দক্ষিণ ভারতের উজ্জ্বল দীপ: আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.)-এর জীবন ও অবদান
আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি মলিবারি (রহ.)
এটি ইতিহাসের এক নিঃসংশয় সত্য যে অনেক মহান ব্যক্তি সময়ের ধুলোবালিতে চাপা পড়ে যান। তাঁদের কীর্তি ও অবদান প্রজন্মের কাছে অচেনা ও অজানা থেকে যায়। অথচ তাঁদের জীবন ও কর্মের প্রতিচ্ছবি ভবিষ্যতের দিশারি হতে পারত। এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন কেরালার মাটি থেকে উঠে আসা এক গুণী ও পরিশ্রুত আলেম—আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.), যিনি উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম আহমদ রজা খান বেরেলভী (রহ.)-এর খলিফা ছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজকের প্রজন্মের জন্য প্রায় বিস্মৃত এক নাম। অথচ তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আলোকোজ্জ্বল এবং চিন্তা ও চেতনার এমন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা কেবল কেরালা নয়, গোটা উপমহাদেশের ইসলামি সংস্কৃতির জন্য এক মহামূল্যবান সম্পদ। এমন একজন আলেমের পরিচিতি পুনরুদ্ধার করা ও তাঁর অবদানকে যথাযথভাবে তুলে ধরা শুধু ইতিহাসের প্রতি দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ধর্মীয় কর্তব্যও বটে। যাঁরা সত্যিকার অর্থে সুন্নি আকিদা ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে ধারণ করেন, তাঁদের জন্য এই রত্নসম আলেমের জীবন পাঠ একটি নতুন জাগরণের সূচনা হতে পারে। তিনি শুধু একজন আলেম ছিলেন না; বরং একজন সংস্কারক, আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক এবং যুগ সচেতন চিন্তাবিদও ছিলেন। তাই এ নিবন্ধে আমরা তাঁর জন্ম, শিক্ষা, ইমাম আহমদ রজা (রহ.)-এর সাহচর্য, রচনাবলি ও মৃত্যুসহ সামগ্রিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো প্রসারিত আকারে তুলে ধরব।
পরিচয় ও জন্ম
আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.) ছিলেন এক বংশানুক্রমিক জ্ঞানী পরিবারে জন্ম নেওয়া এক মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি জন্মগ্রহণ করেন কেরালার ঐতিহাসিক অঞ্চল চালিয়ামের একটি প্রতিভাধর পরিবারে, ১৩০২ হিজরির ২৩ জমাদিউস সানীতে। তাঁর পিতা ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ আলেম হযরত আল্লামা কুঞ্জি আলী কাটি মুসলিয়ার (রহ.), যিনি স্বীয় এলাকায় দীনের খিদমতে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তাঁর মাতা ছিলেন ফারিদা বিবি, যিনি রাত্রিকালীন তাহাজ্জুদের মাধ্যমে নিজের ঈমানি পরিচর্যা করতেন এবং সন্তানদের দ্বীনদার ও আল্লাহভীরু মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। এই ধর্মপরায়ণ ও জ্ঞানদীপ্ত পরিবেশে আল্লামা আহমদ কোয়া শালিয়াতি বড় হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আহমদ কোয়া, কিন্তু “শাহাবুদ্দীন” ছিল এক বিশেষ উপাধি, যেটি তাঁর জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক দীপ্তির প্রতীকস্বরূপ ব্যবহৃত হত। তাঁর কুনিয়াত ছিল "আবু সা‘দাত" এবং সাহিত্যিক নাম বা তাখাল্লুস ছিল "আজহার"। এই আজহার উপনামে তিনি বহু কাব্য ও কিতাব রচনা করেন। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত ও প্রভাবশালী গ্রন্থ الفتاوی الأزهرية তাঁর নামানুসারে “আজহারী ফাতওয়া” নামে পরিচিত। তাঁর জীবন ছিল এক সংমিশ্রণ—সাধুত্ব, প্রজ্ঞা, কাব্যপ্রতিভা ও ঈমানদারিত্বের। এই পরিচয় শুধু একজন মানুষকে তুলে ধরে না, একটি যুগের প্রতিচ্ছবিকেও তুলে ধরে, যেখানে আলেমরা ছিলেন একইসাথে সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক এবং আত্মশুদ্ধির পথপ্রদর্শক। তাঁর জন্মের দিনটি ছিল ইসলামের জন্য এক নীরব কিন্তু গৌরবোজ্জ্বল শুভক্ষণ।
প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চতর বিদ্যা অর্জন
আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.)-এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার দিকনির্দেশনায়। একজন বিশিষ্ট আলেমের সন্তান হিসেবে তাঁর জ্ঞান চর্চার যাত্রা শুরু হয়েছিল খুব ছোট বয়সে। তিনি শৈশবেই কুরআন হিফজ করেন এবং আরবী, ফারসী ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরে তিনি কেরালার প্রখ্যাত আলেম আল্লামা চ্যাল্লু ইগত কুঞ্জি আহমদ হাজী মুসলিয়ার (রহ.) এবং সুফি সাধক আলি মুসলিয়ার (রহ.)-এর নিকট উচ্চতর দারস ফাখরি পাঠ করেন। উল্লেখ্য, “দারস ফাখরি” ছিল কেরালার ঐতিহ্যবাহী একটি পাঠ্যক্রম, যা মূলত ক্বাযী ফখরুদ্দীন আবু বকর শালিয়াতি (রহ.) দ্বারা প্রণীত। এই পাঠক্রমে যুক্তি, ফিকহ, ভাষা ও তাফসীর বিষয়ক প্রধান কিতাবগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য যান দক্ষিণ ভারতের অন্যতম ইসলামী প্রতিষ্ঠান জামিয়া লতীফিয়া, ভেলোর শরীফে। এখানেই তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও মেধার উন্মেষ ঘটে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি এমন পারদর্শিতার প্রমাণ দেন যে, তাঁকে ছাত্রাবস্থায়ই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর গভীর বোঝাপড়া ও যুক্তিশক্তি দেখে তাঁর শিক্ষকেরা তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেন। সেখানে তিনি শুধু পাঠদানে থেমে থাকেননি, বরং দারুল ইফতায়ও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৩২৯ হিজরিতে জামিয়া লতীফিয়া থেকে তিনি দস্তারবন্দি হন এবং ওলামায়ে আহলুস সুন্নাহর স্বীকৃতি লাভ করেন। এই দস্তারবন্দি ছিল তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এরপর তিনি হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে শিক্ষকতা ও ইলমের খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন, যার মাধ্যমে তিনি পরবর্তীতে বেরেলি শরীফে যাওয়ার পথে প্রস্তুত হন
ভারতের মাটির গৌরব ও জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য
ভারতবর্ষ, বিশেষত উপমহাদেশ, ইসলামী জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা, সুফিবাদ এবং গবেষণার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ধারণ করে আছে। এদেশের মাটি শুধু কৃষিকার্য ও অর্থনীতিতে উর্বর নয়, বরং এই মাটির প্রতিটি কণিকায় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সুগন্ধ মিশে আছে। যুগে যুগে এই ভারতবর্ষে এমন সব মহান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁদের আলো কেবল দেশ নয়, সারা মুসলিম দুনিয়াকে আলোকিত করেছে। হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, মন্তক, ফালসাফা, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্বসহ বহু জ্ঞানের শাখায় ভারতীয় আলেমদের অবদান অমলিন ও চিরন্তন। দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, হায়দরাবাদ, বেরেলি, করাচি থেকে শুরু করে কেরালা পর্যন্ত জ্ঞানচর্চার যে ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছে, তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য এক প্রেরণার উৎস। এমন এক ভূখণ্ডে ইমাম আহমদ রজা বেরেলভী (রহ.)-এর মত একজন চিন্তাশীল ও অপ্রতিরোধ্য ইসলামী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং এটি একটি ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্যের স্বাভাবিক পরিণতি। এখানকার আলেমরা শুধু জ্ঞানের বাহক ছিলেন না, তাঁরা নিজেদের জীবনে তাকওয়া, খিদমতে দ্বীন ও আধ্যাত্মিক উন্নতির অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ মাটিতে এমন আলেম ও সুফিগণ জন্মেছেন, যাঁরা রাজা-বাদশাহদের উপেক্ষা করে দরিদ্রদের মাঝে দ্বীনের শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই মাটি পেয়েছে এমন শিক্ষাগুরু, যারা তাদের কলমকে তরবারির চেয়েও ধারালো করে গোমরাহী ও বাতিল মতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এই ভূখণ্ডের বুক চিরেই জন্ম নিয়েছেন শাহ আবদুল আযীয দেহলভী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী, আল্লামা ফজল হক খইরাবাদী, আল্লামা ফজল রসূল বাদায়ূনী এবং পরবর্তীকালে ইমাম আহমদ রজা খান বেরেলভী (রহ.)। এই ধারাবাহিকতারই একটি উজ্জ্বলতম দীপ্তি ছিলেন আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.)।
জ্ঞানের অমর ধারায় ফাযিল বেরেলভীর আগমন
ইসলামি দুনিয়ায় ১৪ শতকের প্রথমার্ধে এমন একটি দীপ্তমান নক্ষত্র উদিত হয়েছিলেন, যাঁর নাম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তিনি হলেন আল্লামা ইমাম আহমদ রজা খান বেরেলভী (রহ.)। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমন ছিল, যা চিন্তা, অধ্যয়ন, সাধনা ও আধ্যাত্মিকতা—সবকিছুর সম্মিলিত প্রতিফলন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন জ্ঞানের সাগর, ইজতিহাদের যোগ্য মুজতাহিদ, ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমী, রাসূলপ্রেমিক এবং সুন্নি আক্বীদার একনিষ্ঠ রক্ষক। উনিশ শতকের ব্রিটিশ ভারতে যখন দ্বীনের বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নে বিভ্রান্তি ও বাতিল মতাদর্শের আগমন ঘটেছিল, তখন ইমাম আহমদ রজা (রহ.) দৃঢ় কণ্ঠে সুন্নিয়ত ও খতমে নবুয়তের পতাকা বহন করে দ্বীনের মূলধারা রক্ষা করেছিলেন। তাঁর কলম ছিল অপরাজেয়, তাঁর যুক্তি ছিল অদম্য, আর তাঁর লেখনীর প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। তিনি শুধুমাত্র একজন মুফতি নন, বরং একজন যুগান্তকারী চিন্তাবিদ, একজন সংস্কারক এবং রাসূলপ্রেমিকদের এক অনন্য নেতা। তাঁর লেখার ভাষা ছিল সাবলীল, গবেষণামূলক এবং সহজবোধ্য। তিনি নিজের জীবনে এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, যা পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে দীপ্তি ছড়িয়েছে। তাঁর ফাতওয়া সংগ্রহ, ফতাওয়া রজভিয়া, আজও সুন্নি উলামায়ে কেরামের কাছে মাইলফলকস্বরূপ। তাঁর হাতে বহু আলেম ও ফকীহ গড়ে উঠেছিলেন, যাঁদের মধ্যে এক অমূল্য রত্ন ছিলেন আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.)। ফাযিল বেরেলভীর এই ছাত্র শুধু দক্ষিণ ভারতের নয়, বরং গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গর্বের নাম।
ইমাম আহমদ রজা (রহ.)-এর বৈশ্বিক প্রভাব ও দক্ষিণ ভারতের সংযোগ
ইমাম আহমদ রজা খান বেরেলভী (রহ.)-এর জ্ঞানের দীপ্তি কেবল হিন্দুস্তানের সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তাঁর কলমের স্রোত ও চিন্তার গভীরতা সমগ্র ইসলামি জগতে সাড়া জাগিয়েছিল। আরব, আজম, হারামাইন শরীফাইন, আফ্রিকা, ও দক্ষিণ এশিয়ার বহু অঞ্চল তাঁর ফতোয়া ও মতাদর্শের আলোয় আলোকিত হয়েছিল। তাঁর চিন্তাধারা ছিল সুন্নিয়তের মূল আকিদার ওপর দৃঢ়, এবং তাঁর ফতোয়াগুলোর বৈজ্ঞানিক যুক্তি, কুরআন-হাদীসের অকাট্য দলিল, এবং গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ চিন্তাশীল মুসলিমদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। এমন একজন আলেমের প্রভাব কতটা বিস্তৃত ছিল, তা বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে সাত সাগরের ওপারেও তাঁর চেতনা ও দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল। কেরালার মালাবার অঞ্চলের এক প্রজ্ঞাবান তরুণ যখন ফাযিল বেরেলভী (রহ.)-এর জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সাগর থেকে সেচ নিতে বেরেলি শরীফে পৌঁছান, তখন সেটি শুধু এক ছাত্রের সফর ছিল না, বরং এটি ছিল দুই আলোকময় সত্তার মিলন, যার মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতে সুন্নিয়তের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেই গুণী ব্যক্তি ছিলেন আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.)। তিনি বেরেলিতে শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন করেই ক্ষান্ত হননি, বরং উচ্চতর ফিকহি ইজাজত, আধ্যাত্মিক খিলাফত এবং সুন্নি আকিদায় দৃঢ়তা লাভ করে নিজের মাতৃভূমি কেরালায় ফিরে আসেন। এরপর তিনি হয়ে ওঠেন মালাবার অঞ্চলের ইসলামী দিশারি। তাঁর মাধ্যমে ইমাম আহমদ রজার চিন্তা, দর্শন এবং প্রেমধারায় কেরালা সিক্ত হয়। আল্লামা শালিয়াতি (রহ.) ছিলেন ফাযিল বেরেলভীর আদর্শের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি এবং দক্ষিণ ভারতের সেই আলো, যা বহুকাল অন্ধকার দূর করেছে।
ইমাম আহমদ রজা বেরেলভীর সাহচর্য ও উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ
জামিয়া লতীফিয়া থেকে সফলভাবে স্নাতক হওয়ার পর, আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.) দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষকতা ও ফতোয়া প্রদান ইত্যাদিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তাঁর তৃষ্ণার্ত আত্মা তখনও ইলম ও ফিকহের আরও গভীর জ্ঞানের সন্ধানে ব্যাকুল ছিল। শেষপর্যন্ত, তাঁর পীর ও মুরশিদের নির্দেশে তিনি ভারতের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ইলম ও তাকওয়ার আলোকপীঠ—বেরেলি শরীফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি পৌঁছেই স্বয়ং ইমাম আহমদ রজা খান বেরেলভী (রহ.)-এর সান্নিধ্যে আসেন। এই সাক্ষাৎ কেবল একটি সাধারণ ওস্তাদ-শাগরিদের সম্পর্ক ছিল না; বরং এটি ছিল এক আলোকিত আত্মার আরেক আত্মার সাথে মিলন। বেরেলি শরীফে তিনি ফিকহ, হাদীস, তাফসীর, ক্বাওয়ায়েদ, মন্তিক, কালামসহ বহু শাস্ত্রে উচ্চতর তালিম নেন এবং ফাজিলে বেরেলভী (রহ.)-এর কাছ থেকে বিশেষত হানাফি ফিকহে ফতোয়া লেখার অনুমতিপত্র (ইজাযত) গ্রহণ করেন। তাঁর এই ইজাযতলব্ধ জ্ঞানের প্রমাণ তিনি নিজের লেখায় উল্লেখ করেছেন, যেমন: “ما ارويه عن علامۃ المؤید والفہامۃ المسدد...”। এই সনদ তাঁকে ভারতবর্ষের একজন প্রভাবশালী ফকীহ এবং সুন্নি আকিদার ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। মজার বিষয় হলো, তিনি ফক্বহে হানাফি ছাড়াও অন্যান্য তিন মাযহাব—شافعی، مالكی ও حنبلی—তথ্যেও সুদক্ষ ছিলেন, যা তাঁর বহুমাত্রিকতা ও গবেষণার প্রগাঢ়তাকে নির্দেশ করে। তাঁর এই জ্ঞান ও তাফাক্কুহের প্রমাণ মিলে মলয়ালম ইসলামী বিশ্বকোষের রেফারেন্সেও। বেরেলিতে তাঁর উপস্থিতি কেবল দক্ষিণ ভারতের গর্ব ছিল না, বরং পুরো সুন্নি দুনিয়ার জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক সংযোগ।
বায়আত ও খিলাফত: শরীয়ত ও তরীকতের সমন্বয়
ইলমে শারঈ-এ পূর্ণ পারদর্শিতার পর আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.) তাঁর অন্তরকে আধ্যাত্মিক শুদ্ধির দিকে ধাবিত করেন। একজন সত্যিকার আলেম যেমন শরীয়তের গভীর জ্ঞান রাখেন, তেমনি তিনি তাসাওউফ তথা তরীকতেরও অনুসরণকারী হন। তিনি হিজায শরীফ সফরের সময় মক্কা মুকাররমায় অবস্থানকালে বিশিষ্ট সুফি ও মুফতি হযরত শায়খ মুহাম্মদ হিব্বুদ্দীন সুলায়মান আহসিকি (রহ.)-এর হাতে কাদরিয়া তরীকতের বায়আত গ্রহণ করেন। এ বায়আতের মাধ্যমে তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন নতুন গতি পায় এবং তাসাওউফের উন্নত পর্যায়ে তিনি উপনীত হন। উল্লেখ্য, তিনি এর পূর্বেই ফাযিলে বেরেলভীর (রহ.) কাছ থেকে রজভিয়া-বারকাতিয়া তরীকতের বায়আত ও খিলাফতও লাভ করেছিলেন। ফলে তিনি একাধারে দুই মহান তরীকতের উত্তরসূরি হয়ে ওঠেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, তাকওয়া ও জ্ঞানের গভীরতা তাঁর মুরশিদগণকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তাঁকে খিলাফতের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদান করেন, যাতে তিনি আগত প্রজন্মকে পথ দেখাতে পারেন। তিনি নিজ গ্রামে ফিরে এসে শরীয়তের পাশাপাশি তরীকতের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন এবং অসংখ্য মুরিদ, আশিক ও অনুসারী তাঁর দরবারে দীক্ষা লাভ করতে থাকেন। তাঁর সান্নিধ্যে মানুষ শুধু জ্ঞানই অর্জন করত না, বরং অন্তরগত পবিত্রতার স্বাদও পেত। তাঁর তরবিয়তী মজলিস ছিল আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির কেন্দ্র। এইভাবে আল্লামা শালিয়াতি (রহ.) শরীয়ত ও তরীকতের এক অসাধারণ সমন্বয় সাধন করেন, যা আজকের প্রজন্মের জন্য এক অনুপম আদর্শ
রচনাবলী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম
আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.) কেবল জ্ঞান অর্জনেই থেমে যাননি, বরং তিনি কলমকেও একটি তরবারিতে রূপান্তর করেছিলেন। তাঁর লেখনি ছিল আগ্নেয় অস্ত্রের মতো, যা বাতিল মতবাদ ও ভ্রান্ত আকিদাকে নিঃসারে ধ্বংস করত। তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো الفتاوی الأزهرية—যা শরয়ি মাসায়েল, ফতোয়া, আকীদা, তাসাওউফ এবং সমকালীন সমস্যার সমাধানমূলক আলোচনায় পূর্ণ। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: دفع الشر الاثیر عن الخیر الکثیر, شرح الارشادات الجفریۃ, تحقیق المقال, منائح النیل, الکلام الحاوی, الحکم الراسخ, المورد الأزهر فی مولد النبی الأطهر ﷺ প্রভৃতি। এসব গ্রন্থে তিনি বিশেষত ওহাবি, সালাফি ও দেওবন্দি মতবাদের বিরুদ্ধে সুন্নি আকীদার পক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী দলিল উপস্থাপন করেন। যেমন, এক স্থানে তিনি লিখেন: "هٰذا کتاب رأس الوهابیة فی الهند..." ইত্যাদি। এই বক্তব্যে তিনি 'তাকওইয়াতুল ঈমান' বইয়ের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে চিহ্নিত করেন এবং এর বিরুদ্ধে যুক্তিনিষ্ঠ প্রতিবাদ জানান। তিনি মালাবারে দেওবন্দি ও তাবলীগি চিন্তার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাচীর তৈরি করেন। তাঁর কলম ছিল নির্ভীক, স্বচ্ছ, এবং সত্যবাদী। তিনি সুন্নিয়তের মোহরা হয়ে কেরালার ইসলামি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
কবিতা, সাহিত্যপ্রতিভা ও আধ্যাত্মিক কাব্যধারা
আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.) কেবল একজন বড় মাপের ফকীহ, মুফতি ও মحدثই ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন সূক্ষ্ম রুচির কবিও। তাঁর সাহিত্যিক সত্ত্বা তাঁর নামের তাখাল্লুস ‘আজহার’-এর মাধ্যমেও প্রতিফলিত হতো। এই তাখাল্লুসে তিনি বহু কাব্য রচনা করেন, যা চিন্তা, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়। তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য ছিল রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রেম, সুন্নি আক্বীদার গৌরব, বাতিল মতাদর্শের বিরোধিতা, এবং আধ্যাত্মিক চেতনা। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘نحس الأيام' (অশুভ দিনসমূহ) নিয়ে রচিত, যেখানে তিনি বছরের বিভিন্ন দিন ও মাসের সুখ-দুঃখপূর্ণ ব্যাখ্যা কাব্যিক ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। এটি শুধু এক কবিতা নয়, বরং একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার সমন্বিত প্রয়াস। যেমন, তিনি লেখেন:
"اذا اردت النحس من ایام
و سنۃ و جمعا علی التمام
فاول الایام من کل الشہر
خیر لکل حاجۃ فالینتظر..."
এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত করেন, কোন কোন দিন আশীর্বাদপূর্ণ এবং কোন দিন কোনো কর্ম শুরু করা অনুচিত। তাঁর কবিতাগুলো কেবল ছন্দমাত্রিক নয়, বরং এগুলোর মধ্যে একটি আলোকোজ্জ্বল বার্তা নিহিত রয়েছে। তাঁর সাহিত্য ছিল শ্রুতিমধুর, ভাবগভীর এবং চিন্তাশীল। মালাবারে তাঁর কবিতা বহু ইসলামিক মজলিসে পাঠ করা হতো এবং আজও কেরালার বিভিন্ন কিতাবে ও মাদরাসার পাঠক্রমে সেগুলোর স্থান রয়েছে। তাঁর লেখনীর মাঝে যে আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য ও ভাষার শ্রেষ্ঠতা পাওয়া যায়, তা উপমহাদেশের সাহিত্য-ঐতিহ্যে তাঁকে এক বিশিষ্ট স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।
হায়দরাবাদের দারুল ইফতা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.) কেবল কেরালার সীমারেখায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত হায়দরাবাদে তাঁর দীপ্ত উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি একাধিক বছর হায়দরাবাদের “সদারতুল আলিয়া” তথা শাসক মহলের অধীনে ‘মুфти’ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেখানে তিনি শরয়ি ইস্যুগুলোর উপর ফতোয়া দিতেন এবং দারুল ইফতার দায়িত্বে ছিলেন। এই ইফতার বিভাগটি ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দফতর, যেখানে আইন, সমাজনীতি ও শরীয়তের ভারসাম্য রক্ষা করা হতো। তাঁর ইজতিহাদ ও ফিকহি গভীরতা তাঁকে এই পদে উত্তীর্ণ করেছিল। তাঁর বহু ফতোয়ার চিঠি এখনও গবেষকদের হাতে পাওয়া যায়, যা তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা, যুক্তির শক্তি এবং সুন্নি আকিদার প্রতি অনড় অবস্থানকে নির্দেশ করে। এছাড়াও তিনি কিছু রাজপরিবারের শিক্ষাগুরু হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। সুলতানাত-ই-নিযামী (হায়দরাবাদ) সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে গবেষণা ও রচনার জন্য মাসিক ভাতা প্রদান করা হতো। এমনকি তাঁর জন্য একটি পৃথক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে দুর্লভ ইসলামি কিতাব সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করেন। আজও সেই গ্রন্থাগারের কিছু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি কেরালায় সংরক্ষিত আছে, যেগুলোতে ইসলামী চিন্তা, ফিকহ, আধ্যাত্মিকতা ও রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। হিজায ও অন্যান্য দেশের উলামায়ে কেরাম যখন কেরালায় আসতেন, তখন তাঁর সংরক্ষিত গ্রন্থ থেকে ফটোকপি ও স্ক্যান করিয়ে নিয়ে যেতেন। তাঁর এই ভূমিকা শুধু ইসলামি গবেষণার একজন পথিকৃৎ হিসেবে নয়, বরং ইতিহাসে এক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত স্কলার হিসেবেও তাঁকে স্মরণীয় করে রাখে।
ইন্তিকাল, জানাজা ও ইতিহাসে স্মরণীয় অবদান
সময় একদিন থেমে যায়, দুনিয়ার সকল চিহ্ন একদিন মুছে যায়—তবু যারা আল্লাহ ও রাসূল ﷺ-এর প্রেমে দগ্ধ হয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেন, তাঁদের স্মৃতি চিরজাগরুক থেকে যায়। ২৭ মুহাররম ১৩৭৪ হিজরি, রবিবারের এক বিষণ্ণ প্রভাতে আল্লামা শাহাবুদ্দীন আহমদ কোয়া শালিয়াতি (রহ.) দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরলোকগমন করেন। তাঁর ইন্তিকালের সংবাদ বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, হায়দরাবাদসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। শত শত, হাজার হাজার মানুষ তাঁর শেষ জানাযায় অংশ নিতে ছুটে আসেন। ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা যায়, প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ তাঁর জানাজায় শরিক হন, যা উপমহাদেশের ইসলামি ইতিহাসে এক বিরল নজির। তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয় তাঁর নিজ গ্রাম চালিয়ামেই, এবং সেখানেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদের আঙিনায় তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তাঁর ইন্তিকালের মাধ্যমে শুধু কেরালা নয়, গোটা সুন্নি দুনিয়া এক মহান অভিভাবককে হারায়। কিন্তু তিনি রেখে যান এক দীপ্ত জীবন, অসংখ্য গ্রন্থ, হাজার হাজার ছাত্র, এবং একটি সুমহান চিন্তার উত্তরাধিকার। আজও তাঁর কবর জিয়ারতের স্থান, তাঁর কিতাব ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য, এবং তাঁর নাম একটি অনুপ্রেরণার প্রতীক।