মণিপুর সহিংসতা মানবতার নৃশংসতা
মে মাস পেরিয়ে জুন জুলাই শেষ হতে চলেছে। একশতাধিক হত্যা। অর্ধলক্ষ বাস্তুচ্যুত। প্রশাসন নিশশব্দ। মিডিয়া অন্ধ। জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতা অব্যাহত।
দৃশ্যটি ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্য মণিপুরের। ইন্টারনেটে ভাইরাল হৃদয় বিদারক একটি ভিডিও মানবতাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে (তার ব্যাখ্যা অউল্লেখিত থাকলো)। কিন্তু প্রায় তিন মাস ধরে হিংসা কবলিত জ্বলন্ত রাজ্যের চিত্র এখানেই শেষ নয়। দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে পবিত্র মানবতার জোরপূর্বক নগ্নতা - কখনও নারীত্বের হেনস্তা, ধর্মীয় উত্তেজনার ভর্তসনা, আশ্রয় ঘরে আগুন দেওয়া, ব্যাথার আল্হাদ, রক্তের দাগ, গুলির শব্দ, পরবর্তী চর্মের ছিদ্র! মনে হচ্ছে যেন পায়েরতলী পৃথিবীর স্খলন ঘটে গেলো।
কুকি-মৈতেই সংহতি: এক দূরদর্শিতা
ভারতের সৌন্দর্য এর বৈচিত্রের মধ্যে নিহিত। ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশরা খুব ভালো করে ব্যাপারটি জেনেছিল বলেই তো তারা বিভক্তীকরণ প্রকিয়া আরম্ভ করে। কিন্তু মণিপুরের বর্তমানের অবস্থায় ইটা প্রদর্শিত হয় যে এই বৈচিত্র্য সঠিকভাবে বজায় না রাখতে পারলে পরিস্থিতি কত গুরুতর হতে পারে। রাজ্যের উপজাতিসমূহ বিশেষ করে কুকি-জো এবং মৈতেইদের মধ্যে হিংসার আঁচ এবার আরও উত্তপ্ত। প্রশান্তিকরণের কার্যকর পদ্ধতি এখনও দেখা যায়নি; তাছাড়া সহিংসতা নিবারণের সকল চেষ্টাই বৃথা গেছে।
ভৌগোলিক দিক দিয়ে মণিপুর বিশেষত দুভাগে বিভক্ত - পাহাড় ও উপত্যকা অঞ্চল। দ্বিতীয় ভাগেই রাজ্যের রাজধানী ইমফল যেহুতু পরের তুলনায় এখানে পরিবহন যোগযোগ সহজ। মৈতেইদের বেশির ভাগ হিন্দু ধর্ম অবলম্বী। তাদের বসবাস উপত্যকা অঞ্চল জুড়ে এবং তাদের কাছে সমগ্র সুযোগ সুবিধা তুলনামূলকভাবে খুব সহজেই প্রাপ্য। মণিপুরের জনসংখ্যার মৈতেইদের জনগোষ্ঠী প্রায় ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ মৈতেইরাই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। ভাষার বিশেষণে এদের মণিপুরীও বলা হয়। তাদের দীর্ঘ ঐতিহ্যগত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে। তাছাড়া প্রশাসনিক বিভিন্ন্য পদ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এরা যথেষ্ট এগিয়ে।
অন্যদিকে কুকি জাতিগত গোষ্ঠী বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের আত্মীয় উপজাতিদের সম্মিলিতভাবে কুকি-জো বলা হয় যা রাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ। এদের বেশিরভাগ আদিবাসী খ্রিস্টান। ভারতের এদের প্রায় পঞ্চাশটি উপজাতিকে তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃত দেয়া হয়েছে।
এই বৈচিত্র্য দেখে সংহতির এক সুন্দর দূরদর্শিতা দেখা যায়। চিরহরিৎ পাহাড়-পর্বত, বিশুদ্ধ পানি এবং হাওয়া বাতাসের অস্থির প্রবাহ, মনোহর আবহাওয়া, সাংস্কৃতিক রঙের বিস্তৃত সংমিশ্রণ, প্রকৃতির ন্যায় পরিষ্কার লোকের হৃদয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থাটা এই স্বপ্নকে গ্লানিতে ভোরে দিয়েছে। সবই রক্তের রঙে লোহিত হয়ে গেছে। সৃষ্টির রহস্যই হচ্ছে বৈচিত্রের মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় খুঁজে বের করে সংহতি স্থাপন করা হয়। এগুলি কার দুস্কৃতির পরিণীতি? কে দোষী এবং কে অপরাধী? কার অবহেলায় এই সংবেদনশীল বৈচিত্র্য নেতিবাচকতায় প্রভাবিত হয়? অবশেষে সমাধান কি, কিভাবে এবং কতদূরে?
সঙ্গতির দুঃস্বপ্ন
মেইতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসখ্যার বার বার আবেদন রয়েছে যেন তাদের তফসিলি উপজাতি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলতঃ বিশেষ সংগঠনও যেমন মেইতেই উপজাতি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশেষে মার্চ ২৭ তারিখে রাজ্যের হাই কোর্ট রাজ্য সরকারকে চার সপ্তাহের মধ্যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তির অনুরোধ বিবেচনা করার নির্দেশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি সুপারিশ পাঠাবারও আদেশ দেয়। পরে পরেই রাজ্যে বিদ্যমান তফসিলি উপজাতিদের মধ্যে বিক্ষোভ বেড়ে যায়, যার ফলে কুকি উপজাতি অধ্যষিত চূড়াচাঁদপুরে অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর-এর নেতৃত্বে ৩ মে একটি বিরাট উপজাতি সংহতি মার্চ হয়। আরম্ভ হয় দুই উপজাতির মধ্যে সহিংসতা যা এখনও অব্যাহত। অবশই, স্পষ্ট করে কোনো এক বিশেষ ঘটনাকে এর কারণ হিসেবে আক্ষায়িত করা যায়না।
আবার পার্বত্য এলাকায় অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি আফি চাষ বিরোধী অভিযান কুকি ও অন্যান্য উপজাতীয় জনগণের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই সমষ্টি প্রক্রিয়ার পরিণীতি আজকের মণিপুর। এখান থেকে আরম্ভ হয় মণিপুরে কুকি-মৈতেই সঙ্গতির দুঃস্বপ্ন। যখন সরকারে নিন্দ্রা স্বপ্ন ভাঙবে, আশাবাদী যে তখন গৃহীত হোক আবার সঙ্গতির প্রক্রিয়া; রাজনীতি নয়।