ধৈর্যের দীপ্তি: হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর জীবনের এক মহাকাব্য
ভূমিকা
মানুষ যখন জীবনের সব কিছু হারিয়ে ফেলে—ধন, সম্মান, সন্তান, এমনকি শরীরের সুস্থতাও—তখন তার হৃদয়ে দুটি পথ উন্মুক্ত হয়: একটি হতাশার, অন্যটি ধৈর্যের। হতাশা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, আর ধৈর্য মানুষকে মহান করে তোলে। ইতিহাসে আমরা অনেক নবীর কথা জানি, কিন্তু এমন একজন নবীর জীবনকাহিনি আমাদের সামনে আছে যিনি ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও ইমানের এমন এক উচ্চতর উদাহরণ স্থাপন করেছেন, যা কালজয়ী হয়ে আছে কোরআনের পাতায়, মানুষের হৃদয়ে। তিনি হলেন হযরত আইয়ুব (আঃ)।
তাঁর জীবন কেবল নবুয়তের আলোকবর্তিকা নয়, বরং ধৈর্য ও ঈমানদারির এমন এক শ্রেষ্ঠ পাঠশালা যেখানে প্রতিটি কষ্ট ছিল একেকটি পরীক্ষা, আর প্রতিটি নিরবতা ছিল আল্লাহর প্রতি অবিচল ভরসার নিদর্শন। সুখের সব কিছুই তাঁর ছিল—ধন, সন্তান, সুখী পরিবার, সম্মান—কিন্তু সবকিছু একে একে চলে গেল। এরপর এল ভয়াবহ রোগ, সমাজচ্যুতি, একাকীত্ব। তবুও তাঁর ঠোঁট থেকে একটিও অভিযোগ বের হয়নি। বরং তিনি আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থেকেছেন, দোয়া করেছেন নির্জনে, সিজদায় কেটেছে তাঁর দিনরাত্রি।
এই প্রবন্ধে আমরা সেই হৃদয়বিদারক কিন্তু আশাজাগানিয়া কাহিনি পাঠ করব—কিভাবে এক নবী দুনিয়ার কষ্টকে পরিণত করলেন আখিরাতের সফলতায়। কীভাবে স্ত্রীর ভালোবাসা ও তাঁর নিজের প্রার্থনা মিলিয়ে আল্লাহর রহমতকে টেনে আনলেন পৃথিবীতে। এই কাহিনি শুধু অতীত নয়, বরং আমাদের আজকের সময়েও আলো ছড়ানো এক চিরন্তন আদর্শ।
নবুয়ত, বংশ ও সুখের জীবনের সূচনা
হযরত আইয়ুব (আঃ) ছিলেন এক বিশুদ্ধ বংশের ধারক ও ধারক। তিনি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর বংশধর, একজন নবী যিনি শুধু আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়েই পৃথিবীতে আগমন করেননি, বরং মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস, বিনয় ও ভালোবাসার ছাপ রেখে গেছেন। ইতিহাস ও তাফসির অনুযায়ী, তাঁর মা ছিলেন হযরত লূত (আঃ)-এর কন্যা এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর বংশধর — নাম ছিল রাহমা। তাঁরা বসবাস করতেন রোমের একটি অঞ্চলে, যেখানে তিনি পরিচিত ছিলেন একজন সফল কৃষক, গবাদিপশুর মালিক ও সমাজহিতৈষী নেতা হিসেবে।
আল্লাহ তাঁকে দুনিয়ার সব রকমের সম্পদ দিয়েছিলেন—ফসলভরা জমি, হাজারো পশুপাখি, বিশ্বস্ত চাকরবাকর এবং চৌদ্দটি সন্তান। পার্থিব দিক দিয়ে তাঁর কিছুই অভাব ছিল না। সমাজ তাঁকে শ্রদ্ধা করত, মানুষ তাঁর দরজায় সমাধানের জন্য আসত, তিনি নিজে ছিলেন উদার, বিনয়ী ও ন্যায়পরায়ণ।
কিন্তু এই পার্থিব সফলতা তাঁর অন্তরকে কখনও কঠিন করেনি। বরং, যত পেয়েছেন তত বেশি শোকর আদায় করেছেন। নফল নামাজে তিনি ছিলেন অতুলনীয়, দরিদ্রদের জন্য তাঁর ঘরের দরজা সবসময় খোলা ছিল। প্রতিটি ভোরে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করে দিন শুরু করতেন, আর প্রতিটি রাতে সিজদায় কাটাতেন তাঁর শেষ সময়।
এই শান্ত ও সফল জীবনের মাঝে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল এক অদৃশ্য ঝড়, যার আঁচর প্রথমে কেউ বুঝতে পারেনি। এই ঝড় ছিল এক মহা পরীক্ষা — ঈমান, ধৈর্য ও বিশ্বাসের এমন এক কঠিন নিরীক্ষা যা ইতিহাসের পাতায় হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর নামকে অমর করে তুলবে।
ফেরেশতাদের আলাপ ও শয়তানের চক্রান্ত: এক নীরব যুদ্ধের সূচনা
আকাশের রাজ্যে একদিন শুরু হয়েছিল এক আলোচনার তরঙ্গ। ফেরেশতারা আল্লাহর দরবারে প্রশংসা করছিলেন তাঁর সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ বান্দাদের নিয়ে। তারা বলছিল, “হে রব! তোমার এমন এক বান্দা আছে, যার ধন-সম্পদ আকাশচুম্বী, সন্তান-সন্ততি প্রাচুর্যে ভরপুর, সমাজে সম্মানিত — তবুও তাঁর অন্তর নত, জিভে শোকর, আর রাত্রি জেগে কাটে সিজদায়। তিনি হলেন হযরত আইয়ুব (আঃ)।”
আল্লাহ বলেন,
“نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ”
“তিনি কত উত্তম বান্দা! নিশ্চয়ই তিনি সর্বদা আমার দিকে ফিরে আসে।”
— সূরা সাদ: ৪৪
এই প্রশংসার আবহেই শয়তান আগমন করে। ঈর্ষা ও হিংসার জ্বালায় সে বলে ওঠে,
“হে প্রভু! আইয়ুব তোমার ইবাদত করে, কারণ তুমি তাঁকে সব কিছু দিয়েছো। যেদিন এই সুখ-সম্পদ থাকবে না, সেদিন তার ইমান থাকবে না। তুমি যদি তাঁর ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, এমনকি শরীরের স্বাস্থ্যও কেড়ে নাও — আমি বলছি, সে আর তোমার ইবাদত করবে না।”
আল্লাহ, যিনি বান্দার অন্তর দেখেন, জানেন তাঁর এই প্রিয় বান্দা পৃথিবীর আসল সৌন্দর্যকে হৃদয়ে স্থান দেননি—তাঁর হৃদয়ের আসন বরাদ্দ শুধুই আল্লাহর জন্য। তাই তিনি বললেন,
“তুমি চাইলে পরীক্ষা নিতে পারো। তবে তাঁর অন্তর ও বিবেকের ওপর তোমার কোনো অধিকার নেই।”
এভাবেই শুরু হলো এক নীরব যুদ্ধ। একদিকে ছিল শয়তানের চক্রান্ত ও কৌশল; অন্যদিকে ছিল এক নবীর সিজদা, ধৈর্য ও অবিচল ঈমান। এই যুদ্ধ ছিল আল্লাহর এক খাঁটি বান্দার অন্তরের দৃঢ়তা ও আস্থার পরীক্ষা — এমন এক পরীক্ষা, যা পরবর্তী মানবজাতির জন্য হয়ে থাকবে এক চিরন্তন দৃষ্টান্ত।
নিঃস্বতা ও সন্তানের মৃত্যু: ধৈর্যের প্রথম স্তর
শয়তান তার কাজ শুরু করল নীরব ঘৃণা আর প্রবল ঈর্ষা নিয়ে। তার উদ্দেশ্য ছিল একটিই—হযরত আইয়ুব (আঃ)-কে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিচ্যুত করা, তাঁর হৃদয়ের দীপ্তি নিভিয়ে ফেলা। শুরু হলো ধ্বংসের কালো ছায়া। একদিন এক খারাপ সংবাদ আসে—সব গবাদিপশু মারা গেছে, খামার পুড়ে ছাই। আরেকজন এসে বলে, “চাষাবাদের জমিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে এক রহস্যময় আগুনে।” এরপর একের পর এক চাকর ও সহচর নিহত হওয়ার সংবাদ আসতে লাগল।
এই দুঃসংবাদগুলো যেন কালো মেঘ হয়ে ঘিরে ধরল তাঁকে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ সংবাদ তখনও বাকি ছিল।
একদিন এক ভয়ানক ঝড় আসে—দেয়াল ধসে পড়ে তাঁর ঘরে, যেখানে তাঁর সব চৌদ্দ সন্তান একসাথে অবস্থান করছিল। সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে গেল তাঁর সন্তানেরা।
একজন পিতা যিনি প্রতিটি সন্তানের নাম মুখস্ত জানতেন, যাঁর হৃদয় ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ—তিনি এক নিমিষে সন্তানহীন হয়ে গেলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর মুখে কোনো অভিযোগ ছিল না, কোনো ফুঁপিয়ে কাঁদা ছিল না, ছিল না কোনো অভিশাপ। তিনি শুধু কণ্ঠে বললেন:
إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ
“নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য, এবং আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।”
— সূরা বাকারা: ১৫৬
এরপর তিনি সিজদায় মাথা রাখেন—অভিযোগ করতে নয়, বরং শুকরিয়া জানাতে। তিনি জানতেন, সন্তান, সম্পদ, সুখ—সবই তো আল্লাহর দেওয়া, তিনি চাইলে নিয়ে নিতে পারেন। আর তাঁর ইমান কখনো এমন সাময়িক দুঃখে টলে যাবে না। এই ছিল তাঁর ধৈর্যের প্রথম স্তর—যেখানে এক পিতা তাঁর হৃদয়ের রক্ত দিয়ে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ভালোবাসার অটল নিদর্শন স্থাপন করলেন।
ভয়াবহ অসুস্থতা ও সমাজচ্যুতি: শারীরিক দুঃখের সর্বোচ্চ ধাপ
শয়তান এবার চূড়ান্ত কৌশলে ফিরে আসে। সে বলল, “হে প্রভু! আইয়ুব এখনো তোমার ইবাদত করে, কারণ সে শারীরিকভাবে সুস্থ। যদি তুমি তাঁর শরীরেই রোগ ঢেলে দাও, তবে সে তোমাকে ছেড়ে দেবে, অভিযোগ করবে, ধৈর্য হারাবে।”
আল্লাহ তাআলা বললেন, “তাঁর হৃদয় ও বিবেক ছাড়া তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।”
এই অনুমতির মধ্য দিয়েই শুরু হয় এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়—এক নবীর শারীরিক কষ্টের অসীম পরীক্ষা।
হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর শরীরে শুরু হয় এক দুরারোগ্য চর্মরোগ। ধীরে ধীরে তাঁর সারা দেহে পচন ধরল, রক্ত ও মাংস ঝরে পড়তে লাগল। তাঁর সৌন্দর্য, শক্তি, সম্মান—সবকিছু হারিয়ে যেতে লাগল একে একে। সমাজ তাঁকে ঘৃণার চোখে দেখতে লাগল। যারা একসময় তাঁকে শ্রদ্ধা করত, তারা আজ দূর থেকে থুতু ছুড়ে বলত, “এই মানুষটি হয়তো কোনো বড় পাপ করেছে!”
শেষ পর্যন্ত তাঁকে সমাজচ্যুত করে গ্রামের বাইরে গোবরের ঢিবিতে ফেলে দেওয়া হলো। সব বন্ধু, আত্মীয় মুখ ফিরিয়ে নিল—শুধু একজন ছাড়া। তিনি ছিলেন তাঁর স্ত্রী রাহমা—সাহসী, অনুগত, ধৈর্যশীলা এক নারী, যিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষকে কোনো অবস্থায় ছেড়ে যাননি।
তিনি কাজ করতেন, রোজগার করে এনে স্বামীর সেবা করতেন, ক্ষত পরিষ্কার করতেন, খাবার বানাতেন, চোখে অশ্রু নিয়ে প্রভুর করুণা কামনা করতেন।
একদিন রাহমা কাতর গলায় বললেন, “হে নবী! আপনি কি আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন না? যেন তিনি আপনার এই কষ্ট দূর করেন?”
হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল। তিনি বললেন:
“আমি আশি বছর সুস্থ জীবন কাটিয়েছি। এখন মাত্র সাত বছর কষ্ট পাচ্ছি। আমি কীভাবে অভিযোগ করব, কিভাবে অস্থির হয়ে দোয়া করব!”
এই কথায় তিনি স্ত্রীর উপর সামান্য ক্ষুব্ধ হলেন এবং শপথ করলেন, “যদি আমি সুস্থ হই, তবে আমি তাঁকে একশ বার আঘাত করব।”
তবে সেটিও ছিল তাঁর ঈমানের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ—তিনি কথায় অটল থাকতে চেয়েছিলেন, যদিও পরে আল্লাহ তাআলা তাঁর এই শপথ পালনে করুণার পথ সৃষ্টি করবেন।
এ ছিল হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর ধৈর্যের দ্বিতীয় স্তর—যেখানে শরীর ধ্বংস হয়েছে, সমাজ বর্জন করেছে, কিন্তু ঈমান এখনো অটুট, জিকির এখনো জীবন্ত, ভালোবাসা এখনো আল্লাহর দয়ার আশায় ভরপুর।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ও দোয়ার মাধ্যমে মুক্তি
সব কষ্টেরও এক সীমা আছে, আর আল্লাহর রহমতের তো কোনো সীমা নেই। হযরত আইয়ুব (আঃ) যখন সমস্ত দিক থেকে নিঃস্ব, নিঃসহায় ও একাকী, তখনও তাঁর হৃদয় ছিল আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ। অবশেষে, দীর্ঘ সাত বছর পর, যখন শারীরিক কষ্ট ও একাকিত্ব সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়, তখন তিনি আল্লাহর দরবারে চুপিসারে, কাঁদতে কাঁদতে এক দোয়া করেন—একটি ছোট অথচ গভীর হৃদয়বিদারক আর্জি:
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَىٰ رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ
“আর স্মরণ করো আইয়ুবের কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করেছিল— ‘আমি তো বিপদে পড়েছি, আর তুমি তো দয়াবানদের মধ্যে সর্বাধিক দয়াবান।’”
— [সূরা আম্বিয়া: ৮৩]
এ দোয়ার মধ্যে কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো নিরাশার সুর। শুধু নিজের অসহায়ত্বের স্বীকারোক্তি এবং আল্লাহর দয়ার প্রতি পূর্ণ আস্থা।
আল্লাহ তাআলা তাঁর এই নিঃস্বার্থ, বিনয়ী প্রার্থনায় সাড়া দিলেন। বললেন:
"তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করো— সেখানে রয়েছে ঠান্ডা ও নিরাময়কারী পানি।"
তিনি সেই জায়গায় আঘাত করলেন, সেখানে ফুয়ারা গজিয়ে উঠল। তিনি সেই পানি পান করলেন, গোসল করলেন—আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর শরীরের সকল ক্ষত মিলিয়ে গেল, রোগ বিদায় নিল, যৌবনের জ্যোতি ফিরে এল।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আল্লাহ তাঁকে তাঁর হারানো সব ধনসম্পদ, গবাদিপশু, জমিজমা ফিরিয়ে দিলেন—আরও দ্বিগুণ করে। যেসব সন্তান এক ঝড়ে হারিয়ে গিয়েছিল, তাদের বদলে নতুন সন্তান দিলেন, আর কেউ বলেন, হারানো সন্তানদেরই জীবিত করে ফিরিয়ে দিলেন।
আর যে স্ত্রীর প্রতি তিনি শপথ করেছিলেন—শরিয়তের বিধান অনুযায়ী তাঁকে আঘাত করতে হবে—আল্লাহ স্নেহভরে বললেন:
"তুমি ঘাসের একটি গুচ্ছ নিয়ে তা দিয়ে স্ত্রীকে একবার স্পর্শ করো, এতে শপথও পূর্ণ হবে, আর স্ত্রীর ওপর কোনো কষ্টও আসবে না।"
এভাবে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করলেন, আর ধৈর্যের প্রতিদানে তাঁকে এমনভাবে মর্যাদা দিলেন, যা কল্পনারও অতীত।
আমাদের জীবনের জন্য হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর শিক্ষণীয় বার্তা
হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর জীবন কেবল একটি কাহিনি নয়—এটি ধৈর্যের এক জীবন্ত প্রতিমা। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন এক একটি শিক্ষার মিনার, যেখানে একজন মুমিন নিজেকে পরীক্ষা করতে পারে—আমি ধৈর্যে কতটা অটল? ঈমানে কতটা দৃঢ়?
এই কাহিনি আমাদের শেখায়, ধৈর্যই একজন মুমিনের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র। সম্পদ, সম্মান, সন্তান—সব কিছু হারিয়েও যিনি আল্লাহর প্রতি অভিযোগ না করে শোকর আদায় করেন, তিনিই প্রকৃত ঈমানদার।
"আল্লাহ কষ্ট দেন, কিন্তু বিনা উদ্দেশ্যে দেন না।"
এই বাক্যটি যেন হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর জীবনের মূলমন্ত্র।
আমরা যখন জীবনের চাপে, রোগে, আর্থিক সংকটে হতাশ হয়ে পড়ি, তখন আমাদের মনে রাখা উচিত—আইয়ুব (আঃ) সব হারিয়ে ছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস হারাননি। কারণ, দুনিয়ার সব কিছু হারালেও যদি ঈমান থাকে, তবে কিছুই হারায়নি।
এ কাহিনি আমাদের আরও শেখায়—স্ত্রীর ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ কত গভীর হতে পারে। হযরত রাহমা (রাঃ) ছিলেন এক নিঃস্ব রাজকন্যা, যিনি কষ্টের দিনেও স্বামীর সেবা করেছেন, ভেঙে পড়েননি। আজকের যুগে যেখানে সম্পর্ক ভঙ্গুর হয়ে গেছে, সেখানে হযরত রাহমা (রাঃ)-এর উদাহরণ আমাদের জন্য এক শিক্ষণীয় আদর্শ।
সবশেষে, এই কাহিনি আমাদের আত্মবিশ্বাস দেয়—আল্লাহ কখনো ধৈর্যশীলদের ছেড়ে দেন না। ধৈর্যের পরে আসে রহমত, আর বিশ্বাসের শেষে আসে বিজয়।
উপসংহার
হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর জীবন শুধুই কোনো কাহিনি নয়—এটি এক নীরব বিপ্লবের নাম, এক অধ্যায়ের নাম যেখানে ধৈর্য পরিণত হয় এক মহাসমর-শক্তিতে। তাঁর জীবন ছিল নাড়ির টানে দোয়া, অশ্রুতে ডুবে থাকা ইবাদত, এবং নিঃশব্দ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।
তিনি ছিলেন এমন এক নবী, যিনি সব হারিয়েও আল্লাহকে হারাননি। সন্তান হারিয়েছেন, ধন হারিয়েছেন, শরীরের সুস্থতাও হারিয়েছেন—কিন্তু হারাননি তাঁর বিশ্বাস। সমাজ তাঁকে ফেলে দিয়েছিল গোবরের ঢিবিতে, অথচ তিনি সিজদা থেকে উঠেননি।
এই জীবন আমাদের শেখায়—পৃথিবীর দুঃখগুলো চিরস্থায়ী নয়। একদিন সব দুঃখ কেটে যায়, যদি অন্তরে ঈমান অটুট থাকে। হযরত আইয়ুব (আঃ) চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহর রহমত কখনো বিলীন হয় না, বিলম্ব হয় মাত্র।
এই মহাকাব্যের শেষ বাণী যেন হয় আমাদের অন্তরে গাঁথা—
"যারা ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাঁদের সাথে আছেন। আর যার সাথে আল্লাহ আছেন, তার কিছুই হারায় না।"
আল্লাহ যেন আমাদেরও ধৈর্যশীল বানান, ঈমানের কঠিন পরীক্ষায় টিকিয়ে রাখুন—
আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাস-সাবর।