তুরস্ক-সিরিয়া ভূমিকম্প: মানব প্রজাতি সত্যিই কেঁপে উঠেছে

ধ্বংস্তূপের মাঝে জন্ম এক শিশুকন্যার...। এক বোন তার ছোট ভাইয়ের ওপর পতিত স্তম্ভের বিরুদ্ধে রক্ষ্যার হাত রেখে...। কত মৃত,বিকৃত, রক্তাত দেহাংশ উদ্ধার...। চোখের সামনে ছটফট করতে করতে প্রাণ হারছে অনেক। সহায়তাকর্মী, উদ্ধারকারী, ডাক্তার, অপতাকলিন রেপিড ফোর্স  সবাই বেহাল। আবার কত এখনও বেখোঁজ - সম্ভবত ধ্বংস্তূপই তাদের কবরের মাটি হয়ে গেছে। পরিসংখ্যায়, মৃত্যু পনেরো হাজারের কাছাকাছি এবং আহতের সংখ্যা বাইশ হাজার অতিক্রম করে ফেলেছে।

 

ভৌগোলিক উৎপন্নস্থল

স্পষ্টতই যে শব্দে রঞ্জিত এই প্রলয়  চিত্রটি তুরস্ক ও সিরিয়ায় সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরিণাম। গত ছয় ফেব্রুয়ারি, দিন ভোররাতে কেঁপে উঠে তুর্কি এবং পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়ার কিছু অঞ্চল।  ভূমিকম্পটি তুর্কির নুরদাগি শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বে ভূগর্ভের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে উৎপন্ন হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সোসিয়াল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায় বড়ো বড়ো অট্টালিকা তাস পাতার মত ধসে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন নতুন প্রযুক্তির বিস্ফোরণ ব্যাবহার করে ভবনগুলো ভঙ্গুরে পরিবর্তন করা হচ্ছে। গভীরভাবে প্রভাবিত অঞ্চল এক তুর্কি শহরকে অনুসরণ করে এই নব বিশ্বের ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের নামকরণ হয় কাহরামানাস ভূমিকম্প।

 

ধারাবাহিক বিপর্যয় বর্ষণ

সেই ভোরে বিপুল সংখ্যক মানুষ সূর্যোদয় আর দেখেনি। যারা দেখেছিল তারা এইরকম প্রভাপ প্রত্যাশা কখনই করেনি। মনে হচ্ছিল প্রকৃতি প্রবাহের কাছে মানব প্রজাতি সম্পূর্ণ প্রবণ। ভুখন্ডের ৪৫ সেকেন্ড রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার কম্পনে সমগ্র বাসিন্দা আতঙ্কে দিশেহারা; হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ও অট্টালিকা ধূলিসাৎ। চাপা পড়ে সহস্র মানবদেহ - শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, নর-নারী সকলের পরিবার। গৃহপালিত পোষা প্রাণীও এর ব্যাতিক্রম নয়। এই প্রলয়ের মধ্যে কিছু স্বস্তি আসে যখন ধ্বংসাবকাশের মধ্যে কোনো দেহে এখনও প্রাণের শাঁস স্পন্দন চলছে জানা যায়। হয়তো, এক প্রশ্বাসই প্রলয়ের পর আনন্দের পরিবার আবার সাজাবে! 

   কিন্তু, এই স্বস্তির সময় খুব সীমিত ছিল। এদিকে আবহাওয়া প্রচন্ড ঠান্ডার। সময় সময় হিমাবর্ষণ হচ্ছে; কখনো কখনো তাপমাত্রা শূন্যের নিচে। এমত অবস্থায় পরপর কিছু আফটার শোক ঘটতে থাকলে  তুর্কি ও সিরিয়ান মানুষের প্রাণ হিমাঙ্গের মতো জমে যায়। (একটি বড় ভূমিকম্প অনুসরণ করে একই উৎপন্ন স্থল থেকে বারবার ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়াকে ভূকম্পবিদ্যায় আফটার শোক বলে) হঠাৎ আবার সন্ধ্যার দিকে ৭.৫ রিখটার মাত্রায় ভূখণ্ড প্রবল বেগে কেঁপে ওঠে। আবার দেখা যায় বিভীষিকার ধ্বংসলীলা।

 

আন্তর্জাতিক সাড়া

তুর্কি-সিরিয়ার এই ভয়াবহ দুর্যোগ দেখে পৃথিবীর বোধশক্তিসম্পূর্ণ ও সংবেদনশীল মানুষ ব্যাথিত। সংকট-পূর্ব ব্যাবস্থা তো আর ফিরিয়ে আনা যায়না - যত টুকু পারা যায় বেহাল পরিস্থিতি সহাল করতে। এই উদ্দেশ্যে, কন্দনরতা ব্যাক্তিদের পার্শে দাঁড়িয়ে সম্ভাব্য উদ্ধার কার্য, কিছু আশ্বাস ও সহায়তা নিয়ে সক্রিয় হয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। কিন্তু, বিপর্যয়ের ভয়াবহতা এতই যে সকল সরঞ্জাম সামান্য মনে হচ্ছে। এই উদ্ধার অভিযান কর্মে বড়ো অঙ্কে ভারতও এক অংশীদার।

 

ঐতিহাসিক রেকর্ড

বেশিরভাগ তুরস্ক এবং সীমান্ত এলাকা অ্যানাটোলিয়ান টেকটনিক প্লেটের উপর অবস্থিত যা আফ্রিকান, আরবীয় এবং ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যস্থলে অবস্থান করে। টেকটনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তন এবং আন্তঃসংঘর্ষের ফলে ভূমিকম্প হয়। এ কারণেই, সেই অঞ্চলটি অত্যন্ত ভূকম্পের প্রবণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। গত সোমবারের বিপর্যয় ইতিহাসের ভুলে যাওয়া পাতাকে আবার উন্মুক্ত করে দেয়; পুরাতন স্মৃতির সঙ্গে নতুন সংকটকে জুড়ে দেয়।  একই তীব্রতার কম্পনে ১৯৩৯ সালে দেশে ৩২ হাজারের ওপর মানুষ মারা যায়। অনুরূপ, ১৭ হাজারের ওপর মানুষ কুখ্যাত ১৯৯৯-এর ভূমিকম্পে প্রাণ হারায়।

   দূরে থেকে মন্তব্য করা খুব সহজ। তবে যদি আন্তরিক হয়, তাহলে একে অপরের সাথে যন্ত্রণার অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার এটিও একটি বিকল্প। বিশ্বের অপর এক কোণে থেকে এটাই এই লেখকের কাছে সম্ভব। আওয়াজশুণ্য আর্তনাদপূর্ণ আর্জি হল আন্তরিক পর্থনা এবং সকল সম্ভাব্য সহায়তা।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter