গাউসুল আ'যম হযরত শেখ সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর জীবন ও দর্শন (পর্ব-১)

ভূমিকা

ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে, যখন আব্বাসীয় খিলাফতের সূর্য অস্তমিতপ্রায়, মুসলিম বিশ্ব যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয় এবং আকিদাগত বিভ্রান্তির গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত, ঠিক তখনই পারস্যের জিলান প্রদেশের বুকে এক আধ্যাত্মিক নক্ষত্রের উদয় হয়। তিনি ছিলেন হযরত শেখ সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ), যিনি মুসলিম সমাজের জন্য কেবল একজন আলেম বা সুফি সাধক ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক, ইসলামের পুনরুজ্জীবনকারী (মুজাদ্দিদ) এবং এমন এক আধ্যাত্মিক বসন্তের অগ্রদূত, যার সুবাস আজ অবধি বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করে রেখেছে। তাঁর জীবন ছিল শরীয়তের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা এবং তরিকতের গভীরতম রহস্যের এক অপূর্ব সমন্বয়। তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর প্রজ্ঞা, কারামত এবং শিক্ষামালা মুসলিম সমাজে এক নতুন জাগরণের সূচনা করেছিল। সত্যবাদিতা, আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং সৃষ্টির প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যে আদর্শ তিনি স্থাপন করে গেছেন, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পথহারা মানুষের জন্য বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে। এই প্রবন্ধে আমরা সেই মহান অলির জীবনের বিভিন্ন দিক, তাঁর জ্ঞানার্জন, আধ্যাত্মিক সাধনা এবং দর্শনের গভীরতা উন্মোচনের চেষ্টা করব, যার মাধ্যমে তাঁর মহত্ত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।

​​জন্ম, শৈশব ও সত্যবাদিতার অবিস্মরণীয় ঘটনা

হযরত গাউসুল আ'যম (রহঃ) ৪৭০ হিজরি সনের ১লা রমজান পারস্যের (বর্তমান ইরান) জিলান নামক প্রদেশে এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশধারা পিতৃকুল থেকে হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এবং মাতৃকুল থেকে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা তাঁকে 'হাসানী-হুসাইনী' সৈয়দ হিসেবে বিরল সম্মান প্রদান করেছে। তাঁর জন্মের পূর্বেই বিভিন্ন অলৌকিক ইশারা তাঁর আগমনী বার্তা দিচ্ছিল। কথিত আছে, তাঁর জন্মের রাতে জিলানের যে সকল শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল, তারা প্রত্যেকেই ছেলে ছিল এবং প্রত্যেকেই পরবর্তী জীবনে আল্লাহর অলি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাঁর শৈশবকাল থেকেই অসাধারণত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। 

সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, রমজান মাসে তিনি দিনের বেলায় কখনো মায়ের দুধ পান করতেন না, যা তাঁর জন্মগত রোজা রাখার এক অলৌকিক নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, তিনি জন্মসূত্রেই আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর নিজ শহর জিলানেই। তাঁর মাতৃদেবী, হযরত উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রহঃ), তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত পরহেজগার ও বিদুষী নারী। তিনিই শিশু আব্দুল কাদেরের অন্তরে আল্লাহপ্রেম এবং সত্যবাদিতার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। এই প্রতিপালন বা তরবিয়ত তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

​তাঁর জীবনের সবচেয়ে শিক্ষণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনাটি ঘটেছিল আঠারো বছর বয়সে, যখন তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদের পথে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে হামদানের নিকটবর্তী এক পার্বত্য অঞ্চলে তাঁদের কাফেলা একদল দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হয়। দস্যুরা যখন কাফেলার সকলের সর্বস্ব লুট করছিল, তখন তরুণ আব্দুল কাদের শান্ত ও অবিচল ছিলেন। এক দস্যু তাঁর কাছে এসে যখন জিজ্ঞাসা করে যে তাঁর কাছে কিছু আছে কিনা, তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে উত্তর দেন, "আমার কাছে চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা (দিনার) আছে, যা আমার মা আমার জামার আস্তিনের নিচে সেলাই করে দিয়েছেন।" দস্যুটি প্রথমে একে কৌতুক মনে করলেও, তাঁর দৃঢ়তায় অবাক হয়ে তাঁকে তাদের সর্দারের কাছে নিয়ে যায়। 

সর্দার তাঁর সত্যবাদিতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, "আমার মা আমাকে সর্বদা সত্য কথা বলার উপদেশ দিয়েছেন, আমি আমার মায়ের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারি না।" এই একটি বাক্য দস্যু সর্দারের পাষাণ হৃদয়ে এমনভাবে আঘাত করে যে, তার মধ্যে অনুশোচনার আগুন জ্বলে ওঠে। সে কেঁদে ফেলে বলে, "তুমি তোমার মায়ের একটি উপদেশের জন্য নিজের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন করতে পারো, আর আমি আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আদেশ প্রতিনিয়ত অমান্য করে চলেছি!" এই উপলব্ধির পর সে এবং তার পুরো দল তওবা করে এবং লুণ্ঠিত সকল সম্পদ ফিরিয়ে দেয়। এই ঘটনাটি কেবল তাঁর সত্যনিষ্ঠার চূড়ান্ত দৃষ্টান্তই নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে সত্যের শক্তি কতটা প্রবল, যা পাপীর হৃদয়কেও পরিবর্তন করতে পারে।

জ্ঞানার্জনের দুর্গম সফর ও বাগদাদে প্রতিষ্ঠা

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর জীবন ছিল জ্ঞানের প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসা এবং তা অর্জনের জন্য অকল্পনীয় ত্যাগের এক মহাকাব্য। জিলানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর ৪৮৮ হিজরিতে মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি বাগদাদের উদ্দেশে এক দুর্গম ও বিপদসংকুল যাত্রা শুরু করেন। তাঁর এই সফর কেবল ভৌগোলিক ছিল না, বরং এটি ছিল এক আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা। বাগদাদে পৌঁছে তিনি চরম দারিদ্র্য ও কষ্টের সম্মুখীন হন। অনেক সময় তাঁকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হতো এবং শহরের পরিত্যক্ত স্থানে রাত্রিযাপন করতে হতো। কিন্তু জ্ঞানের প্রতি তাঁর পিপাসা এতটাই তীব্র ছিল যে, কোনো জাগতিক কষ্টই তাঁকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলেম ও মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্যে থেকে বিভিন্ন শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি কুরআন, তাফসীর, হাদীস, ফিকহ (বিশেষ করে হাম্বলী মাযহাব), উসূল, কালাম, নাহু (আরবি ব্যাকরণ) এবং তাসাউফসহ ইসলামের প্রায় সকল শাখায় জ্ঞানলাভ করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শায়খ আবু সা'দ আল-মুবারক আল-মুখাররামী (রহঃ), কাজী আবু সা'ঈদ আল-মুখরিমী (রহঃ) এবং আবু'ল-ওয়াফা 'আলী ইবন 'আকিল (রহঃ)-এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীগণ।

​তাঁর জ্ঞানার্জনের একাগ্রতা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তিনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অধ্যয়নে মগ্ন থাকতেন এবং প্রায়শই লোকালয় থেকে দূরে নির্জন স্থানে গিয়ে আল্লাহর ইবাদত ও মোরাকাবায় নিমগ্ন হতেন। তাঁর এই সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাগদাদের আলেম সমাজে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন।

 তাঁর শিক্ষক শায়খ আবু সা'দ আল-মুখাররামী (রহঃ) তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার দায়িত্বভার হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর উপর অর্পণ করেন। এখানেই তিনি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাদান ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শোনার জন্য কেবল সাধারণ মানুষই নয়, বরং বড় বড় আলেম, ফকিহ এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারাও ভিড় জমাতেন। তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি ছিল অনন্য। তিনি একই সাথে তাফসীর, হাদীস, ফিকহসহ তেরোটি ভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করতেন। তাঁর প্রজ্ঞা, বাগ্মীতা এবং আধ্যাত্মিক প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, হাজার হাজার মানুষ তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে, অগণিত পাপী তওবা করে সৎপথে ফিরে আসে এবং বহু ইহুদি ও খ্রিস্টান তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এভাবেই তিনি বাগদাদকে কেন্দ্র করে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লবের সূচনা করেন, যা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter