হালাল উপার্জন: ইসলামের দৃষ্টিতে নির্দেশনা ও গুরুত্ব

এই দুনিয়ার প্রতি মানুষের অতিরিক্ত আকর্ষণ আল্লাহ তায়ালা শুরু থেকেই মানুষের মনে রেখেছেন। জীবন পরিচালনার প্রয়োজন মেটানোর জন্য বৈধ উপায়ে উপার্জন করা একটি এবাদত। এভাবে বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদ মানুষকে আল্লাহভীতি অর্জনে সহায়ক হয়। নেক আমল করার জন্য জায়েয উপায়ে সম্পদ অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ।

মুসলিম ব্যক্তি যেন নিজের এবং নিজের স্ত্রী ও শিশু সন্তানসন্ততিদের ভরণপোষণ ও খোরপোশের সমস্ত খরচ সঠিক পন্থায় বহন করার উদ্দেশ্যে বৈধ ও পবিত্র রুজি রোজগার এবং জীবিকার্জন করে, তার প্রতি তাকে প্রকৃত ইসলাম ধর্ম উৎসাহ প্রদান করে। অনুরূপভাবে সে যেন সুখে শান্তিতে সম্মানের সহিত জীবনযাপন করতে পারে, তার উপযুক্ত উপায় অবলম্বন করার প্রতিও তাকে প্রকৃত ইসলাম ধর্ম উৎসাহ প্রদান করে। কেননা বেকারত্ব ও আলস্য এবং অকর্মা বা কর্মহীন হয়ে বসে থাকার বিষয়টিকে প্রকৃত ইসলাম ধর্ম ঘৃণা করে।

দুআ, যিকর ইত্যাদি সকল প্রকার এবাদত বন্দেগি কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হল অবশ্যই হালাল উপার্জন নির্ভর হতে হবে এবং সকল প্রকার হারাম উপার্জন থেকে দূরে থাকতে হবে। যে ব্যক্তি হারাম বা অবৈধ সম্পদ উপার্জন করে এবং তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তার কোনো এবাদত ও দুআ আল্লাহ কবুল করবেন না বলে বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে।

এক হাদীসে আবু হুরাইরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রসূলুল্লাহ () বলেছেনঃ হে মানুষেরা, আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র (বৈধ) ছাড়া কোনো কিছুই কবুল করেন না। আল্লাহ মুমিনগণকে সেই নির্দেশ দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি নবী ও রসূলগণকে দিয়েছেন (বৈধ ও পবিত্র উপার্জন ভক্ষণ করা)। তিনি (রসূলগণকে নির্দেশ দিয়ে) বলেছেনঃ হে রসূলগণ, তোমরা পবিত্র উপার্জন থেকে ভক্ষণ কর এবং সৎকর্ম কর, নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর তা আমি জানি। (আর তিনি মোমিনগণকেও একই নির্দেশ দিয়ে বলেছেন) : হে মোমিনগণ, আমি তোমাদের যে রিযিক প্রদান করেছি তা থেকে পবিত্র রিযিক ভক্ষণ কর। এরপর তিনি একজন মানুষের কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি (হজ্ব, উমরা ইত্যাদি পালনের জন্য, আল্লাহর পথে) দীর্ঘ সফরে রত থাকে, ধূলি ধূসরিত দেহ ও এলোমেলো চুল, তার হাত দুটি আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে দুআ করতে থাকে, হে পভু! হে প্রভু !! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার রক্তমাংস গড়ে উঠেছে। তার দুআ কিভাবে কবুল হবে!

এই হাদীসে আমরা দেখি যে, হালাল, বৈধ ও পবিত্র জীবিকার উপর নির্ভর করা সকল যুগের সকল নবী, রসূল ও বিশ্বাসীগণের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সকল যুগের সকল নবী ও তাঁদের উম্মতগণের জন্য তাওহীদের পরেই ইসলামের যে মৌলিক বিধান অপরিবর্তনীয় রয়েছে তা হচ্ছে হালাল ও বৈধ উপার্জনের উপর নির্ভর করা।

দ্বিতীয়ত, আমরা দেখতে পাই যে, সৎকর্ম করার নির্দেশ বৈধ জীবিকা অর্জনের নির্দেশের পরে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, উপার্জন ও জীবিকা বৈধ না হলে কোনো সৎকর্মই কবুল হবে না। উপরের হাদীসে বিশেষভাবে দুআর বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য অনেক হাদীসে সকল ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। একটি হাদীসে আবু হুরাইরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রসূলুল্লাহ () বলেছেনঃ বৈধ ও হালাল জীবিকার এবাদত ছাড়া কোনো প্রকার এবাদত আল্লাহর নিকট উঠানো হয় না।

হারাম সম্পদ খাওয়া থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য একটি ফরজ কর্তব্য। অবৈধভাবে খাওয়ার অশুভ প্রভাব বংশের জন্যও ক্ষতিকর। আমাদের উপার্জন করা প্রতিটি খাদ্য আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হালাল ও তাইয়্যেব কিনা তা নিশ্চিত করে খাওয়া উচিত।

প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বসরার প্রশাসক ও আমীর আব্দুল্লাহ ইবনু আমিরকে তার অসুস্থ অবস্থায় দেখতে যান। ইবনু আমির বলেন, ইবনু উমার, আপনি আমার জন্য একটু দুআ করুন না! ইবনু উমার তার জন্য দুআ করতে অসম্মত হন। কারণ তিনি ছিলেন আঞ্চলিক প্রশাসক। আর এ ধরনের মানুষের জন্য হারাম, অবৈধ, জুলুম, অতিরিক্ত কর, সরকারি সম্পদের অবৈধ ব্যবহার ইত্যাদির মধ্যে নিপতিত হওয়া সম্ভব। একারণে ইবনু উমার (রাঃ) উক্ত আমীরের জন্য দুআ করতে অস্বীকার করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ ওযু গোসল ছাড়া কোনো সালাত কবুল হয় না, আর ফাঁকি, ধোঁকা ও অবৈধ সম্পদের কোনো দান কবুল হয় না। আর আপনি তো বসরার গভর্নর ছিলেন।

হারাম থেকে দূরে থাকার চেষ্টা অন্যতম যিকর। অপর পক্ষে যদি যাকির হারাম সম্পদ বর্জন করতে না পারেন তাহলে তার সকল যিকর ও সকল ইবাদত অর্থহীন হয়ে পড়ে। 

এজন্য এখানে আমি আমাদের সমাজের হারাম উপার্জনগুলি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাচ্ছি। ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম উপার্জনের মূল উৎসগুলি সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ

(ক)সুদ: কুরআন করীমে বারংবার সুদকে হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপরন্তু আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন যে, যারা আল্লাহর বিধান প্রদানের পরেও সুদের মধ্যে লিপ্ত থাকবে তাদের সাথে আল্লাহ ও রাসূলের অনন্ত যুদ্ধ ঘোষিত থাকবে। হাদীস শরীফে সকল প্রকার সুদকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুদভিত্তিক উপার্জনের সাথে জড়িত সকলকে: সুদ গ্রহিতা, দাতা, লেখক ও সুদি লেনদেনের সাক্ষী সবাইকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অভিশাপ বা লানত প্রদান করেছেন। দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।

(খ)ঘুষ: ঘুষকে হাদীসে কঠিনভাবে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঘুষদাতা, গ্রহীতা ও দালাল সবাইকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কাজের জন্য যদি কর্মী, কর্মচারী বা কর্মকর্তা সরকার বা কর্মদাতার নিকট থেকে বেতন বা ভাতা গ্রহণ করেন, তাহলে উক্ত কাজের জন্য সেবা-গ্রহণকারীর নিকট থেকে কোনোরূপ হাদিয়া, পুরস্কার, বখশিশ বা সাহায্য গ্রহণ করাই ঘুষ। 

(গ)জুয়া: ইসলামে জুয়াকে হারাম উপার্জনের অন্যতম উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। সাধারণভাবে জুয়া আমাদের পরিচিত। সকল প্রকার প্রচলিত লটারি জুয়া। এছাড়া সকল প্রকার বাজি জুয়া, যেক্ষেত্রে সংশিলষ্ট পক্ষগণ প্রত্যেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা করে এবং বিজয়ী পক্ষ সকল অর্থ গ্রহণ করে। বর্তমানে আমাদের দেশে সাধারণ খেলাধুলাও এভাবে জুয়ার মাধ্যমে আয়োজিত হচ্ছে। কিশোরগণও এখন জুয়া নির্ভর হয়ে গিয়েছে! খেলাধুলা বা বৈধ প্রতিযোগিতায় ৩য় পক্ষ পুরস্কার দিতে পারে।

(ঘ)জুলুম, জোর করা বা কেড়ে নেওয়া: কুরআন ও হাদীসে জোর বা অনিচ্ছার মাধ্যমে কারো অর্থ গ্রহণ করাকেও হারাম উপার্জনের অন্যতম দিক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে যা কিছু গ্রহণ করা হয় সবই অপবিত্র উপার্জন। সকল প্রকার চাঁদা, যৌতুক, জবরদস্তিমূলক উপহার, ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি এই জাতীয় হারাম উপার্জন। কিছু ক্রয় করে প্রভাব দেখিয়ে মূল্য কম দেওয়া, শক্তি ও প্রভাবের কারণে রিকশা, গাড়ি, শ্রমিক ইত্যাদির ভাড়া বা পারিশ্রমিক কম দেওয়া একই শ্রেণীর জুলুম।

(ঙ)ফাঁকি, ধোঁকা, ওজনে কম-বেশি, ভেজাল, খেয়ানত বা দায়িত্বে অবহেলা ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ। এগুলি সবই কঠিনতম হারাম উপার্জন। কুরআন ও হাদীসে এ সকল বিষয়ে বারবার সাবধান করা হয়েছে। কর্মস্থলে ফাঁকি দেওয়া, কর্মচারী বা কর্মদাতাকে চুক্তির চেয়ে কম কর্ম প্রদান করাও এই শ্রেণীর হারাম উপার্জন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter