হজরত মুসা (আঃ) -এর সঙ্গে খিজির (আঃ)-এর সাক্ষাত

ইসলামিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল হজরত মুসা (আঃ) -এর সঙ্গে খিজির (আঃ) সাক্ষাত। সহিহ বুখারি শারিফে হজরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) থেকজে বর্ণিত রয়েছে যে- রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন -- একবার মুসা (আঃ) বানী ইসরাঈলের এক সভাই আলোচনা করছিলেন। এমন অবস্থাই কেউ একজন বাক্তি প্রশ্ন করলেন-- হে মুসা (আঃ) বর্তমানে সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তিনি ভেবেছিলেন বর্তমানে আমিই আল্লাহর মনোনীত রসুল, সুতরাং আমিই জ্ঞানী। তাই তিনি উত্তরে বললেন আমিই সবথেকে জ্ঞানী। এই উত্তর আল্লাহর পছন্দ হলনা । হজরত মুসা (আঃ) -এর উচিত ছিল যে আল্লাহর উপর বিষিটি ছেড়ে দিয়ে বলা যে, আল্লাহ সবথেকে জ্ঞানী আল্লাহ ভাল জানেন । অতঃপর আল্লাহ  মুসাকে (আঃ) এর উপর  আয়াত নাযিল করেন এবং খিজির (আঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করার পরামর্শ দিলেন ।

 

হজরত খিজির (আঃ) কে?

হজরত খিজির (আঃ)-এর পরিচয় নিয়ে অনেক মতামত পাওয়া যাই । তার প্রকৃত নামের বিশ্বয়ে চারটি নাম পাওয়া যাই। ১- বালইয়া বিন মালকান ২- ইলইয়া বিন মালকান ৩- খজরুন ৪- মুআম্মায়।

তিনি নবী ছিলেন না নবী ছিলেন না এর ব্যাপারেও অনেক মতামত রয়েছে। কারো মতে তিনি নবী ছিলেন আবার কারো মতে তিনি একজন আল্লাহর ওয়ালি ছিলেন । কেও কেও বলেন তিনি এখন কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন আবার কেও বলে তিনি এখন আর জীবিত নেই । এইরকম ভাবে অনেক দ্বন্দ্ব রয়েছে।

 

হজরত মুসা (আঃ) -এর সঙ্গে খিজির (আঃ)-এর সাক্ষাতঃ -

আল্লাহ তায়ালা যখন মুসা (আঃ) কে বললেন দুই সাগরেরে ভিতরে আমার এক বান্দা আছে যে তমার থেকেও জ্ঞানী । এ শুনে হজরত মুসা (আঃ) আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমা পার্থনা করেন এবং সেই বাক্তির ঠিকানা আল্লাহর কাছে চাইতে থাকেন। তারপর আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্দেশ দেই তুমি একটি থলিতে করে একটি মাছ নিয়ে সমুদ্রের দিকে যাও । যেখানে মাছটি পালাবে সেখাণেই আমার ওই বান্দা রয়েছে। অনুরুপ ভাবে হজরত মুসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী একখানা মাছ নিয়ে ইউশা ইবনে নুন-কে সাথে নিয়ে যত্রায় বেরইয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তারা একটি পাথরের কাছে পৌছলেন এবং তার উপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিতে শুরু করেন । মূসা (আঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন। এ সময় মাছটি থলি থেকে বের হয়ে লাফিয়ে সমুদ্রে চলে গেল। অতঃপর সে সমুদ্রে সুড়ঙ্গের মত পথ করে নিল। আর আল্লাহ্‌ মাছটির চলার পথে পানির প্রবাহ থামিয়ে দিলেন। ফলে তার যাওয়ার পথটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। অতঃপর তারা দুইজনে অবশিষ্ট রাত এবং পুরো দিন পথ চললেন।

পরদিন সকালে হযরত মূসা (আঃ) তার সাথীকে খাবার নিয়ে আসতে বলেন রন তারা সফরে অনেক ক্লান্ত হয়ে পরেছিল। হযরত মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ্‌ যে স্থানে যাবার কথা বলেছিলেন, সেই স্থান অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোন ক্লান্তিবোধ করেননি। তখন ইউশা বিন নুন বলল, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, যে পাথরটির নিকট আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেখান থেকেই মাছটি পালিয়ে সমুদ্রের মধ্যে চলে গেছে, কিন্তু আমি মাছটির কথা আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, শয়তানই আমাকে এ কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। হযরত মূসা (আঃ) বললেন, আমরা তো সেই স্থানটিরই অনুসন্ধান করছি। তারপর তারা তাদের পদচিহ্ন দ্যাখে আবার সেই স্থানে ফিরে আসেন এবং ঐ পাথরের নিকটে পৌছে দেখলেন, এক ব্যক্তি কাপড় মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মূসা (আঃ) তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, তুমি কে? তিনি বললেন, আমি মূসা। খিযির জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈল বংশীয় মূসা? মূসা (আঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি এসেছি এজন্য যে, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা হ’তে আপনি আমাকে শিক্ষা দিবেন। খিযির বললেন, হে মূসা! আমার আল্লাহ্‌ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আপনি জানেন না। আর আপনিও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এমন কিছু জ্ঞানের অধিকারী, যা আমি জানি না। মূসা (আঃ) বললেন, আমি কি আপনার সাথী হতে পারি? খিযির বললেন, ‘আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। যে বিষয় আপনার জ্ঞানের আওতাধীন নয় সে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করবেন কেমন করে?’ মূসা (আঃ) বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ্‌ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না’ (কাহফ ৬৭-৬৯) ।

 

তারপর তাঁরা দুজনে সাগরের কিনারা ধরে হেঁটে চললেন তারা একটি নৌকায় চড়লেন তখন হজরত খিজির (আঃ) কুড়াল দিয়ে নৌকার একটি তক্তা খুলে ফেললেন। এটা দেখে হজরত মুসা (আঃ) বলে ফেললেন মাঝিরা কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদের নৌকায় তুলে পোঁছে দিল আর আপনি তাঁদের নৌকায় তক্তা খুলে ফেললেন তারা তো ডুবে যাবে আপনি কি এটা ঠিক করলেন? তারা তো মারা যাবে । তখন খিজির (আঃ) বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। তখন হজরত মুসা (আঃ) বললেন, আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না এবং আমার এ আচরণে আমার প্রতি কঠোর হবেন না। মূসা (আঃ)-এর পক্ষ থেকে এটা প্রথম ভুল ছিল।

 

অতঃপর নৌকাটি তীরে লেগে যায়। নৌকা থেকে নেমে তাঁরা চলতে থাকেন। পথে কতকগুলি শিশু খেলা করছিল। হযরত খিজির (আঃ) তাদের মধ্যে একজনকে ধরে এমনভাবে তার গলা মোচড় দেন যে, সাথে সাথেই সে মারা যায়। এতে হযরত মূসা (আঃ) অবাক হয়ে পড়েন এবং তাকে বলে ফেলেন আপনি কি করলেন? অন্যায়ভাবে কোন কারণ ছাড়াই আপনি শিশুটিকে মেরে ফেললেন আপনি বড়ই অপরাধমূলক কাজ করলেন? হজরত খিজির (আ.) বললেন, আমি প্রথমেই বলেছিলাম আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। এটি মূসা (আঃ)-এর পক্ষ থেকে দ্বিতীয় ভুল ছিল।

 

এক গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। ওরা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করে দিলেন। হযরত খিজির (আঃ) এই গ্রামে একটি প্রাচীরকে পতনোম্মুক দেখতে পেলে তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন মুসা (আঃ) বিস্মিত হয়ে বললেন আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা তা দিতে অস্বীকার করল অথচ আপনি তাদেরকে এত বড় কাজ করে দিলেন ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খিজির (আঃ) বললেন এখন শর্ত পুরন হয়ে গেছে এটাই তোমার ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়।

 

এরপর খিজির (আঃ) মুসা (আঃ)-কে সব ঘটনার স্বরূপ বর্ণনা করতে শুরু করেন :-

 

ওই নৌকাটি দরিদ্রের ছিল তারা ছিল দশ ভাই তার মধ্যে পাঁচজন বিকলাংগ অবশিষ্ট পাঁচ ভাই মেহনত মজুরী করে সবার জীবিকার ব্যবস্থা করত। নদীতে নৌকা চালিয়ে টাকাপয়সা উপার্জন করাই ছিল একমাত্র পেশা। নৌকাটি যে দিকে যাচ্ছিল সেখানে একজন জালেম বাদশাহ এই পথে চলাচলকারী সব নৌকা ছিনিয়ে নিত। হযরত খিজির (আঃ) এ কারনে নৌকার একটি তক্তা উপড়ে দেন যাতে জালেম বাদশার লোকেরা ভাংগা দেখে নৌকাটি ছেড়ে দেয় এবং দরিদ্ররা বিপদের হাত থেকে রক্ষা পায়।

 

হযরত খিজির (আঃ) যে বালকটিকে হত্যা করেন তার পিতামাতা ছিল সৎ লোক ছিল , খিজির (আঃ) বলেন আমার মনে হচ্ছিল যে ছেলেটি বড় হয়ে পিতামাতাকে কষ্ট দেবে সে কুফরে লিপ্ত হয়ে পিতা মাতার জন্য ফেতনা হয়ে দাড়াবে এবং তার ভালবাসায় পিতামাতারও ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে । এজন্য আমি ইচ্ছা করলাম য়ে আল্লাহ তায়ালা এই সৎ ইমানদার পিতামাতাকে এই ছেলের চাইতে উত্তম সন্তান দান করুক ।

 

হযরত খিজির (আঃ) যে প্রাচীরকে সোজা করে ছিলেন সে প্রাচীটি ছিল নগরের দুই জন এতিম বালকের এর নিচে ছিল তাদের গুপ্তধন যা তাদের পিতামাতা রেখে গিয়েছিল । এতে ইংগিত রয়েছে যে হযরত খিজির (আঃ) এর মাধ্যমে এতীম বালকদের জন্য রক্ষিত গুপ্তধনের হেফাজত এজন্য করানো হয় যে তাদের পিতা একজন সৎকর্মপরায়ন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন, তাই আল্লাহ তায়ালা তার সন্তানসন্ততির উপকারার্থে এ ব্যবস্থা করেন।

         

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter