয়াতটি নিশ্চিত করে যে একজন বিশ্বাসী এবং ধার্মিক ব্যাক্তি উভয় জগতেই একটি উত্তম সুখী জীবন উপভোগ করতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের একটি নতুন বিভাগের সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল হিসেবে বোঝা যায় যে ধর্মীয় লোকেরা অধর্মীয় লোকদের তুলনায় বেশি সুখী, স্বাস্থ্যকর এবং মানসিক আঘাত থেকে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারে। উপরক্ত আয়াতে যা বর্ণনা করা হয়েছে এটি মাত্র তারই একটা উদাহরণ।
জীবন পরিচালনার পথ হিসেবে ইসলাম ধর্ম তার অনুসারীদের একটি উত্তম ও সুখী জীবন প্রদানের ব্যাপারে নিশ্চিত করে। যেহেতু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সুখ বর্ধক কার্যক্রম ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত, তাই কোন মুসলিমকে ভালো জীবন নিয়ে চিন্তা করা উচিত নেই এবং তার প্রয়োজনও নেই।
কৃতজ্ঞতা নিয়ে বিশিষ্ট গবেষক লেখক রবার্ট এমন্স লিখেছেন, “যারা নিয়মিতভাবে নিজেদের মধ্যে কৃতজ্ঞতা বজায় রাখে তারা বেশি স্বাস্থ্যবান এবং উৎসাহী এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অধিকন্তু, সাম্প্রতিক গবেষণা দ্বারা জানা গেছে যে যারা সর্বদা কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে তারা তাদের বেশি সুখী, আনন্দিত, বেশি উদ্যমী এবং বেশি ইতিবাচক বা ভালো চিন্তাভাবনা ও আবেগের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে দেখা গেছে”।
চৌদ্দ শতাব্দী আগে নবী (সঃ) এই একই ধারণাটিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন “একজন মুমিনের অবস্থা মহান, কারণ সে যেকোনো মুল্যে বিজয়ী। যদি তাকে রহমত প্রদান করা হয় এবং সে তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাহলে সেটা তার জন্য উত্তম। যদি সে কোন দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হয় এবং তাতে সে ধৈর্য ধারণ করে তাহলে এটাও তার জন্য ভালো।“ (সহীহ মুসলিম ২৯৯৯)
একজন বিশ্বাসীর সাথে যাই ঘটুক না কেন তার কাছে শান্ত থাকার ও নিরব থাকার কারণ আছে। এমনকি রোজা যেটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি এবং এটিকে নির্ধারিত করা হয়েছে একজন ব্যক্তির তার ঈশ্বরের প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত তা উপলব্ধি করার জন্য। আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তাহলে আমি তোমাদেরকে আরও দেব” সূরা ইব্রাহিম ৭।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির দীর্ঘ ৭৫ ধরে সুখের ব্যাপারে খোঁজ করা বিভাগ ১৯৩৮ সাল থেকে পুরুষদের কিছু গোষ্ঠীর জীবন ট্র্যাক করেছে। গবেষণার সবচেয়ে সুস্পষ্ট উপসংহার হল যে যারা বন্ধু, পরিবার এবং সমাজের সাথে সম্পর্কের দিকে মনোযোগ দেন তারা সুখী হন। অন্যদিকে আল্লাহ তাআলা এই সম্পর্কে কুরআন শরীফে আগেই বর্ণনা করে দিয়েছেন, যেহেতু তিনি বলেছেন, “আর আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কাউকে শরিক কর না এবং মা বাবা, আত্মীয়স্বজন, মিসকিন, নিকটবর্তী প্রতিবেশী, এবং আশেপাশে থাকা প্রতিবেশী, এবং পাশে থাকা সঙ্গি ও মুসাফিরদের সঙ্গে ভালো ব্যাবহার কর”।
এটি নবী (স:) এর আচরন দ্বারা আরও স্পষ্ট হয়, যিনি পিতামাতাকে “হাট” বা এই ধরনের শব্দ বলতেও নিষেধ করেছেন।
ডান, আকনিন এবং নরটুন নামক তিনজন গবেষক উদারতা এবং সুখী জীবনের মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা দেখেছে যে যারা তাদের অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যক্তিগত ব্যয়ের চেয়ে উদার সামাজিক কার্যকলাপে উৎসর্গ করে তারা তাদের চেয়ে বেশি সুখী যারা নিজের জন্য বেশি এবং অন্যের জন্য কম ব্যয় করে।
আর এটাই হল একটি উল্লেখযোগ্য কারণ মুসলিমদের উপর যাকাত ফরজ করার, কারণ আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের সুখী দেখতে চান। নবী (সঃ) বলেছেন, “তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হবে না যতক্ষণ না তুমি তোমার ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করবে না যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ কর”। (বুখারি)
সাইকোলজি টুডে অনুসারে, ধ্যান হল সবচেয়ে শক্তিশালী মানসিক অনুশীলন যা একজনের সুখকে পুনঃস্থাপন করতে পারে, এইভাবে একজনকে আরও আনন্দিত ব্যাক্তিতে পরিণত করতে পারে এবং মস্তিষ্কের প্রধান অংশগুলিকে পুনরুদ্ধার করতে পারে। রাওত আহমেদ ভাটের “ইয়োগা এবং ইসলামিক নামাজের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের একতা” শিরোনামের গবেষণায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যে মুসলিম নামাজ এবং যোগব্যায়ামের মধ্যে অনেক বেশি সামঞ্জস্য রয়েছে এবং এর ফলাফল নামাজ দ্বারাও পাওয়া যায়।
সুতরাং জীবনে সুখ এবং আনন্দ আনার জন্য একজন মানুষ যদি কুরআন এবং শরিয়তকে সঠিক ভাবে অনুসরন করে এবং সেই মত জীবন যাপন করে তাহলে তাকে সুখী জীবন যাপনের জন্য আর অন্য কোন উপদেশের প্রয়োজন নেই।