গুয়াদালেটের যুদ্ধ: সভ্যতার মোড় পরিবর্তনের একটি অধ্যায়

গুয়াদালেটের যুদ্ধ (৭১১ খ্রিস্টাব্দ) ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা স্পেনের ইসলামী শাসনের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয় মুসলমান এবং পশ্চিমা গোথ (Goths) সম্প্রদায়ের মধ্যে। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন হযরত তারিক ইবনু যিয়াদ এবং শত্রুপক্ষের সেনাপতি ছিল গোথ সাম্রাজ্যের বাদশা রদ্রিগো (Rodrigo); ইসলামের ইতিহাসে যে রডারিক (Roderick) নামে পরিচিত। যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভ হয়, যা পশ্চিমাদের এ গোথ সাম্রাজ্যকে পতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। পাশাপাশি আইবেরিয়া উপদ্বীপাঞ্চলের অধিকাংশ ভূমিই উমাইয়া খিলাফাতের কর্তৃত্বের অধীনে চলে আসে। 

তারিক ইবনে জিয়াদের কৌশল 

১৬ হিজরির শাবান মাস। মাত্র সাত হাজার মুসলিম সেনা নিয়ে গঠিত হয়েছে তারিক ইবনু যিয়াদের বাহিনী। মুসলমানদের নিয়ে তিনি 'জাবাল আত-তারিক' বা জিব্রাল্টারের সংকীর্ণ গিরিপথ পাড়ি দিলেন। পাথুরে সরু গিরিসংকীর্ণ এরিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে এই পাহাড়ের কোলে দিগ্বিজয়ী সেনাপতি তারিক ইবনু যিয়াদ যাত্রাবিরতি করেছিলেন বলেই, তাকে 'জাবাল আত-তারিক' নামে অভিহিত করা হয়। সেই সূত্র ধরে আজ পর্যন্ত—এমনকি স্পেনের ভাষায়ও-এই পাহাড়কে 'জাবাল আত-তারিক' এবং সেই গিরিপথকে 'মাযিকু জাবাল আত-তারিক' নামে স্মরণ করা হয়। সেখান থেকে সেনাপতি তারিক ইবনে যিয়াদ যাত্রা করেন 

যুদ্ধ শুরু হলো। দুপক্ষের কাউকেই তখনো জয়ী বা পরাজিত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারিক ইবনু যিয়াদের কাছে তাদের হার মানতে হলো। পরাজিত সেই রক্ষীবাহিনীর প্রধান সম্রাট রডারিকের কাছে গোপনে একটি পত্র লিখে দ্রুত পাঠিয়ে দিল। সম্রাট তখন আন্দালুসের রাজধানী টলেডোতে অবস্থান করছে। চিঠিতে সে সম্রাট রডারিককে বলল: 'শত্রুরা তোমার নাগাল পেয়ে গেছে, হে রডারিক! কেননা আমাদের শহরে এসেছে এমন এক সেনাদল, যারা পৃথিবীর মাটিমানুষ, নাকি আসমান থেকে আগত কোনো বিজয়ের দেবদূত-আমাদের জানা নাই। 

সত্যিই তো! এ সোনার মানুষেরা তো তাদের কাছে অপরিচিতই। তারা তো জানত, কোনো শহরের বিজেতা বা দখলদার মানেই-তার কাজ হবে, সে-শহরে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে; সহায়-সম্পদ লুট করবে, ক্ষেত্রবিশেষ শহরে চালাবে ভয়ানক গণহত্যা। কিন্তু এরা এমন মানুষ পাবে কোথায়? যারা ধর্ম গ্রহণের আহ্বান করে শহরের সকল সম্পদ রেখ যায় শহরেই অথবা বলে জিযিয়া কর দিতে, তাহলে শহরকে রেখে যাবে আগের নিরাপত্তায়। এমন সেনাদল তারা না দেখেছে যাপিত জীবনে, না জেনেছে বিগত দিনের দীর্ঘ ইতিহাসে। এছাড়া এ আসমানি সেনাদল যুদ্ধের ময়দানে যেমন দক্ষ ও যোগ্য; রাতের আঁধারে তেমন বিনিদ্র নামাযি, ইবাদতকারী। তাই সম্রাট রডারিকের কাছে পাঠানো রক্ষীদলের সেনাপতির এমনটা লেখারই কথা যে, এরা পৃথিবীর মাটিমানুষ, নাকি আসমান থেকে আগত কোনো বিজয়ের দেবদূত-আমাদের জানা নাই।

রাব্বুল আলামিন তাঁর পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:  أُوْلَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُون তারাই আল্লাহর দল। জেনে রেখো, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। (সুরা মুজাদালাহ: আয়াত-২২)

বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র

রক্ষীদলের সেনাপতির পাঠানো পত্র পেয়েই সম্রাট রডারিক যেন পাগল হয়ে গেল। অহংকার ও দম্ভ তাকে অন্ধ করে দিল। মুসলমানদের মোকাবেলার জন্য উত্তর থেকে এক লক্ষ অশ্বারোহী দল সে দক্ষিণে এনে হাজির করল। বিপরীতে তারিক ইবনু যিয়াদের সাথে কেবল সাত হাজার মুসলিম সেনা, যাদের অধিকাংশই পদাতিক এবং হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনই ঘোড়সওয়ার। রডারিকের পাগলামি দেখে তিনি সাত হাজার সেনাকে এক লক্ষ অশ্বারোহীর সামনে তুলনা করেই তিনি চমকে উঠলেন। মূলত এই তুলনা কেবল কঠিনই নয়, বরং এর আনুপাতিক কোনো তুলনা আসলে হতেই পারে না। দেরি না করে তিনি আরেক সেনাপতি মুসা ইবনু নুসাইরের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখলেন। তিনি সাথেসাথে তারিফ ইবনু মালিকের নেতৃত্বে পাঁচ হাজার পদাতিক সেনা পাঠিয়ে দিলেন। তারিফ ইবনু মালিক তারিক ইবনু যিয়াদের কাছে এসে পৌঁছলে তাঁর বাহিনীর সেনা দাঁড়াল মোট বারো হাজারে। 

এবার তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত একটি ভূমির খোঁজ করলেন। তাঁর অনুসন্ধান তাকে পৌঁছে দিল এমন এক যুদ্ধক্ষেত্রে, ইতিহাস যাকে 'ওয়াদি আল-বারবাত' নামে চেনে। সেনাপতি তারিক ইবনু যিয়াদের যুদ্ধের জন্য এই ভূমিটি বেছে নেয়ার বেশকিছু সামরিক এবং গভীর কৌশলগত কারণ ছিল। ভূমিটির ডানে ও পেছনে ছিল সুউচ্চ পাহাড়, যা মুসলিম বাহিনীর পেছনভাগ এবং ডান অংশকে রক্ষা করবে। ফলে কেউই মুসলমানদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে নিতে পারবে না। এর ডান দিকে ছিল বিশাল সমুদ্র, অতএব এদিকটা মুসলমানদের জন্য ছিল একেবারেই নিরাপদ। দক্ষিণের প্রবেশপথে তিনি তারিফ ইবনু মালিকের নেতৃত্বে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন শক্তিশালী এক ক্ষুদ্র সেনাদল; ফলে চাইলেই শত্রুরা এ-দিক থেকে অতর্কিত হামলে পড়তে পারবে না। সুতরাং মুসলিম বাহিনীর সামনের দিক থেকে কুরুক্ষেত্রে প্রবেশ করা ছাড়া খ্রিস্টান সেনাবাহিনীর আর কোনো পথ খোলা থাকল না। তাদেরকে পেছন থেকে বিপদে ফেলার বা চারপাশ থেকে বেষ্টন করার সব পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

দূর থেকে দেখা গেল উন্নত শোভাকর পোশাকে রডারিক আসছে। গায়ে স্বর্ণখচিত জামা, মাথায় সোনার তাজ। দুটো গাধা টেনে আনছে তার স্বর্ণের সিংহাসন। যুদ্ধ ও লড়াইয়ের এমন রুক্ষ সময়েও বোকা বাদশা তার পার্থিব বিলাস ভুলতে পারেনি। এক হাজার প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী নিয়ে সে আয়েশী ভঙ্গিতে সামনের দিকে হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। বাহিনীর সাথে কিছু খচ্চরের পিঠে দেখা গেল কিছু রশির বোঝা; যুদ্ধ শেষে মুসলমানদেরকে বেঁধে গোলাম বানিয়ে নিয়ে যাবে বলে সম্রাটের নির্দেশে সেগুলো আনা হয়েছে। সে তার গর্ব ও অহমিকাবশত ভেবেই নিয়েছে যুদ্ধ তার পক্ষে যাবে। তার স্পষ্ট কথা ও অনুমানে বারো হাজার মিসকিন মুসাফির তো কেবল আমাদের দয়া ও অনুগ্রহই পেতে পারে। স্বদেশী লক্ষ সেনার সামনে তারা কেবল আনুকূল্য পাবারই যোগ্য!

রাব্বুল আলামিন তাঁর পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন:  وَلَن يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَفِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا'এবং আল্লাহ কিছুতেই কাফেরদেরকে মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব দান করবেন না।' (সুরা নিসা: আয়াত-১৪১)

অতএব বালু-পাথরের রুক্ষ ভূমির এ-রক্তযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু যারা হিযবুল্লাহ-আল্লাহর দল, তারা রয়ে যাবে পূর্বের মতো-অবিচল, অনঢ় এবং বিশ্বাসদৃঢ়। ভূমধ্যসাগরের একদিকে চলছে পবিত্র ভূমি দখলের লড়াই, অন্যদিকে চলছে আল- আন্দালুস থেকে মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করার চেষ্টা। ১০৭৬ সালের দিকে স্পেনের টোলেডো শহর দখল করে নেয় ষষ্ঠ আলফোন্সো, একসময়ের ভিজিগথ রাজধানী ছিল এই শহর। পরবর্তী ১৫০ বছর আইবেরীয় উপদ্বীপের মানচিত্র একইরকম থাকে। অবশেষে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৃতীয় ফার্নান্দো কর্ডোবা আর সেভিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নেন, অন্যদিকে আরাগনের প্রথম জায়ুম দখল করে নেন ভ্যালেন্সিয়া শহর। ৬০০ বছর ধরে রাজত্ব করা বিশাল খিলাফতের হাতে অবশিষ্ট থাকে শুধু গ্রানাডা, তাও সেখানেও নিয়মিতভাবে হানা দিতে থাকে ক্রুসেডার বাহিনী। 

গুয়াদালেটের যুদ্ধের দ্বারা শিক্ষা

গুয়াদালেটের যুদ্ধ থেকে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, অভ্যন্তরীণ ঐক্যের অভাব একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হতে পারে। ভিসিগথিক রাজ্য যদি ঐক্যবদ্ধ থাকত, তবে মুসলিম বাহিনীর পক্ষে এত সহজে বিজয় লাভ করা সম্ভব হত না।

যুদ্ধের পরবর্তী পরিবর্তন

আন্দালুসে মুসলিমদের রাজনৈতিক পতনের সাথে সাথে এর শিক্ষা-সংস্কৃতির পতনও শুরু হয়ে যায়। মুসলিম অভিজাতদের বেশিরভাগই চলে যায় উত্তর আফ্রিকা কিংবা আরব অঞ্চলে, যদিও সাধারণ জনগণদের বেশিরভাগ গ্রানাডাতেই থেকে যায়। গ্রানাডাতেও ইহুদিরা একইভাবে সুরক্ষা পেতে থাকে, যেরকমটা তারা কয়েকশ বছর ধরে পেয়ে আসছে। খ্রিস্টান শাসকরা আন্দালুসীয় চিত্রকলা, স্থাপত্যকলা আর বিজ্ঞানের বেশ বড় মাপের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। টোলেডো খ্রিস্টানরা দখল করে নিলেও এরপরেও কয়েকশ বছর আরবি শেখার অন্যতম পীঠস্থান ছিল এই শহর। দশম আলফোন্সো সেভিলে আরবি শেখার জন্য আলাদা স্কুল তৈরি করে দেন, আন্দালুসীয়দের বিজ্ঞান আর দর্শনশাস্ত্রেও আগ্রহী ছিলেন তিনি। তার সময়ে মুসলিম আর ইহুদিরা নিজেদের ধর্ম পালন করার সমান সুযোগ-সুবিধা পেত। ভ্যালেন্সিয়াতেও প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরবি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল।

যদিও খ্রিস্টান শাসকদের এই উদারমনা অবস্থা বেশিদিন চলেনি, যখন প্রথম ইসাবেলা 'দ্য ক্যাথলিক' এবং আরাগনের দ্বিতীয় ফার্দিন্যান্দ যৌথভাবে স্পেন শাসন করা শুরু করেন। যদিও ফার্দিন্যান্দ ভ্যালেন্সিয়া আর আরাগনে থাকা মুসলিমদের প্রতি বেশ উদার ছিলেন, কিন্তু ইসাবেলা ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। অবশেষে ১৪৯২ সালে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ছোট্ট গ্রানাডার উপর আক্রমণ চালান তারা দুজন, দখল করে নেয় আল-হামরা থেকে শুরু করে সাধারণ বাড়িঘর। ঐ বছরেই ইহুদিদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, স্পেনে থাকতে হলে খ্রিস্টান হতে হবে অথবা চলে যেতে হবে। আর এভাবেই স্পেনের মাটি থেকে হারিয়ে যায় একসময়ে পৃথিবীর ওপর রাজত্ব করা আল-আন্দালুস। 




Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter