মিসকোটিং মুহাম্মাদ: নবীর বাণীর ভুল উদ্ধৃতি – বই পর্যালোচনা
জোনাথন এ.সি. ব্রাউনের Misquoting Muhammad: The Challenge and Choices of Interpreting the Prophet’s Legacy (অনুবাদিত শিরোনাম: মিসকোটিং মুহাম্মাদ (ﷺ)) হলো নবীজির বাণী এবং ঐতিহ্যকে নানা প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা-প্রত্যাখ্যার আলোচনা। লেখক একজন ইসলামি গবেষক ও হাদিস পণ্ডিত, যিনি পশ্চিমা একাডেমিক পদ্ধতির কঠোরতা আর ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। সূচনায়ই ব্রাউন দেখিয়েছেন যে, ইসলামের বিভিন্ন দল যেমন সালাফি, সুফি বা আধুনিকতাবাদী, প্রত্যেকেই নিজেকে নবীর বাণীর প্রকৃত ধারক মনে করে এবং নবীর নামে উদ্ধৃত ও ভুল উদ্ধৃতির দ্বন্দ্বে জড়িয়ে থাকে। ব্রাউন তার এই কর্মকাণ্ডে ইহুদী-বাইবেলের বিশেষজ্ঞ বার্ট ইহারমানের Misquoting Jesus থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন, তবে বইটি মূলত “নবীজিকে নিয়ে বিতর্ক” হিসেবে ধরা হয়েছে, অর্থাৎ নবীর উত্তরাধিকার ব্যাখ্যা করার বিভিন্ন পথনির্দেশ তুলে ধরা হয়েছে।
মূল গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়
গ্রন্থে নবীর বাণী বা হাদিসের গুরুত্ব, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং যুগে যুগে তার ব্যাখ্যায় মতানৈক্যের বিস্তারিত ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। ব্রাউন উল্লেখ করেছেন যে সহীহ বুখারি ও মুসলিমের সংগ্রহের পর হাজারো হাদিস ইসলামের শিক্ষার দ্বিতীয় স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হলেও, এদের মধ্যে কতটুকু নির্ভরযোগ্য এবং এত বিতর্কের মধ্যে মানুষ কেন এগুলোকে মেনে চলে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, ইসলামি ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন মাযহাব ও চিন্তাধারার মধ্যে একই কোরআনিক আয়াত বা হাদিসের ব্যাখ্যায় মাঝে মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ গ্রন্থে পর্যালোচিত বিতর্কগুলোর মধ্যে রয়েছে – নারী সমবেত আচার্য হিসেবে নামাজে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়, ধর্মত্যাগকারীর ভবিষ্যৎ, আধুনিক রাষ্ট্রে সহিংসতার ভূমিকা ইত্যাদি।
ব্রাউন বিশেষ করে আধুনিক মুসলিম সমাজে উদ্ভূত নৈতিক ও আইনগত সমস্যা তুলে ধরেছেন। সে প্রসঙ্গে তিনি “স্ত্রীর প্রহার” সংক্রান্ত কোরআনিক আয়াত, বালিকা বিবাহ (ঐশার বয়স ইত্যাদি), পরিবার ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রশ্নাবলীসহ জটিল বিষয়গুলিকে আলোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাউনের উদ্ধৃত এক বক্তা (শাইখ সালমান ইবনে ফাউযি বাধাই) প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন যে শরীয়াহে স্ত্রীর প্রতি ঘুষি মারা অনুমোদিত নয়; আয়াতের “দারাবা” শব্দটি ভুলভাবে বোঝা হয়েছে, কারণ নবীজির উল্লেখিত কোনো হাদিসেই তিনি কখনও স্ত্রীর প্রতি আঘাত করেননি। এছাড়াও ব্রাউন দেখিয়েছেন কিভাবে ইসলামের বিভিন্ন প্রতিভাষায় (টেক্সট-সমালোচনা, শব্দার্থ, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট) কাজ করে এগুলোকে যুক্তিযুক্ত করার প্রচেষ্টা হয়েছে।
লেখকের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি
ব্রাউন তার বইটি পেশাদারী ও বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতিতে সাজিয়েছেন। তিনি নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন; দ্বন্দ্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর একতরফাভাবে না দিয়ে সম্ভাব্য সব দিক উন্মোচন করেছেন। যেমন প্রারম্ভিক অধ্যায়গুলোতে তিনি ঐতিহ্যবাহী উলামাদের কিতাব ও অনুবাদের মাধ্যমে ইসনাদ-নিষ্ঠ পদ্ধতিতে প্রথমদিনের মুসলিমদের ধারাবাহিকতা প্রদর্শন করেছেন। পরবর্তী অধ্যায়ে তিনি আধুনিক যুগের স্বনামধন্য ইসলামী চিন্তাবিদদের (যেমন শাহ ওয়ালীউল্লাহ) দৃষ্টান্তসহ কুরআন-হাদিসের মননচর্চার বিবর্তন তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের লেখা প্রবল একাডেমিক হলেও ভাষাটা সহজবোধ্য। এতে তথ্যচিত্রধর্মী আলোচনা, বিদ্যমান যুক্তি-তর্কের সংমিশ্রণ এবং ধর্মতাত্ত্বিক থেকে পশ্চিমা দর্শনের প্যাকট্যালে তুলনা রয়েছে। (এম্নার উদাহরণস্বরূপ, ব্রাউন স্বচক্ষে দেখিয়েছেন মুসলিম ও খ্রিষ্টানীয় স্বরূপবিদদের মধ্যে কিভাবে ঐতিহাসিক বিবরণীর দৃষ্টিভঙ্গি মিল রয়েছে এবং দুই দ্যোগের নানা সমস্যার সাম্য রয়েছে।)
ব্রাউন স্পষ্টতই জটিল বিতর্কগুলোকে একত্রে বিবেচনা করে, ফলে পাঠক নিজেই নানান সমাধানের পরিণতি অন্বেষণ করতে পারেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ধ্রুপদী সনাতন ইসলামী ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে হলেও সঙ্গতিপূর্ণ আধুনিক প্রশ্নউদ্বোধন করে; এ কারণে তিনি নিজে সরাসরি কোনো অংশগ্রহণমূলক মতপ্রকাশ কম করেছেন। বইটিতে পশ্চিমা প্রকাশনা থেকে উদ্ভূত দৃষ্টান্ত ও আভ্যন্তরীণ মুসলিম পর্যালোচনার সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়; যেমন একাধিক অধ্যায়ে সেন্ট অগাস্টিন, মার্টিন লুথার, ইমানুয়েল কান্তের দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ এসেছে, যা বইটিকে গভীর তুলনামূলক চেতনা প্রদান করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়
গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত আছে – ইসলামের পূর্ববর্তী শতাব্দীর ঐতিহ্যগত ব্যাখ্যা ও পুনর্বিবেচনা, আধুনিক বিশ্বে নবীজির ঐতিহ্যের সামাজিক-মৌলিক ভূমিকা, এবং মুসলিম চিন্তাবিদদের নৈতিক দ্বন্দ্বসমূহ। ব্রাউন দেখিয়েছেন যে হাদিসগ্রন্থ, যদিও শতকের পর শতকের প্রচেষ্টায় সংকলিত হয়, তবুও বিস্তর গ্রন্থভুক্ত বিবৃতি মধ্যেও বহু হাদিস সন্দেহভাজন বা প্রপঞ্চমূলক হিসেবে গণ্য হয়েছে। তিনি এমন উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে আধুনিক মুহাদ্দিসরা শপথে বিশ্বাস করার পাশাপাশি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী হাদিসের যোগ্যতা বিশ্লেষণ করেছেন।
পাশাপাশি, গ্রন্থে হাদিসবিজ্ঞান ইসলামের উর্ধ্বতন বিষয়ে গুছিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন একটি অধ্যায়ে কুরআন-শাস্ত্রের অগ্রগণ্য নীতি যেমন “নিষিদ্ধ পরকীয়া” এবং “মোহ-মায়ার স্ত্রীর প্রহার” নিয়ে বিশ্লেষণ রয়েছে। ব্রাউন দেখিয়েছেন কিভাবে বিভিন্ন যুগের আলেমরা কোরআনের এই কঠিন আয়াতগুলোকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এসেছে। তিনি এই দ্বন্দ্বগুলি বুঝতে পশ্চিমা এবং ইসলামী ঐতিহাসিক-তাত্ত্বিক প্রতিকরণ ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম চিন্তাবিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহর যুক্তি ও সিদ্ধান্ত ব্রাউন প্রায় সর্বত্র তুলে ধরেছেন, যিনি ১৮শ শতকে ধর্ম ও যুক্তির মিলন অনুসন্ধানে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
মূল্যায়ন ও সমালোচনা
Misquoting Muhammad সম্পর্কে ইসলামী ও আধ্যাত্মিক মতবিশ্লেষণে প্রশংসা কম নেই। মরোক্কোর অনলাইন পত্রিকা ইন্ডিপেনডেন্ট-এর একটি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ব্রাউন নবীজির বাণীর গুরুত্বসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তুলনামূলক শিক্ষাও তুলে ধরেছেন, ভাষাও জটিল নয় এবং সাধারণ পাঠকের জন্য সহায়ক। ওমিদ সাফীর মতানুযায়ী, ব্রাউন বইটিতে অত্যন্ত কঠোর ও পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ করেছেন যা প্রশংসনীয়। এলএ রিভিউ অব বুকস-এর সমীক্ষক স্কট লুকাস লিখেছেন যে ব্রাউন এই বিষয়ের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যতম প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং তাঁর পুরানো-নতুন বিতর্ক সমাধানে বিশ্বস্ততা পাওয়া যায়।
তবে কিছু সমালোচনাও আছে। অনেকে দেখেছেন যে ব্রাউন ব্যক্তিগত মূল্যবোধ বা দৃষ্টিকোণ নিয়ে সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। যেমন একটি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, গাণিতিকভাবে তিনি একাধিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, কিন্তু বলেছেন না যে কোনটি নৈতিক দিক থেকে সঠিক। আবার অনেকে মনে করেন বইটি তত্ত্ব ও বাস্তবতার মধ্যে মাঝে মাঝে ‘সামান্য খিঁচুনি’ বোধ হয়; অর্থাৎ কখনও কখনও ব্রাউন ব্যাখ্যা-চেষ্টায় সেই প্রশ্নগুলোকে স্পষ্টভাবে সমাধান করতে পারেননি, যেখানে আধ্যাত্মিকভাবে সঠিক সমাধান প্রয়োজন ছিল। তবুও অধিকাংশ সমালোচনাতেই স্বীকার করা হয় যে গ্রন্থটি আধুনিক ইসলামী বিতর্ক–বিশ্লেষণে একটি মূল্যবান অবদান এবং পাঠকদের সামনে নবীর ঐতিহ্য তুলে ধরে বিশ্বকে বোঝার প্রসার ঘটাতে সহায়ক হয়েছে।
উপসংহার
মিসকোটিং মুহাম্মাদ (ﷺ) বইটি ইসলামি ঐতিহ্য, কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যার বিতর্ক এবং আধুনিক মুসলিম জীবনে এসবের ভূমিকা নিয়ে অবিশ্বাস্য পরিমাণে গভীর ও বিস্তারিত আলোচনা করেছে। ব্রাউন জ্ঞানীয় দিক থেকে অত্যন্ত সচেতন এবং উদার মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এল, যা পাঠকদের জন্য অনেক প্রাঞ্জল করে তুলেছে। তাঁর কাজটি ইসলামী অধ্যয়ন ও উত্তরসূরী বিতর্ক উভয়ের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যে হোক, বইটিতে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে বাদ দেওয়ার কারণে কিছু চরম প্রশ্নের নৈতিক ভুমিকাটি নিয়ে গবেষণার সুযোগ রয়েছে বলেই মনে করেন সমালোচকরা। তবে বলাই যায়, নবীর শাস্ত্র ও তাঁর উপদেশের ব্যাখ্যাভাবে যে জটিলতার ছবি ব্রাউন এঁকেছেন তা পড়লে ইসলামের দেড় হাজার বছরের বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রটি আরও সুদৃঢ় হয়।