আধুনিক যুগে বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়া কোনও চ্যালেঞ্জ নয়, এটি একটি আশীর্বাদ
বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধ জনসংখ্যার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের প্রতি দশজনের মধ্যে একজন ২০২৫ সালের মধ্যে ৬০ বছরের বেশি বয়সী হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে পাঁচজনের একজন বৃদ্ধ হবে। এই ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বৃদ্ধ পিতা-মাতার যত্নের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। ইসলাম ঐতিহ্যগতভাবে পরিবারকেন্দ্রিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়ে থাকে এবং বৃদ্ধ সদস্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্য বিবেচনা করে। প্রায়শই ইসলামী ঐতিহ্যে বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা পরকালে সওয়াব অর্জনের পথে মূল ভিত্তি হিসেবে বর্ণিত হয়েছে; তাদের ত্যাগকে সন্তানের সহৃদয় কর্তব্য হিসেবে দেখা হয়। এই প্রবন্ধে কোরআন-হাদিস ও ইসলামী মতাদর্শের প্রেক্ষাপটে পিতামাতার প্রতি সম্মান, যত্ন এবং সেবার গুরুত্ব তুলে ধরা হবে; পাশাপাশি আধুনিক বাস্তবতায় বৃদ্ধ পিতা-মাতার যত্নের চ্যালেঞ্জগুলি বিশ্লেষণ করে ইসলাম কীভাবে সমাধান দিতে পারে তা অনুসন্ধান করা হবে।
ইসলামী শিক্ষায় পিতামাতার মর্যাদা ও কর্তব্য
ইসলামে পিতামাতার মর্যাদাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের প্রতি সন্তানের কর্তব্যকে আপোষহীন ত্যাগমূলক দায়িত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কুরআনুল করিমে আল্লাহ তায়ালা ইমানদারদের প্রতি বারবার নির্দেশ দিয়েছেন, “শুধু আল্লাহকে আরাধনা কর এবং পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণ কর”। অনুরূপভাবে অন্যত্র বলা হয়েছে, “শুধু আল্লাহকে বাদে আর কাউকে উপাসনা করো না; এবং পিতামাতার প্রতি দায়িত্বশীল হও”। এই নির্দেশগুলো স্পষ্ট করে যে পিতামাতার প্রশংসা ও সেবা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইসলাম ‘বীর আল-ওয়ালিদাইন’ নামে পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নৈতিক শিক্ষা দেয় এবং এর আওতায় আর্থিক ও সামাজিক সহায়তা, তাঁদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে শোনা এবং নম্র ভঙ্গিতে আচরণ করা অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে কুরআন ১৭:২৩-২৪-এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বৃদ্ধ পিতামাতার ক্ষেত্রে কোনো অসহনীয় শব্দ উচ্চারণ না করে সদয় ভাষায় সম্মান দেখাতে এবং বিনয়ের সঙ্গে তাদের দেখাশোনা করতে হবে। এ সব বাণী স্পষ্ট করে দেয় যে ইসলামে পিতামাতার প্রতি ভাষা-আচরণেও বিশেষ যত্নের প্রত্যাশা রয়েছে।
এক হাদিসে নবী করীম (সা.) বলেছেন, “সময়নিষ্ঠ নামাজের পর পিতামাতার প্রতি সদাচরণ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ”। এতে বোঝা যায় যে পিতামাতার সেবা ইসলামী নৈতিকতার অন্যতম স্তম্ভ; এটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ খুলে দেয়। আরেক হাদিসে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি তার পিতাকে সন্তুষ্ট করে, আল্লাহও সন্তুষ্ট হন; যার বাবা বিরক্ত, আল্লাহও কঠোর হন”। এসব বাণী স্পষ্ট করে দেয় যে পিতার সন্তুষ্টি আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে সরাসরি মিলিত, এবং সন্তানের কর্তব্য হলো পিতামাতাকে সন্তুষ্টি দেওয়া। আরেক জনপ্রিয় বাণীতে বলা হয়, ‘মাতার পায়ের তলে জান্নাত’। যদিও এর আদতে কোনও নির্দিষ্ট হাদিস নেই, এর অন্তর্নিহিত অর্থ পিতামাতার প্রতি গুণগত শ্রদ্ধার প্রকাশ। এই ধারণা মুসলিম সমাজে পিতামাতার ত্যাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং সন্তানদের মধ্যে তাদের সেবা সম্পর্কে উদার মনের প্রেরণা সৃষ্টি করে।
তবে ইসলামী বিধান সব পরিস্থিতিতেই পিতামাতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাশীল থাকার নির্দেশ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি পিতা-মাতা কোনো বেআইনি কাজের নির্দেশ দেন, সন্তানের উচিত তা পালন না করা; তবুও তাদের প্রতি কোনো অপমানজনক শব্দ উচ্চারণ বা অভদ্র আচরণ নিষিদ্ধ। ইসলামী শিক্ষায় শুধু আদেশ উল্লেখ করাই যথেষ্ট নয়; পিতামাতার অবজ্ঞাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাহিহ হাদিসে এসেছে, “আমি তোমাদের জানাই সবচেয়ে বড় গর্হিত (বড়) পাপের মধ্যে একটি হলো পিতামাতার অবাধ্যতা”। অর্থাৎ, পিতামাতার প্রতি অবজ্ঞা ইসলামে অন্যতম মারাত্মক অপরাধ এবং এটি সহিষ্ণু উপেক্ষা নয় বরং গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই শিক্ষার আলোকে বোঝা যায় সন্তানের দায়িত্ব হল বৃদ্ধ পিতামাতার কাছে বিনীত থাকা, তাদের প্রাপ্য সম্মান প্রদান এবং সবসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
আধুনিক সমাজে বৃদ্ধ পিতামাতার যত্ন ও চ্যালেঞ্জ
নগরায়ন, পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির আধিপত্য আধুনিক সমাজে বৃদ্ধ পিতামাতার যত্নকে জটিল করেছে। উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কারণে পারিবারিক গঠন ছোট হচ্ছে; বহু ক্ষেত্রে একক বা পারমাণবিক পরিবার গড়ে উঠছে এবং যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে পূর্বের মুসলিম সমাজ আন্তঃনির্ভরশীল (কলেক্টিভিস্ট) সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল, যেখানে বহু প্রজন্ম একসাথে বাস করত; অথচ আধুনিক পশ্চিমা সমাজকে “ব্যক্তিবাদী” বলা হয়েছে, অর্থাৎ ব্যক্তিগণ স্বতন্ত্র স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়। এর ফলে নতুন প্রজন্ম প্রধাণ করে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেন, যার কারণে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সময় দেওয়া ও তাদের দেখাশোনা পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না।
সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও কর্মজীবনে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে অনেক পরিবারে ঐতিহ্যগত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো নরম হচ্ছে এবং ধারণাগত স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দায়িত্বের ভার পাল্টে যাচ্ছে, যা বৃদ্ধ পিতামাতার দেখাশোনার দায়িত্বকেও প্রভাবিত করছে। তাছাড়া আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতিযোগিতামূলক চাপ বৃদ্ধদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে; অনেকে পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রম বা পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা শুরু করেছে, যা ঐতিহ্যগত মুসলিম মূল্যবোধের পরিপন্থী। এইসব কারণে অনেক পরিবারে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি প্রাথমিক যত্নের কাজে উদাসীনতা দেখা দিয়েছে। আধুনিক জীবনের চাপ এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিযোগিতার ফলে সন্তানদের মধ্যে সরাসরি দেখাশোনার মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে; ফলে অনেকেই আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাদের নিজগৃহে রাখতে পারছে না বা যথেষ্ট সময় দিতে পারছে না।
অন্যদিকে, আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা থাকলেও ব্যক্তির একাকিত্ব অনেক পরিবারে বেড়েছে। বড় শহরে কাজের তাগিদে অনেক যুবক-যুবতী পিতামাতাকে দূরে রেখে যায় এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য ডিজিটাল মাধ্যমের উপর ভরসা করে; কিন্তু এতে অন্তরঙ্গ সহায়তা কমে যাচ্ছে। কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে শিক্ষিত ও কর্মজীবি যুব সমাজে পারিবারিক ঐতিহ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কমেছে। ফলে বহু ক্ষেত্রে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পরিবারের দ্বিতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব মনে করা হচ্ছে এবং তারা নিঃসঙ্গ বোধ করছে।
তবে এই সামাজিক পরিবর্তনগুলো বিশেষ প্রভাব ফেললেও, ইসলামী নীতিমালা তবুও সতর্ক করে দিয়েছে যে পিতামাতার অবজ্ঞা একদম গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম মতে, পিতামাতার প্রতি উদাসীনতা মহাপাপ; এটি শির্ক পরবর্তী একটি বৃহৎ পাপ হিসেবে বিবেচিত। পাশাপাশি ইসলামী আইন অনুযায়ী, বৃদ্ধ পিতামাতার দেখাশোনা প্রতিটি সন্তানের বাধ্যতামূলক কর্তব্য। যথাযথ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে নিষেধ; কারণ এটি ইসলামী নৈতিকতার পরিপন্থী। এই বাস্তবতা বুঝিয়ে দেয় যে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে জন্ম নিতে পারে না; সকলকে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে সচেতন হতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে বৃদ্ধা পিতা-মাতাদের সংখ্যা বাড়লেও, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাধ্যবাধকের কারণে বহু সন্তান তাদের খেয়াল রাখতে ব্যস্ত। বিশেষ করে মহানগরে কর্মজীবনের তাগিদে অনেক ছেলে-মেয়ে পিতামাতাকে ঘরে রাখতে পারে না; ফলে প্রবীণরা একা থাকতে বাধ্য হয়। উন্নত দেশগুলোতে যেমন বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবহার বেড়েছে, তেমনি কিছু মুসলিম দেশে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রভাবে এ রকম প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে ইসলামী ঐতিহ্যে বৃদ্ধাশ্রম ব্যবস্থাকে সর্বদা শেষ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
তাল মিলিয়ে, মুসলিম সমাজে বৃদ্ধদের প্রতি সামাজিক বন্ধন এক অনন্য দৃশ্য তৈরি করে। এক হাদিসে বর্ণনা আছে, “পিতার বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা পিতামাতার শ্রেষ্ঠ সেবা”। এই নির্দেশনার ফলে মুসলিম সমাজে বৃদ্ধরা সাধারণত বিচ্ছিন্ন থাকে না এবং আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সংযোগ বজায় রাখতে পারেন। অন্যদিকে, পশ্চিমা সমাজে বৃদ্ধদের নিভৃত একাকিত্বের খবর নানা মাধ্যমে উঠে আসে; ইসলামে এই বিচ্ছিন্নতার প্রভাবে গৃহীত সুরাহার কোনও প্রশংসার বিষয় নয়। ইসলাম সেই বিচ্ছিন্নতার প্রতিকারে সামাজিক বন্ধন ও সহায়তা প্রধান বলে মনে করে এবং মুসলিম সমাজে বৃদ্ধদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে উৎসাহ দেয়।
ইসলামী শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা ও সমাধান
ইসলামী শিক্ষার নীতিগুলো আধুনিক পরিস্থিতিতেও প্রবীণদের কল্যাণে দিশানির্দেশ দেয়। বাউসাদি প্রবন্ধে বোঝানো হয়েছে যে কোরআন ও সুন্নাহ বৃদ্ধদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাজকে অবহেলা ও পৃথকীকরণ থেকে রক্ষা করে। ইসলামী নীতি অনুযায়ী, শুধু পারিবারিক স্তরে নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতিমালায়ও বৃদ্ধদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে; উদাহরণস্বরূপ, বৃদ্ধদের জন্য পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সহায়তামূলক প্রকল্প গ্রহণ করে তাদের সহায়তা করা উচিত। এই নির্দেশনাগুলো নির্দেশ করে যে ইসলামী সমাজে বৃদ্ধদের সম্মান ও সহায়তা নিশ্চিত করা সকল স্তরে ভাবা হয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ইসলাম শিশু, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—প্রত্যেককে বৃদ্ধদের প্রতি দায়িত্বশীল করার কথা বলে। এটি নির্দেশ করে যে বৃদ্ধদের কল্যাণ নিশ্চিত করা শুধু পারিবারিক ব্যাপার নয়, বরং একটি সমন্বিত সামাজিক উদ্যোগ।
পারি্বারিক ঐক্য ও সামাজিক ঐতিহ্য বৃদ্ধদের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, নামাজ, রমজান ও ঈদের মতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সময় পরিবার একত্রিত হয়, যা বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির বোধকে জাগিয়ে তোলে। এই ধরনের ঐতিহ্যগুলির মাধ্যমে মুসলিম পরিবারে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি পায় এবং বৃদ্ধরা সমাজের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এছাড়াও নবী করীম (সা.)এর নির্দেশিত সামাজিক অনুশীলন যেমন পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা বৃদ্ধদের মানসিক প্রশান্তি আনে। এই অনুশীলনগুলো অনুসরণ করলে বৃদ্ধদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অনেকাংশে কমে এবং তাদের মানসিক শান্তি বৃদ্ধি পায়।
একই সঙ্গে, ইসলামিক সমাজে বহুল প্রচলিত সংগঠন ও উদ্যোগও বৃদ্ধদের সহায়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক মুসলিম দেশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও মসজিদে বৃদ্ধ সহায়তামূলক কর্মসূচি চালু রয়েছে, যেখানে তহবিলের মাধ্যমে বৃদ্ধদের খাবার, চিকিৎসা ও বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে ইসলামী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে আধুনিক বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে যা ইসলামী নীতির প্রতিফলন। পরিবার সবসময় বৃদ্ধের পক্ষ নিলে সম্ভব না হলে ইসলামী বিধান অনুযায়ী বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেমন, যদি কোনও কারণে সন্তান তার আর্থিক এবং শারীরিক সামর্থ্য না থাকার ফলে নিজে দেখাশোনা করতে অক্ষম হয়, তখন বৃদ্ধাশ্রম বা পরিচর্যা কেন্দ্রে বৃদ্ধকে রাখা যেতে পারে। তবে ইসলামে এটিকে সর্বদা সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে, এবং প্রধান লক্ষ্য হবে পারিবারিক দায়িত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে তাদের যত্ন নিশ্চিত করা।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী সন্তানেরা বৃদ্ধ পিতামাতার যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও অবকাশ পায় না। উদাহরণস্বরূপ, এক ফতোয়ায় বলা হয়েছে যে সন্তানের প্রতি বৃদ্ধ পিতামাতার যত্ন চুকানোর দায়িত্ব অগ্রাহ্য করা যায় না, এবং এই দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে সন্তান কোনো অর্থ গ্রহণ করতে পারে না। অর্থাৎ, বৃদ্ধদের দেখাশোনার জন্য সন্তানরা উপার্জন করতে পারেনা, কারণ এটি তাদের উপর অঙ্গীকারকৃত একটি কর্তব্য। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি পেয়ার্শনযোগ্য এই মহৎ দায়িত্ব কখনো ব্যক্তিগত স্বার্থের ধনোপার্জনের উপায় হতে পারে না।
শিক্ষা ও সামাজিক রূপান্তরে ইসলামী মূল্যবোধের প্রসার অপরিহার্য। মুসলিম সমাজে সন্তানদের মধ্যে বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি দায়িত্ববোধ সঞ্চার করতে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রদ্ধাবোধমূলক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। মসজিদ ও ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বৃদ্ধা পিতামাতার যত্ন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মশালা চালাতে পারে। তাছাড়া, সমাজের অন্যান অংশ যেমন অলাভজনক সংস্থা বৃদ্ধদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে; উদাহরণস্বরূপ, সেবা ওয়েলফেয়ার ইনিশিয়েটিভ ও অন্যান্য সংগঠন বৃদ্ধদের জন্য ঘর, খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো ইসলামী আদর্শের প্রয়োগের মাধ্যম, যা সমাজকে আরও মানবিক করে তোলে।
সর্বোপরি, ইসলামী তত্ত্ব ও নৈতিক আদর্শগুলি আধুনিক সমাজে প্রবীণদের যত্নের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক ভূমিকা রাখে। কোরআন-হাদিসে সবসময় নির্দেশ করা হয়েছে পিতামাতার প্রতি করুণা ও সেবা প্রদানের গুরুত্ব। সমাজে পারিপার্শ্বিক পরিবর্তন থাকলেও, কোরআন-হাদিসের শিক্ষা মেনে চললে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় থাকে এবং প্রজন্মভেদী সংকট মোকাবেলা সম্ভব হয়। তাই আধুনিক মুসলিম সমাজে বৃদ্ধ পিতা-মাতার যথাযথ যত্ন নিশ্চিত করা মানে ইসলামী শিক্ষার মৌলিক মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখা, যা সমাজকে আরও মানবিক ও সমৃদ্ধ করবে।
উপসংহার
বর্তমান সময়ে বিশ্বে বৃদ্ধ জনসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে, যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের অনুপাত উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলাম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি বিনম্র দায়বদ্ধতা ও সম্মান প্রদর্শন সবসময় অপরিহার্য। কোরআন ও হাদিসে বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে পিতামাতার সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন করা আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম চাবিকাঠি। উপরোক্ত আলোচনাগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে ইসলামী নীতি ও আদর্শ বৃদ্ধ পিতা-মাতার যত্নের ক্ষেত্রে যুগোপযোগী সমাধান দিতে পারে। সমাজে পারিপার্শ্বিক পরিবর্তন থাকলেও কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা মেনে চললে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় থাকে এবং প্রজন্মভেদী সংকট মোকাবেলা সম্ভব হয়। তাই আধুনিক সমাজে বৃদ্ধ পিতা-মাতার যত্নকে ইসলামী নৈতিকতার অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত; তাদের মর্যাদা ও সেবা নিশ্চিত করা মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত কর্তব্য।
তৌসিফ রেজা বর্তমানে কেরালার দারুল হুদা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের গবেষক। সমসাময়িক ইসলামি চিন্তাধারা, ইতিহাস ও সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে তার গভীর আগ্রহ রয়েছে। সে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে থাকে, যেখানে ধর্ম, সাহিত্য ও সমাজের জটিল প্রশ্নগুলোকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে।