ম্যালকম এক্সঃ এক বিপ্লবী জননেতা
ভূমিকা: ম্যালকম এক্স বিংশ শতাব্দীর এক বহুলচর্চিত নাম। ম্যালকম এক্স মানে মার্কিন যুক্তরাষ্টের বুকে দুঃসাহসিক আন্দোলনের এক অকুতভয় নেতা। এবং প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রতিবাদী ভাষার নাম ম্যালকম এক্স। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত নিগ্রো কৃষ্ণাঈদের অধিকার ফিরে যেতে আর তাদের গোলামীর (দাস প্রথার) জিঞ্জির থেকে মুক্ত করতে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ম্যালকম এক্স। শুধু স্বপ্ন নয়, তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক বৃহত্তর গণ আন্দোলন। এবং তার কথা বলার দক্ষতা তাকে মার্কিন মুলুকে বিখ্যাত করেন। এবং ম্যালকম এক্সের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং আধ্যাত্বিক উন্নতি অগনিত মানুষকে স্রষ্টার সানিধ্যে ফিরে যেতে সাহায্য করে।
তিনার সংক্ষিপ্ত জীবনঃ ম্যালকম এক্স ১৯২৫ সালের ১৯ই মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রস্কা রাষ্টের ওমাহা শহরে একটি খীষ্টান-আফ্রিকান, মার্কিন পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ম্যালকম এক্স তার বাবার নয় সন্তানের মধ্যে সম্পত ছিলেন। তিনজন আগের বিয়েতে এবং তার মায়ের চতুর্থ সন্তান। আমেরিকার জাতপাতে জর্জরিত নগ্ন পরিবেশে লালিত পালিত হয়েছেন। এবং তার বাবা, রেভারেন্ড আর্ল লিটন ছিলেন একজন ব্যাপটিস্ট মন্ত্রি। এবং মার্কাস গার্ভির ইউনিভার্সাল নিগ্রো ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের একজন সংগঠক। এবং ম্যলকম এক্স আমেরিকা-আফ্রিকার, নিগ্রো-কৃষ্ণা সমাজের, জাতির আত্মসম্মান,স্বাধিনতা সর্বোপরি মানবীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছেন।
কিন্তু এই ম্যালকম এক্স জীবনের শুরুতে এমন ছিলেন না, ছিলেন হতভাগাদেরই একজন। জন্মের মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি তিনার বাবাকে হারান। সেও এক নির্মম ঘটনা। আমেরিকার ভয়ংকর সন্ত্রাসী গোষ্ঠি ক্লু ক্লাক্স ক্লান (Ku Klux Klan) ম্যালকমের বাড়িতে হানা দিয়ে ম্যালকমের বাবা ও চাচাকে হত্যা করে। আসলে নিগ্রো হওয়াটাই ছিল তাদের আপরাধ। এই ভয়াবহ হত্যার শোকে তার মা মানসিক ভারসাম্য হন। আর ম্যালকমের ভাগ্যে জোটে অনাথ আশ্রম।
ওই অনাথ আশ্রমেই ম্যালকম এক্স বড় হতে লাগলেন। পড়া শুনায় তিনি ছিলেন তুখোড়। জুনিয়র হাই স্কুলে, ম্যালকম এক্স একজন অসামান্য ছাত্র হয়ে ওঠেন এবং তার সহপাঠীদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীতে তার পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ, একদিন শিক্ষক ম্যালকমকে বলেন,“বড় হয়ে কি হতে চাও?” উত্তরে তিনি বলেন, “আমি আইনজীবী হতে চাই”। অবঞার হাসি দিয়ে ওই শিক্ষক বলেন, মনে রেখো তুমি কালো, কালোদের এতো বড় উচ্চাশা থাকতে নেই। সেদিনের পর থেকে ম্যালকম এক্স সেই স্কুল ছেড়ে দেন এবং জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধ কর্মে। এমনকি অপরাধের জন্য জেলও খাটেন তিনি।
১৯৪৮ সালে ম্যালকমের ভাই রেজিনাল্ড কারাগার পরিদর্শন করেন এবং ম্যালকমকে বলেছিলেন যে তাকে কারাগার থেকে বের করার একটি উপায় আছে। রেজিলান্ডের পরিকল্পনা ছিল ম্যালকমকে “নেশন অব ইসলাম” (Nation Of Islam) সদস্য হিসাবে তালিকাভুক্ত করা। এভাবেই ম্যালকম এক্স “নেশন অব ইসলাম”(Nation Of Islam) নামক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩০-এর দশকে এলিজাহ মুহাম্মাদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এই ‘Nation of Islam’- এবং বর্ণবাদের বিরোধীতাই ছিল এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ। এভাবে কারাগরে কেটে যায় বহুবছর, ম্যালকম পরিণত হতে থাকেন। ১৯৫২ সালে কারাগর থেকে মুক্তি হয়ে “ম্যালকম” ‘Nation of Islam’ এর প্রধান এলিজা মুহাম্মাদের শিষ্য হয়ে যান, এভাবেই কাটে কয়েক বছর। কিন্তু দিন যত যায়, এলিজা মুহাম্মাদের এবং “নেশন অব ইসলাম” সংগঠনের বিকৃত রুপ ততই প্রকাশ পেতে থাকে। তখনই ম্যালকম শুনতে পান যে এলিজা মুহাম্মাদ ব্যাভিচার করেন এবং তার বহু নারীর সাথে ছিল অবৈধ সম্পর্ক।
ইসলাম গ্রহনঃ এসব দেখে ম্যালকম এক্স কি আর বসে থাকেন, ছেড়ে দেন ‘নেশন অব ইসলাম’, শুরু করেন নতুন এক যাত্রা। এবং সন্ধ্যান করেন সত্যের রাস্তাকে। নতুন রাস্তা সন্ধ্যান করতে গিয়ে, ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন এবং ইসলামের পবিত্র শহর মক্কায় তীর্থ যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন - হজ্জ করেন তিনি।
এই হজ্জ-ই বদলে দেয় ম্যালকমের সকল পূর্ব ধারণা, এবং আবিষ্কার করেন তিনি মিশন। পান করেন সত্য ইসলামের অমিয় সুধা। তীর্থযাত্রার পরে ম্যালকম তার নাম পরিবর্তন করেন। প্রথম পরিবর্তনটি ছিল তার “দাসের নাম ত্যাগ করা”, এবং নতুন পরিবর্তনটি ছিল মুসলিম শিরোনামঃ এলিজা মালিক আশ-শাবাজ।
এবার আর ম্যালকমকে কে পায়? শুরু হয় তার ইসলাম প্রচারের মিশন। বজ্য ও দীপ্ত কন্ঠে তিনি গেয়ে চললেন ইসলামের জয়গান। একে একে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন হাজারো মানুষকে। হাজারো, লক্ষ মানুষ তার ভাষা শোনার জন্য জড়ো হতো, এবং দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আসতে লাগলো। একেই বলে সত্যের শক্তি। সত্য আপন গতিতে বলি আমি বলিয়ান।
অবশেষে, রবিবার ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে নিউ ইর্য়ক শহরে বক্তৃতার অবস্থায় ম্যালকম এক্সকে ১৫টি বুলেট দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল। সেইদিন জীবন দিয়ে তিনি চুমু দেন শহীদি মৃত্যুর পেয়ালাতে। শহীদের মৃত্যু নেই তাই ম্যালকম এক্সের ও মৃত্যু নেই।
শেষকথাঃ ম্যালকম এক্সকে নিয়ে যেন জানার শেষ নেই। সাম্য এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার পথে যদি আসে বাধা-প্রতিবন্ধকতা, তবে চালিয়ে যাও অবিরাম ন্যায়ের সংগ্রাম, পিছনে ফেরার কোনও পথ নেই, এই তো ইসলামের শিক্ষা। আর এই শিক্ষারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল ম্যালকম এক্সের সমগ্র সত্তা জুড়ে। তার কথা বলার দক্ষতা তাকে জন প্রিয়তার শীর্ষ নিয়ে যায়। এক গভীর অপরাধ জগৎ থেকে তার ফিরে আসার কাহিনী সত্যিই লোমহর্ষক। ঠিক আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম এমনই রোমাঞ্চে ঘেরা পরিবেশে মাঝে যখন প্রথম বারেব মত ম্যালকম এক্স- এর আত্মজীবনী পড়ি, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিলো অশ্রু উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম নতুন প্রত্যয়ে।