ইবনে সিনা: প্রতিভার আলোকে লেখা জীবনের গল্প
কেন আজও হাজার বছর পর ইবনে সিনা মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থান দখল করে আছেন—এ প্রশ্ন শুনলেই মনে হয়, এমন কী করেছিলেন তিনি যে আজও মানুষ তাকে স্মরণ করে?
ভূমিকা
ইবনে সিনা ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি ছোটবেলা থেকেই আল্লাহর দেওয়া অদ্ভুত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি পুরো কোরআন মুখস্থ করেছিলেন। তিনি যখন পড়াশোনায় কোনো কিছু বুঝতে পারতেন না, তখন নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। এই বিনয়ী ও জ্ঞানপিপাসু মনোভাব তাকে বিশেষ করে তুলেছিল। তিনি ১৬ বছর বয়সেই চিকিৎসাশাস্ত্রে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তখনই বোখারার রাজাকে সুস্থ করেছিলেন। রাজা তাকে পুরস্কার দিতে চাইলে তিনি ধনসম্পদ চাননি, বরং রাজকীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশাধিকার চান। কারণ তার কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল জ্ঞান।
ইবনে সিনার লেখা ‘আল-কানুন ফি তিব্ব’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক। এই বই ইউরোপ ও এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত বছর ধরে পড়ানো হয়েছে। এজন্য তাকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনি শুধু চিকিৎসক নন, ছিলেন দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, গণিতজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। প্রায় ৪৫০টি গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন। তিনি প্রথম বলেছিলেন জীবাণুই রোগের কারণ এবং পানির মাধ্যমেও রোগ ছড়ায়। আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক ধারণাই তার গবেষণা থেকে শুরু হয়েছিল।
ইবনে সিনা চিকিৎসায় প্রথম মনোবিজ্ঞানের ব্যবহার করেন। তিনি বুঝেছিলেন, শরীর সুস্থ রাখতে মনের ভূমিকা কত বড়। এজন্য তাকে বলা হয় ডাক্তারদের রাজপুত্র এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথিকৃৎ। তিনি শুধু বিদ্যায় নয়, চরিত্রেও অনন্য ছিলেন। ধন-সম্পদ, ক্ষমতা বা রাজনীতি তাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তিনি জ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন কেবল মানবকল্যাণের জন্য। এজন্য তিনি মুসলিম ও অমুসলিম—সব মানুষের কাছেই শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছেন।
তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। তিনি বলেছিলেন শুক্র গ্রহ সূর্যের কাছাকাছি, যা পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়। ইউরোপীয়রা তাকে একসময় "চলমান জাদুঘর" বলতো, কারণ তার মধ্যে যেন সমগ্র জগতের জ্ঞান ভর করে ছিল। তিনি ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইরানের হামদান শহরে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার রেখে যাওয়া জ্ঞান আজও বেঁচে আছে। প্রতি বছর তার স্মৃতিতে পালন করা হয় “ডে অফ ডক্টর”। তাহলে কেন আজও মানুষ তাকে ভালোবাসে? কারণ, তিনি ছিলেন জ্ঞান আর মানবতার প্রতীক। তিনি দেখিয়েছেন, সত্যিকারের বড় হওয়া মানে ধন-সম্পদ জমা নয়, বরং মানুষের উপকারে আসা। তার কর্ম আজও মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়।
জন্ম ও পরিবারিক পরিচয়
তিনার পুরো নাম আবু আলী হোসেন বিন আব্দুল্লাহ বিন হাসান বিন আলি বিন সিনা, তিনার মাতার নাম সিতারা বাবা ছিলেন আলি তিনার বাবা সরকার মিলের পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। তিনার জন্মস্থান: উজবেকিস্তানের আফশানা এলাকায় ৯৮০ খিস্তাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে সিনার সবচেয়ে খাঁটি ছবি কোনও মোবাইলের ছবি নয় , বরং শিক্ষক আবু হাসান সাদিকি কালো কলম দিয়ে তৈরি একটি বিখ্যাত ছবি। এই ছবি ইরানের হামদান শহরে "মৌজা ইবনে সিনা" তে হেফাজত করা আছে। বিশেষকেরা এবং আটার মিলি সমিতিরা এই ছবিটিকে ইবনে সিনার মুখের সবচেয়ে খাঁটি ছবি হয়ে উপস্থাপনা করেছিলেন । ইবনে সিনাকে ইউরোপে" আভি সেনা" বলা হয়।
ছোটবেলা থেকেই অদম্য জ্ঞানপিপাসা
ইবনে সিনা জন্মেছিলেন ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে উজবেকিস্তানের আফশানা গ্রামে। খুব অল্প বয়সেই ১০ সালে তিনি কোরআন হিফজ করেন এবং দর্শন, সাহিত্য, ফলসাফা, গণিত, ফিকাহ ও বিজ্ঞানে গভীর মনোনিবেশ করেন। যখনই তিনি কোনো অধ্যায় বা বিষয় বুঝতে পারতেন না, তখন তিনি নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন যেন জটিল জ্ঞান সহজ হয়ে যায়। তার এই নিষ্ঠা, ধৈর্য ও আল্লাহর উপর ভরসা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে তিনি গণিতের মূল্যবান জিনিসগুলো শিখেছিলেন ।এবং ঈসায়ী মুসাফিরের কাছ থেকে তিনি ইউনানী ওষুধের জ্ঞান শিখেছিলেন। এবং তিনি তাবেড়িষ্ঠানের একটি ভালো শিক্ষক পেয়েছিলেন যার নাম আবু আব্দুল্লাহ নাথালী তিনার কাছ থেকে যুক্তিবিদ্যার জ্ঞান শিখেছিলেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেছেন।
জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুরাগ
শৈশবে ইবনে সিনা টলেমি ও ইউক্লিডের মতো লেখকদের বই পড়েছিলেন। পড়ার সময় তিনি কেবল বইয়ের লেখা পড়েই সন্তুষ্ট থাকতেন না, বরং প্রতিটি অধ্যায়ের মূল বিষয় নিয়ে শিক্ষককে প্রশ্ন করতেন, গভীরভাবে আলোচনা করতেন এবং অধ্যায়ের প্রতিটি বিষয় নিয়ে নিজে নিজে অনেক চিন্তা করতেন।
পড়তে গিয়ে যখন কোনো অধ্যায়ের বিষয়বস্তু বুঝতে পারতেন না, তখন তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন, যেন আল্লাহ তাঁর জন্য জ্ঞানের দরজা খুলে দেন। একবার তিনি অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত বই ‘মেটাফিজিক্স’ (আরবিতে ‘মাবাদ আল-তাবিয়াহ’) পড়ছিলেন, কিন্তু এর মূলভাব কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। চল্লিশবার পড়ার পরেও যখন ধারণাটি স্পষ্ট হলো না, তখন তিনি বিখ্যাত দার্শনিক আল-ফারাবির লেখা অ্যারিস্টটলের দর্শনের একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ খুঁজে পান। সেটি পড়ার পর তিনি মূল বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গরিবদের মাঝে সদকা (দান) করেন ও শুকরিয়া আদায়ে নামাজ পড়েন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে বিপ্লব
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এতটাই দক্ষতা অর্জন করেন যে তৎকালীন বাদশাহ তাঁকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। বাদশাহকে সারিয়ে তোলার পর পুরস্কার হিসেবে তিনি কোনো ধন-সম্পদ চাননি, বরং রাজকীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশের অনুমতি চেয়েছিলেন। এখানেই বোঝা যায়, তাঁর কাছে জাগতিক সম্পদের চেয়ে জ্ঞান ছিল অনেক বেশি মূল্যবান।
তাঁর রচিত বিখ্যাত বই 'আল-কানুন ফিল-তিব' (The Canon of Medicine) ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৬০০ বছর ধরে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়েছে। এই যুগান্তকারী গ্রন্থের জন্য তাঁকে "আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক" (Father of Modern Medicine) বলা হয়। আজকের আধুনিক চিকিৎসার অনেক নিয়মকানুন ও ধারণা এই গ্রন্থকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। একারণে চিকিৎসকেরা তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে "চিকিৎসকদের রাজকুমার" (Prince of Physicians) বলে অভিহিত করেন।
অনন্য আবিষ্কার ও তত্ত্ব
ইবনে সিনাই প্রথম convincently প্রমাণ করেন যে, জীবাণু অনেক রোগের মূল কারণ এবং দূষিত পানি থেকেও রোগ ছড়াতে পারে। তিনি চিকিৎসার সঙ্গে মনোবিজ্ঞানকে যুক্ত করেছিলেন, যা আধুনিক যুগে "সাইকোসোম্যাটিক মেডিসিন" (Psychosomatic Medicine) নামে পরিচিত। অর্থাৎ, তিনি দেখিয়েছিলেন যে মনের অবস্থা শরীরের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
জ্ঞান ও মানবকল্যাণের প্রতি নিবেদন
ইবনে সিনার জীবনে রাজনীতি বা ধনসম্পদের কোনো লোভ ছিল না। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, সত্যিকারের মর্যাদা আসে জ্ঞান ও মানবকল্যাণ থেকে। তিনি চিকিৎসা, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং সঙ্গীতসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি আরবি, ফারসি এবং গ্রিক ভাষায় পুরোপুরি দক্ষ ছিলেন।
তাঁর কিছু বিখ্যাত বই হলো:
- কিতাব আল-শিফা (The Book of Healing): দর্শন ও বিজ্ঞানের উপর লেখা একটি বিশাল বিশ্বকোষ, যা ১৮টি খণ্ডে বিভক্ত।
- আল-কানুন ফিল-তিব: চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর রচিত পাঁচ খণ্ডের অমর গ্রন্থ। বিখ্যাত চিকিৎসক ড. উইলিয়াম অসলার এই বইকে "চিকিৎসাবিদ্যার বাইবেল" বলে অভিহিত করেছেন।
জ্যোতির্বিদ্যায় অবদান
কেবল চিকিৎসা বা দর্শন নয়, মহাকাশ নিয়েও তাঁর জ্ঞান ছিল গভীর। তিনি পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, শুক্র গ্রহ পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের বেশি কাছাকাছি অবস্থিত। মহাকাশীয় বস্তুসমূহের দূরত্ব সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি একটি বিশেষ যন্ত্রও তৈরি করেছিলেন। তাঁর জ্ঞান ও আবিষ্কার এতটাই বিস্ময়কর ছিল যে, মধ্যযুগের ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী আলবার্টাস ম্যাগনেস (Albert the Great) তাঁকে প্রায়ই জাদুকর বলে মনে করতেন।
মৃত্যুর পরেও অমরত্ব
ইবনে সিনা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে (৪২৮ হিজরি) ইরানের হামদান শহরে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। কিন্তু তাঁর কর্ম তাঁকে আজও বিশ্বজুড়ে জীবিত রেখেছে। তাঁর জন্মদিনে ইরানসহ অনেক দেশে ‘চিকিৎসক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর নাম আজও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
উপসংহার
আজকের প্রশ্নটি খুব সহজ কিন্তু এর উত্তর বিশাল: কেন হাজার বছর পরেও ইবনে সিনা মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থান দখল করে আছেন? কারণ, তিনি জ্ঞানকে আলোর মশালে পরিণত করেছেন, চিকিৎসাকে মানবকল্যাণের হাতিয়ার বানিয়েছেন এবং এমন সব গবেষণা করেছেন যা আজও মানবতাকে পথ দেখাচ্ছে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, সত্যিকারের জ্ঞানী কখনও মৃত্যু বরণ করেন না; তাঁর কর্মই তাঁকে অমর করে রাখে। তাই আজও ইবনে সিনা শুধু একজন চিকিৎসক বা দার্শনিক নন, বরং তিনি মানবসভ্যতার এক চিরন্তন আলোকবর্তিকা, যিনি আগামী প্রজন্মকেও অনন্তকাল ধরে অনুপ্রাণিত করে যাবেন।