আবু আল-হাসান আল-আশআরী (রহঃ):বিভ্রান্তি থেকে হিদায়তের আলোয় — যুক্তি,সুন্নাহ ও সাহসিকতার পথচলা
ভূমিকা
পৃথিবীতে এমন মানুষও জন্ম নেয়, যারা শুধু নিজেদের জীবন কে বদলায় না, বরং সমস্ত মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসকে বদলে দেয়। তারা সর্বদা সত্যকে খুঁজে বেড়ায়, ভুল পথ থেকে ফিরে এসে মানুষকে ভালো ও সঠিক পথের রাস্তা দেখায়। তাদের মধ্যে একজন হলেন আমদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর ন্যায় আবু আল-হাসান আল-আশআরী (রহিমাহুল্লাহ)। তিনি এমনই এক মহান ব্যক্তি ছিলেন যিনি নিজের জীবনের শুরুতে ভুল পথে ছিলেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারেন যে, সত্যিকারের ইসলাম কী এবং সেটাকে কীভাবে বুঝতে হয়। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইসলামে ফেরত আসেন এবং ইসলাম ও সুন্নাহর আলোকে নতুনভাবে জীবন্ত করে তোলেন।
তিনি আগে ‘মুতাযিলা’ নামে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে ওঠা-বসা করতেন। এই গোষ্ঠী শুধু মানুষের নিজের যুক্তির ওপর ভরসা করত, এরা কুরআন ও হাদীসকে ঠিকমতো বোঝার চেষ্টা করত না। আল-হাসান আল-আশআরী(রহিমাহুল্লাহ) অনেক বছর তাদের সঙ্গে ছিলেন। তারপর হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগে, “আমি কি ঠিক পথে আছি? আমি যা বিশ্বাস করছি, তা কি সত্য?” এবং এই চিন্তাভাবনা করতে করতেই তিনি একদিন ঠিক করলেন, তিনি আর ভুল পথে থাকবেন না, তারপর তিনি সত্যের দিকে ফিরে এলেন, এবং কুরআন ও হাদীসের আলো ধরে নিজের জীবন কে নতুন ভাবে গঠন করলেন।
কিন্তু তৎকালীন সময়ে এই কাজটি অতিসহজ ছিল না। কারণ, যেই মতবাদ তিনি ত্যাগ করেছিলেন বা অমান্য করেছিলেন , সেটির পেছনে ছিল অনেক বড় বড় শক্তি। যারা ভিন্ন কথা বলত, তারা তাদের ওপর অনেক নির্যাতন করত। কিন্তু এর সত্তেও তিনি ভয় পাননি। তিনি সাহস করে নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং হক কথা বলা শুরু করেন। তিনি বুঝেছিলেন, মানুষের কাঠামোবদ্ধ করা যুক্তি সব সময় ঠিক না-ও হতে পারে, তাই সত্য জানতে হলে কুরআন ও হাদীসের দিকেই তাকে ফিরে যেতে হবে।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
আবু আল-হাসান আল-আশআরী (রহিমাহুল্লাহ) তৎকালীন সময়ের একজন বড় আলেম ছিলেন। তার পুরো নাম ছিল আলি ইবন ইসমাঈল আল-আশআরী। তিনি ২৬০ হিজরিতে বাসরা নামক এক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন, যেটি বর্তমান সময়ে এখন ইরাক দেশে অবস্থিত। সে সময় বাসরা ছিল এক বিখ্যাত শহর। সেখানে অনেক বড় বড় ইসলামি আলেম, লেখক আর চিন্তাবিদ বসবাস করতেন। অনেক মানুষ শুধুমাত্র জ্ঞান শেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে বাসরায় আসতেন। তাই সেই সময়ে এই শহরে জন্ম নেওয়াটা ছিল এক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আবু আল-হাসান এমন এক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন, যারা ইসলাম ধর্মের দিক থেকে খুব সম্মানিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সাহাবি আবু মুসা আল-আশআরী(রাঃ)এর বংশধর। ইসলাম ও আল্লাহর ভয় তার পরিবারে ছোটবেলা থেকেই ছিল। তার বাবা ছিলেন ইসমাঈল। তিনি ছিলেন এক ভদ্র ও ধর্মপ্রাণ লোক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আবু আল-হাসান আল-আশআরী ছোটবেলাতেই তার বাবাকে হারান। পরে এক বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদের সঙ্গে তার মাতার বিয়ে হয়। এবং এই নতুন পিতামহ ছিলেন মুতাযিলা দলের লোক, যারা কুরআন ও হাদিস কে ছেড়ে নিজের যুক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দিত।
এই নতুন পরিবার জ্ঞানচর্চাই ভরপুর ছিল। প্রতিদিন সেখানে ধর্ম নিয়ে কথা হতো, যুক্তি দিয়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা হতো। তাই ছোটবেলা থেকেই তিনি এ ধরনের চিন্তা ও আলোচনার মধ্যে বড় হতে থাকেন। তার সৎপিতা তাকে মতাজিলার আদর্শ শেখান, যেখানে কুরআন ও হাদীসের পরিবর্তে মানুষের বুদ্ধির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। সে সময় আবু আল-হাসান আল-আশআরীও সেই চিন্তাধারা মানতে শুরু করেন।
কিন্তু তার মন পুরোপুরি শান্ত ছিল না। তার মনের ভেতর অনেক প্রশ্ন জাগত। তিনি ভাবতেন, “ইসলাম কি শুধু যুক্তির বিষয়? আমরা কি নিজেরা যা বুঝি তাই সত্য ধরে নিচ্ছি?” এই প্রশ্নগুলো ধীরে ধীরে তার মনকে বদলাতে শুরু করে এবং তিনি বুঝতে থাকেন, সত্য জানার জন্য শুধু মানুষের বুদ্ধি যথেষ্ট না, আল্লাহর কথা ও নবীজির হাদীসই সবচেয়ে বড় সত্য।
কর্মজীবন
আবু আল-হাসান আল-আশআরী (রহিমাহুল্লাহ) এর জীবনের শুরুটা ছিল খুবই আলাদা রকমের। তিনি ছোটবেলা থেকেই অনেক মেধাবী ছিলেন। তার পরিবারের সকলেই অনেক জ্ঞানী – গুণী মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে তার সৎপিতা "মুতাজিলা" নামক এক গোষ্ঠীর একজন বড়ো চিন্তাবিদ ছিলেন । এই দলটি বলত, "মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান বা যুক্তি দিয়েই সবকিছু বিচার করতে হবে এমনকি কুরআন ও হাদীসের কথাও যদি আমাদের বুদ্ধিতে না আসে, তাহলে সেটা মানার দরকার নেই”।
আল-আশআরী(রহঃ)তার জীবনের প্রথম প্রায় ৪০ বছর এই মুতাজিলা দলের একজন প্রবক্তা হিসেবে কাটিয়েছেন। তিনি এক প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি একের পর এক ধর্মীয় সভায়, দরবারে এবং আলিমদের বৈঠকে যুক্তি দিয়ে মতাজিলাদের মতবাদ প্রচার করতেন। বহু মানুষ তার কথায় প্রভাবিত হতেন। তিনি অনেক বই লিখেন, যেখানে যুক্তির মাধ্যমে ইসলাম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হতো। তখন তিনি মনে করতেন, মানুষের চিন্তা-ভাবনার ও যুক্তির ওপর ইসলামকে সাজানো যায়।
কিন্তু ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে একটা অস্থিরতা তৈরি হতে থাকে। তিনি সর্বদা ভাবতে থাকেন, “যদি কুরআন ও হাদীসের কোনো বিষয় আমাদের বুদ্ধির সঙ্গে না মেলে, তাহলে আমরা কি সেটা বাদ দিয়ে দেব? এটা কি সঠিক পন্থা?” এই প্রশ্নগুলো দিনের পর দিন তার হৃদয়ে বড়ো হতে থাকে।
একদিন তিনি এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেন। তিনি স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে দেখতে পান। রাসুল (সাঃ) তাকে বললেন, “তুমি সুন্নাহর পথে ফিরে এসো।” এই স্বপ্ন তার জীবনে একটা বৃহৎ পরিবর্তন আনে। তিনি বুঝতে পারেন, সত্যর পথ আসলে কুরআন ও হাদিসই । এরপরই তিনি সাহস করে সবার সামনে উঠে বলেন “আমি এতদিন যে মতবাদ প্রচার করেছি, তা ভুল ছিল। এখন থেকে আমি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এর পথ অনুসরণ করব, যেটা ছিল রাসূল (সাঃ) ও সাহাবাদের পথ।”
এই ঘোষণা তৎকালীন সমাজে খুবই আলোড়ন তোলে। কারণ, মুতাজিলা মতবাদ সে সময়ে অনেক প্রভাবশালী ছিল। বড় বড় শাসক, বিচারক ও পণ্ডিতরাও এই দলের সমর্থন করতেন। । কিন্তু আল-আশআরী (রহঃ) নির্ভয়ে সত্যের জন্য দাঁড়ান, এবং নতুন জীবন শুরু করেন।
এরপর আল-আশআরী (রহঃ) নতুনভাবে কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করেন, এবং ধীরে ধীরে মুতাজিলাদের ভুল যুক্তিগুলো ভেঙে ফেলেন। তিনি বুঝতে পারেন, ইসলাম বোঝার সবচেয়ে নিরাপদ পথ হলো রাসুল (সাঃ) তার সাহাবিদের বুঝ অনুযায়ী কুরআন-হাদীসকে গ্রহণ করা।
আকিদার ময়দানে সাহস ও বিজয়
আবু আল-হাসান আল-আশআরী (রহিমাহুল্লাহ) এমনই একজন ইসলামি মনীষী ছিলেন, যিনি মানুষের মনে জেগে থাকা ভুল ধারাকে কলম দিয়ে লড়াই করেন। কিন্তু তারপরেও যেসব মানুষ ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করছিল এবং তাদের যুক্তির উপর বিশ্বাস রেখেছিল, তাদের মতভেদকে তিনি যুক্তি দিয়ে ভেঙে দিয়েছেন। তার হাতের শক্তি ছিল কুরআন এবং হাদীস, আর তার সাহস ছিল সর্বদা সত্য কথা বলা।
তার সময়ে এক বড় সমস্যা দেখা দেয়। “মুতাজিলা” নামক এক গোষ্ঠী ছিল। যারা বলত, ইসলাম মানতে হলে আগে যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে। তারা কুরআনের অনেক আয়াত অনেক কাহিনি কে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করত। এমনকি তারা বলত, “কুরআন সৃষ্টি হয়েছে” এর মানে, কুরআন আগে ছিল না, পরে এটাকে তৈরি করা হয়েছে, তারা আরও বলত “মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াও”। কিন্তু এসব কথা হল অনেক ভুল কথা । আর এসব কথার দ্বারাই তারা মানুষের বিশ্বাসে অনেক বড়ো ধোঁকা দিচ্ছিল।
তৎকালীন সময়ে এই ভুল কথা শুধু সাধারণ মানুষের মুখ থেকে শোনা যেত না বরং, অনেক বড় বড় শাসকরাও এটাকে বিশ্বাস করত। সরকারও এই মুতাজিলা গোষ্ঠীর মতবাদকে সমর্থন করত। যেসব মানুষ এদের বিপক্ষে কথা বলত, তাদেরকে জেলে পাঠানো হতো, শাস্তি দেওয়া হতো, এমনকি অনেক ভালো, বড়ো বড়ো আলেমকেও এর কারণে মেরে ফেলা হয়েছিল।
এই ভয়ংকর সময়ে আবু আল-হাসান আল-আশআরী (রহঃ) সাহস করে সামনে এসে বললেন, “সত্যকে রক্ষা করতে হবে, তাতে যদি জীবনও চলে যায়”। তিনি সেই মুতাজিল গোষ্ঠীর মতবাদকে তাদের ভাষাতেই জবাব দিতে শুরু করলেন। তিনি তাদের কে বুঝিয়ে দিলেন, কুরআন কোনো তৈরি জিনিস না, এটা আল্লাহর চিরন্তন বাণী। এটি কোনো দিন তৈরি হয়নি, বরং এটা সবসময়ই ছিল। আর এভাবে তিনি যুক্তির দ্বারা মুতাজিলাদের ভুল চিন্তা একে একে ভেঙে ফেলেন এবং মানুষ তার ভুল কে সংশোধন করে পুনরায় আল্লাহর ও সুন্নাহর পথে ফিরে আসেন।
আবু আল-হাসান আল-আশআরী (রহঃ) শুধু ভ্রান্তি ঠেকাননি, বরং তিনি ইসলামের বিশ্বাস বা ‘আকিদা’র ওপর একটা শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছেন। যেটাকে পরে “আশআরী আকিদা” নামে গণনা করা হয়। এই বিশ্বাস বলে, সাহাবীগণ যেরকম ভাবে কোরআন ও হাদিস বুঝতেন আমাদের কেও সেরকম ভাবে কুরআন বুঝতে হবে। আজও বিশ্বের অনেক মুসলমান এই আশআরী আকিদাকে অনুসরণ করে।
উপসংহার
আল-হাসান আল-আশআরী(রহিমাহুল্লাহ) শুধু একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত চিন্তাবিদ, যুক্তিবিদ এবং সত্যের সৈনিক। তিনি কলম দিয়ে কাজ সম্পন্ন করেছেন, কথা দিয়ে মানুষকে বুঝিয়েছেন, আর ইসলামকে মানুষের কাছে অতিসহজভাবে তুলে ধরেছেন যার কারণে, বহু মুসলিম সত্যর পথে ফিরে এসেছে। তার জীবন আমাদের শেখায়, যদি কেউ প্রথমে ভুল পথে চলে, তারপরও সে চাইলে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে পারে। আল্লাহ তার বান্দাকে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। যদি বান্দা সত্যি সত্যি ভুল বুঝতে পারে আর ঠিক পথে ফিরতে চায়। আল-আশআরী (রহঃ) জীবনের শুরুর দিকে মুতাযিলা মতবাদে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পারেন, সেটা পুরোপুরি ভুল। তখন তিনি সাহস করে নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং কুরআন ও হাদীসের পথে ফিরে আসেন। তিনি কখনো সত্যের কথা বলতে ভয় পাননি। অনেক মানুষ তার যুক্তি ও কুরান-হাদিস এর ব্যাখ্যার কারণে ইসলামকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছে। আজও তার নাম বহু ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জীবিত রয়েছে। তার কাঠামোবদ্ধ আশআরী আকিদা আজও কোটি কোটি মুসলমান অনুসরণ করে। এমন কি তিনি নিজের জীবনের শেষ সময়েও সুন্নাহর পথেই ছিলেন এবং মানুষকে আল্লাহর সঠিক পথে ডেকে গেছেন। অতঃপর তিনি ৩২৪ হিজরিতে পরলোকগমন করেন, কিন্তু তার কাজ, ও তার শিক্ষা মানুষের হৃদয়ে আজও জ্বলজ্বল করছে।