মহৎ চরিত্র (২): নবীজীর (ﷺ) রহমত

এই অধ্যায়ে বিশ্বনবী নবী (ﷺ)-এর মহৎ চরিত্রে অন্তর্ভুক্ত তিনার রহমত বা কুরুণার কিছু অমূল্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হল যাতে তার এক দৃশ্য পাওয়া যায়।  উদ্দেশ্য হল এই অপার রহমতের ছোট এক বিবরণে বাস্তব জীবন আদর্শ হয়ে যাতে গড়ে উঠে। পৃথিবীর সকল প্রকারের জ্বালা নিবারণে এই করুণা ছটা যথেষ্ট। 

   মহানবী (ﷺ) ছিলেন রহমতের অপার উৎসআরবি শব্দরহমত’-এর অর্থ হল করুণা, দয়া, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি। রহমত হল কোনো বেক্তির আইনত প্রতিশোধ নেওয়া বা ক্ষতি করার যথেষ্ট ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কারো প্রতি বিশেষ ক্ষমাশীল এবং সদয় মনোভাব করা। এই মহৎ গুনাগুন শান্তি, নিরাপত্তা এবং ভ্রাতৃত্বের প্রতীকসকল সৃষ্টি আল্লাহ প্রদত্ত নবীজির রহমত ছায়াতলে অন্তর্ভুক্তপবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন বলেন: “এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি কিন্তু রহমত করে সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য।” ( আল-কুরআন, সূরা হজ্জ্ব; ২১:১০৭) 

   তাঁর মোহনাহীন করুণা মানুষের উপর সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বব্রহ্মণদের সকল সৃষ্টি পরিবেষ্টিত। শিশু, পুরুষ-নারী, পশু-পাখি, মোমিন-কাফের, জড়-জীব সবার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল করুণা ও ভালোবাসার। ‘তাফসীর-ই-রহুল বয়ান’-এ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয় যে আয়াতের অর্থ হচ্ছে- “আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি, কিন্তু এমন রহমত (কল্যাণ) করে, যা ব্যাপক, পূর্ণাঙ্গ, পরিপূর্ণ, পরিব্যাপ্ত ও সম্পূর্ণ, যা সমস্ত শর্তযুক্তকে পরিবেষ্টনকারী অদৃশ্য রহমত এবং জ্ঞানগত, চাক্ষুষ, অস্তিত্বগত ও উপস্থিতিগত সাক্ষ্য আর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী (করুণা) ইত্যাদি, সমগ্র জাহানের জন্যই - চাই রূহজগত হোক, কিংবা শরীর জগত হোক, বিবেকবান হোক কিংবা জড় পদার্থ হোক। আর যিনি সমস্ত জাহানের জন্য রহমত হন তিনি অনিবার্যভাবে সমগ্র জাহান অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ হন।” (কানজুল ঈমানও খাজাইনুল ইরফান)

   পূর্বেই বলা হয়েছে যেহুতু সৃষ্টির সমগ্র সদস্য এই মহানবীর রহমত গুনে লাভবিত এবং তা ব্যাখ্যা অসম্ভব। মুষ্টিমেয় কিছু বিবরণ রাখা হল:

মুসলমানদের প্রতি 

“নিশ্চয় তোমাদের নিকট তাশরীফ আনয়ন করেছেন তোমাদের মধ্যে থেকে ঐ রসূল যাঁর নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের উপর পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু।” ( আল-কুরআন, সুরাহ তওবাহ; ১০-১২৮)

   আল্লাহ তা’আলা নবী পাক (ﷺ)-কে মুসলমানদের জন্যরাউউফ’ (পূর্ণ দয়ার্দ্র) এবং ‘রাহিম’ (দয়ালু) বলে আখ্যায়িত করেছেনঅনুরূপ মুসলিম শরীফের এক বর্ণনা: “অবৈশ্যৈ আল্লাহ তাঁকে দয়ালু, করুণাময় বলে ডেকেছেন।”

   মুসলমানদের প্রতি নবী মুহাম্মদের (ﷺ) রহমত বা করুণার বিশ্লেষণে এর থেকে বড়ো আর কি  বিশেষণ হতে পারে। মুসলমানের দ্বীন থেকে দুনিয়ার সমগ্র ক্ষেত্রে এই করুণার কণা বিদ্যমানস্পষ্টতই ইসলাম এবং অনুসারী মুসলমানদের পরিচয় আল্লাহ তা’আলা নবীর মারফতই অব্যাহত রেখেছেননবী (ﷺ) হচ্ছেন সার্বিক মাধ্যমধর্ম, গ্রন্থ, হিদায়াত, নাজাত সবই তিনার মাধ্যমে। নবীর (ﷺ) করুণা অনুসারীদের জ্ঞান-মানে, কর্ম-ধর্মে, চিন্তা-ভাবনায় এবং ইবাদত-আমলে। এই বিশেষণ শুধুমাত্র সমসাময়িক নয়, যা সাহাবাকালেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, বরং সৃষ্টির অন্তরালে অবিরতবরং আজ অবিরত, আগামীতেও অব্যাহতকিছু বাস্তব উদহারণ দিয়ে ইটা এটা বোঝা যাক। 

   সর্বশক্তিমান আল্লাহর নির্দেশনায়, মহানবী নবী এই সমাজকে মর্যাদা, স্থিতিশীলতা এবং সংযমের সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে নিয়েগেছেন। একেশ্বরবাদী এই সমাজ বিশ্বনবীর কর্তৃত্বে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় বা ‘উম্মাতুন ওয়াস্তার’ অভূতপূর্ব উপাধিতে ভূষিত হয়েছে।তিনি হলেন সমগ্র মানবতার আলো-আঁধার, অজ্ঞতা ও জ্ঞান, বর্বরতা ও সভ্যতার মধ্যবর্তী স্থানান্তরের সেতু। তিনি হলেন সমগ্র বিশ্বের রহমত - ‘রহমাতুল লিল আলামীন’! 

   আবু সুলাইমান মালিক ইবন আল-হুওয়াইরিস (রাঃ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে তাঁদের যৌবন কালে নবী কারীম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে কুড়ি রাত থাকেনপরে তিনি তাঁর এক মূল্যায়ন মন্তব্যে বলেন: ‘আল্লাহর রাসূল  (ﷺ) করুণাময় এবং কোমল ছিলেন।’  

   মুসলমানদের জন্য দয়ার নবী (ﷺ) দুই জগৎ যথা দুনিয়া ও আখিরাতেও রহমতদুনিয়াতে তৌহিদ, ইসলাম, কুরআন এবং আরও নিয়ামতসমূহ অন্তর্ভুতপরকালের জন্যও রাসূল  (ﷺ) বার বার তাঁর উম্মতের কল্যাণ চেয়ে আর্তনাদপূর্ণ প্রার্থনায় বলতে থাকেন: ‘রাব্বি হাবলী উম্মতি’ (আমার প্রভু, আমার উম্মত আমাকে সমর্পন করে দেন), উম্মতি উম্মতি, ইয়া রাব্ব (আমার উম্মত আমার উম্মত, ইয়া প্রভু!)। তাছাড়া কিয়ামত মাঠে সবাই যখন বেসাহারা, দিশেহারা হয়ে ছুটাছুটি করছে, তখনও কিন্তু রহমতের নবী উম্মতের জন্য আল্লাহর রহমত প্রার্থনায় রত।  

অমুসলিমদের প্রতি 

মক্কা পেরিয়ে তায়েফে যখন দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে হযরত (ﷺ) আহ্বান দেন, নগরবাসীর আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ায় তিনি (ﷺ) অত্যন্ত ক্ষত বিক্ষত হয়ে পরেনক্ষণের মধ্যে পাহাড়ের (দায়িত্বে নিয়োজিত) ফেরেশতা এসে বলেন: ‘(আপনি বললে) আমি এ পাহাড় দু’টিকে তাদের উপর চাপা দিয়ে দিব।’ নবীর (ﷺ) মানব ইতিহাসে অতুলনীয় উত্তর ছিল: ‘(না) বরং আমি আশা করছি যে, মহান আল্লাহ এদের বংশ থেকে এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যারা কেবল আল্লাহরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না।’ (বুখারী ও মুসলিম) অনুরূপ বহু বর্ণনা আছে এখানে অব্যাপ্ত থাকলো। 

   অষ্টম হিজরীতে যখন নবী (স) দশ হাজার সাহাবাদের নিয়ে মক্কা জয় করেন, তখন তিনি পরাস্ত মক্কাবাসীদের সামনে আসেন, যাদের হৃদয় কাঁপছিল এবং চোখ অশ্রুতে প্রশস্ত ছিল। তারা ছিল সেইসব লোক যারা নবী (সঃ) ও তাঁর সাহাবীদেরকে নির্যাতন করে, হত্যার ষড়যন্ত্র করে, নিজ  জন্মভূমি থেকে বহিষ্কার করে। এ সময় প্রতিশোধের অনুভূতিতে উত্তেজিত হয়ে তাঁর এক সহচর  বলে উঠেন: ‘আজ প্রতিশোধের দিবস।’ প্রতিউত্তরে নবী (সঃ) উত্তর দেন: ‘আজ রহমতের দিন।’...দয়ার নবী তাদের সম্মোধন করে ঘোষণা করে বলেন: ‘তোমরা যাও, তোমরা স্বাধীন।’

শিশুদের প্রতি 

রাসূল (ﷺ) শিশুদের খুব স্নেহ করতেনতাঁর করুণার বৃত্ত থেকে ছোট শিশুরাও বাদ পড়েনি। প্রায়শই, নবী (ﷺ) তাদের সঙ্গে খেলতেন এবং তাদের সাথে রসিকতা করতেনহাসান হোসাইন (রাঃ) নামাযে মগ্ন থাকা অবস্থায় তাঁর পিঠে আরোহণ করে ফেলতেনসে সময় নবী (ﷺ) রাগান্বিত হননি। পরিবর্তে তিনি তাদের ভালবাসতেন এবং সিজদার সময় আরও দীর্ঘ করেন

   আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আকরা ইবনু হাবিস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেখেন যে, তিনি হাসান (রাঃ)-কে চুম্বন করছেনতখন আকরা ইবনু হাবিস (রাঃ) বলেন: ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আমার দশটি সন্তান আছে; আমি তাদের কাউকে চুম্বন করিনি।’ তখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন: ‘যারা দয়া করে না তাদের প্রতি (আল্লাহ কর্তৃক) দয়া করা হয় া।’

আনাস (র:) বলেন: ‘আমি আল্লাহর রাসূলের চেয়ে শিশুদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল ও করুণাময় আর কাউকে দেখিনি।’

জীবজন্তুর প্রতি 

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক সফরে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলামতিনি তাঁর প্রয়োজনে যানঅতঃপর আমরা একটি লাল রঙের (হুম্মারাহ) পাখী দেখতে পেলামতার সঙ্গে দুটো বাচ্চা আছে। তারপর আমরা তার বাচ্চাদুটোকে ধরে নিলামপাখীটি এসে আশে-পাশে ঘুরতে লাগলতখনই নবী (ﷺ) ফিরে এলেন এবং বললেন: ‘এই পাখীটিকে ওর বাচ্চাদের জন্য কে কষ্টে ফেলেছে? ওকে ওর বাচ্চা ফিরিয়ে দাও।’ তারপর তিনি পিঁপড়ের একটি গর্ত দেখতে পেলেন, যেটাকে আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছিলামতা দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: ‘ গর্তটি কে জ্বালাল?’ আমরা জবাব দিলাম: ‘আমরা।’ তিনি বললেন: ‘’আগুনের মালিক (আল্লাহ) ছাড়া আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া আর কারো জন্য সঙ্গত নয়।’

সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে, শুধুমাত্র বর্ণনা সহ একটি উদাহরণ এখানে বলা হল। অন্যথায়, নবীর প্রত্যেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সুনির্দিষ্ট উপস্থাপনের জন্য একটি সম্পূর্ণ বইও কম হয়ে যায়।  

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter