মৌখিক প্রচলন থেকে লিখিত সংকলন: কোরআনের উসমানী মানদণ্ডীকরণ

ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাসে কোরআনের সংরক্ষণ এমন এক অলৌকিক দৃষ্টান্ত, যার তুলনা মানবসভ্যতার অন্য কোনো ধর্মীয় গ্রন্থে পাওয়া যায় না। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এই সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়েছেন, যেমন তিনি ঘোষণা করেছেন—إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
“নিশ্চয়ই আমিই এই স্মরণিকা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।” (সূরা আল-হিজর, ১৫:৯)

এই আয়াতের প্রতিশ্রুতি মানব ইতিহাসে এমনভাবে পূর্ণতা পেয়েছে, যা অন্য কোনো ধর্মীয় ঐতিহ্যে দেখা যায়নি। নবী মুহাম্মদ –এর যুগে ওহি নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সাহাবাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ভালোবাসা, ভক্তি ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে কোরআনের প্রতিটি আয়াত মুখস্থ করতেন এবং অন্যদের শেখাতেন। একইসঙ্গে কিছু নির্বাচিত সাহাবি, যেমন জায়েদ ইবন থাবিত, উবাই ইবন কা‘ব ও আলী ইবন আবি তালিব (রা.), নবী –এর নির্দেশে লিখিত আকারেও ওহি সংরক্ষণ করতেন।

এই দ্বিমুখী পদ্ধতি—মৌখিক মুখস্থ ও লিখিত সংরক্ষণ—কোরআনের অবিকৃত অবস্থাকে যুগে যুগে নিশ্চিত করেছে। ওহির সূচনা থেকে শেষ অবধি নবী জিবরাঈল (আঃ)–এর সঙ্গে আয়াতসমূহের পুনরালোচনা করতেন, যাতে কোনো ত্রুটি বা পরিবর্তন না ঘটে। পরবর্তীকালে আবু বকর (রা.)–এর সময় প্রথম সংকলন এবং উসমান (রা.)–এর সময় মানদণ্ডীকরণ—এই দুই ধাপে আল্লাহর বাণী একটি স্থায়ী রূপ লাভ করে।

সুতরাং মৌখিক প্রচলন থেকে লিখিত সংকলনে রূপান্তর কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি ইসলামী সভ্যতার আত্মিক ও বৌদ্ধিক ঐক্যের প্রতীক। কোরআনের সংরক্ষণ তাই কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহর প্রতিশ্রুত এক জীবন্ত নিদর্শন, যা মানবজাতিকে এখনো অনুপ্রাণিত করে।

মৌখিক প্রচলনের ঐতিহ্য

কোরআন প্রথম অবতীর্ণ থেকেই কেবল একটি “পাঠ্য” ছিল না, বরং এটি একটি “শ্রুতিমূলক অভিজ্ঞতা” বা মৌখিক প্রচলন (oral tradition) হিসেবে মুসলিম উম্মার কাছে পৌঁছেছিল। নবী মুহাম্মদ –এর জীবদ্দশায় ওহি প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা সাহাবাদের সামনে পাঠ করতেন, যারা তা মুখস্থ করতেন এবং পরবর্তীদের শেখাতেন। এই মৌখিক পদ্ধতি কোরআনের সংরক্ষণের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে।

নবী –এর সঙ্গে এই ধারাবাহিক সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় জিবরাঈল (আঃ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। প্রতি রমজানে তিনি নবী –এর কাছে এসে পুরো কোরআন তিলাওয়াত করতেন, যা নবী –এর দ্বারা পুনঃমূল্যায়ন করা হতো। সহীহ বুখারীতে এসেছে—

كَانَ جِبْرِيلُ يُعَارِضُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ القُرْآنَ كُلَّ سَنَةٍ مَرَّةً
“প্রতি বছর জিবরাঈল নবী –এর সঙ্গে কোরআনের মিলন ঘটাতেন একবার।” (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৯৯৮)

উল্লেখযোগ্য হলো, শেষ বছরে এই পুনরালোচনা বা عرض দু’বার সম্পন্ন হয়েছিল, যা কোরআনের ধারাবাহিকতা, সঠিকতা ও পূর্ণতা নিশ্চিত করেছিল।

শুধু মৌখিক মাধ্যমেই নয়, নবী –এর নির্দেশে কিছু সাহাবিও কোরআনের সংরক্ষণে লিখিত প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। জায়েদ ইবন থাবিত, উবাই ইবন কা‘ব এবং আলী ইবন আবি তালিব (রা.)–রা এর অন্যতম প্রধান অংশগ্রহণকারী ছিলেন। তারা নবী –এর তত্ত্বাবধানে আয়াতসমূহ লিখে সংরক্ষণ করতেন, যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্মও সঠিকভাবে পাঠ ও উচ্চারণ শিখতে পারে। এইভাবে, কোরআনের মৌখিক প্রচলন নবী –এর জীবদ্দশায়ই তার সম্পূর্ণতা ও সঠিক পাঠের নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল। মৌখিক এবং লিখিত সংরক্ষণ একত্রে কোরআনের অক্ষুণ্ণতা ও যুগে যুগে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে, যা পরবর্তী সংকলন ও উসমানী মানদণ্ডীকরণের ভিত্তি স্থাপন করে।

প্রথম সংকলন: আবু বকর رضي الله عنه–এর যুগ

নবী –এর ওফাতের পর ইসলামিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়। নবী –এর অসংখ্য সাহাবা কোরআন মুখস্থ করতেন, তবে ইয়ামামার যুদ্ধ (১২ হিজরি)–এ অনেক হাফিজ শহীদ হন। এই ঘটনা মুসলিম সমাজে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা.) তখন আবু বকর (রা.)–কে সতর্ক করেছিলেন, যদি এই হাফিজদের সংখ্যা আরও কমে যায়, তবে কোরআনের কিছু অংশ হারিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে হযরত আবু বকর (রা.) কোরআনকে লিখিত আকারে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্যোগ ছিল ইসলামী ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা কোরআনের অক্ষুণ্ণতা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য ছিল।

জায়েদ ইবন থাবিত (রা.)–কে এই সংকলনের জন্য প্রধান দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেন; প্রতিটি আয়াতের সত্যতা যাচাই করার জন্য তিনি দুইটি প্রমাণের উপর নির্ভর করতেন। প্রথম, মুখস্থকারীদের সাক্ষ্য; দ্বিতীয়, নবী –এর সময়কালীন লিখিত নথি। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করেছিল যে কোনো ভুল বা অবৈধ সংযোজন সংকলনে স্থান পায়নি।

সংকলনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এই মুসহাফ হাফসা (রা.)–এর কাছে সংরক্ষিত হয়। তাকে বলা হয় Muṣḥaf al-iddīqī, অর্থাৎ আবু বকর (রা.)–এর সংকলিত প্রথম কোরআন। এটি কেবল একটি লিপিবদ্ধ কপি ছিল না; বরং মুসলিম উম্মার জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছিল, যা কোরআনের পাঠ, উচ্চারণ ও সংরক্ষণে ধারাবাহিকতার ভিত্তি তৈরি করেছিল। এই প্রথম সংকলন ইসলামী ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এটি পরবর্তী উসমান (রা.)–এর মানদণ্ডীকরণের জন্য দৃঢ় ভিত্তি সরবরাহ করে, যা মুসলিম সমাজে কোরআনের একক ও সঠিক পাঠ নিশ্চিত করেছে। আবু বকর (রা.)–এর এই উদ্যোগ নবী –এর সময়ের মৌখিক প্রচলনকে লিখিত রূপে রূপান্তরিত করে, যা কোরআনের অক্ষুণ্ণ সংরক্ষণের পথ সুগম করেছে।

উসমানীয় মানদণ্ডীকরণ: ঐক্যের প্রয়াস

ইসলামের বিস্তার যখন আরব উপদ্বীপের সীমানার বাইরে, ইরাক, সিরিয়া, মিশর এবং খোরাসান পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন মুসলিম সমাজে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং উপভাষাগত পার্থক্য দেখা দেয়। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ কোরআন তিলাওয়াতে স্বাভাবিকভাবে উচ্চারণগত ভিন্নতা আনতে শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে, একই আয়াতের উচ্চারণে সামান্য পার্থক্যও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারত।

হযরত হুযাইফা ইবন ইয়ামান (রা.)–এর পরামর্শে খলিফা উসমান رضي الله عنه একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিতে জায়েদ ইবন থাবিত, আবদুল্লাহ ইবন আজ-যুবাইর, সাঈদ ইবন আল-আস এবং আবদুর রহমান ইবন হারিস ইবন হিশাম ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোরআনকে কুরাইশ উপভাষা অনুযায়ী মানদণ্ড হিসেবে সংরক্ষণ করা, যাতে ইসলামিক সম্প্রদায়ে পাঠে একরূপতা ও ঐক্য বজায় থাকে।

উসমান رضي الله عنه নিজ হাতে কয়েকটি মানদণ্ডিক কপি তৈরি করান এবং মদিনা, কুফা, বসরা, শাম প্রমুখ প্রধান নগরে পাঠান। একইসঙ্গে, অন্যান্য অমিল কপি ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। এই উদ্যোগের ফলে কোরআনের পাঠে কোনো বিভ্রান্তি বা বিভাজন আর দেখা যায়নি। উসমানীয় স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ ছিল না; এটি ইসলামী উম্মাহর ঐক্য এবং কোরআনের সঠিক পাঠ নিশ্চিত করার জন্য একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এটি মৌখিক ও লিখিত সংরক্ষণের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাকে সমন্বিত করে কোরআনের অক্ষুণ্ণতা রক্ষা করেছে। এই মানদণ্ডীকরণ পরবর্তীকালে মুসলিম সমাজে কোরআনের শিক্ষাদান, হাফিজ প্রশিক্ষণ এবং পাঠ্যসংগ্রহে একক নিয়ম ও ধারাবাহিকতা স্থাপন করেছে।

ফলস্বরূপ, উসমান رضي الله عنه–এর উদ্যোগই কোরআনকে সময়ের পরীক্ষায় অক্ষুণ্ণ রাখে এবং মুসলিম উম্মার মধ্যে পাঠের ঐক্য নিশ্চিত করে, যা আজও সমগ্র পৃথিবীতে একইভাবে কার্যকর।

কিরআত ও রসম: পাঠের বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ

উসমান رضي الله عنه–এর সময়ে সংকলিত মুসহাফে স্বরবর্ণ (তাশকীল) এবং বিন্দু (নুকতা) ব্যবহার করা হয়নি। কারণ, তৎকালীন আরবি পাঠকেরা এসব চিহ্ন ছাড়া সঠিকভাবে কোরআন পাঠ করতে পারতেন। এই স্বাভাবিক পাঠ্য পদ্ধতির কারণে কোরআনের বৈধ বিভিন্ন কিরআত, অর্থাৎ পাঠভঙ্গি, সংরক্ষিত থাকতে সক্ষম হয়।

উসমানীয় সংকলন মূলত রসমের ওপর নির্ভরশীল ছিল। রসম হলো আক্ষরিক লিপি বা বর্ণনির্ধারিত বিন্যাস, যা নবী –এর যুগ থেকে ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করা হয়। এতে কোনো উচ্চারণগত পরিবর্তন বা সংযোজন করা হয়নি, ফলে কোরআনের মৌলিক পাঠ অক্ষুণ্ণ থাকে।

পরবর্তীতে, হযরত আলী (রা.)–এর আমলে বা তার কিছু পরে আবুল আসওয়াদ আদ-দুয়ালী (রহ.) আরবি ব্যাকরণের নিয়মাবলি প্রবর্তন করেন। তিনি বিন্দু ও স্বরচিহ্ন সংযোজন করে পাঠকে আরও সহজ এবং সঠিক করার চেষ্টা করেন। তবে এই ধাপ কেবল পাঠের সুবিধার্থে করা হয়; উসমানীয় মুসহাফের মূল রসম অপরিবর্তিত থাকে।

ইমাম আজ-যরকানি ও অন্যান্য তাফসিরবিদদের মতে, কোরআনের রসম তাওকীফী — অর্থাৎ এটি নবী –এর নির্দেশাধীন সংরক্ষিত লিপি। রসম শুধু ভাষাগত প্রচলন নয়; এটি সরাসরি ওহির প্রতিফলন। এই কারণে কোনো বর্ণসংযোজন, সংক্ষিপ্ত পরিবর্তন বা স্বেচ্ছায় সম্পাদনা অনুমোদিত নয়।

ফলস্বরূপ, উসমানীয় সংকলন কেবল কোরআনের পাঠের একক মানদণ্ড স্থাপন করেনি, বরং বৈধ কিরআত ও পাঠভঙ্গির সংরক্ষণ নিশ্চিত করেছে। আজও মুসলিম উম্মা উসমানীয় রসম অনুযায়ী কোরআন পাঠ করে এবং সঠিক উচ্চারণ ও ঐক্য বজায় থাকে, যা ইসলামের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সংরক্ষণ প্রচেষ্টার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ।

সংরক্ষণের ঈশ্বরীয় পূর্ণতা

উসমান رضي الله عنه–এর সংকলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোরআন তার মূল রসম ও ক্রমে অক্ষুণ্ণভাবে সংরক্ষিত আছে। শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। মুসলিম উম্মা আজও সেই একই মুসহাফ অনুসরণ করে, যা প্রমাণ করে কোরআনের অক্ষুণ্ণতা ও ধারাবাহিকতা অতুলনীয়।

এত দীর্ঘ সময় ধরে মৌখিক এবং লিখিত উভয় মাধ্যমে একই পাঠ সংরক্ষিত থাকার ঘটনা ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। নবী –এর সময়কার মৌখিক মুখস্থ প্রথা, আবু বকর (রা.)–এর প্রথম সংকলন এবং উসমান (রা.)–এর মানদণ্ডীকরণ একত্রিত হয়ে কোরআনের অক্ষুণ্ণতা নিশ্চিত করেছে।

পশ্চিমা গবেষকরা প্রাথমিকভাবে কিছু সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। যেমন, থিওডর নোল্ডেকে ও আলফ্রেড মিংগানা প্রথমে মনে করেছিলেন, প্রাথমিক কোরআনের পাঠে বিভিন্ন পরিবর্তন বা বৈষম্য থাকতে পারে। তবে পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, উসমানীয় সংকলনের পাঠের ধারাবাহিকতা একেবারে অকাট্য এবং এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। উসমানীয় মুসহাফের রসম ও পাঠ আজও মুসলিম উম্মার জন্য একক মানদণ্ড হিসেবে কার্যকর।

এখানেই কোরআনের ঈশ্বরীয় সংরক্ষণের বিস্ময়। আল্লাহ তায়ালা নিজস্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোরআনকে যুগে যুগে অক্ষুণ্ণ রাখছেন। মুসলিম উম্মা এই নিদর্শন থেকে শিক্ষা নেয় যে, আল্লাহর বাণী শুধু প্রাচীন ইতিহাসের রেকর্ড নয়, বরং আজকের দিনের জীবন্ত দিশারী।

ফলে, উসমানীয় সংকলন কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; এটি ইসলামের ধারাবাহিকতা, সংরক্ষণ এবং ঐক্যের প্রতীক। কোরআনের এই অক্ষুণ্ণতা মুসলিম উম্মাকে একত্রিত রাখে এবং বিশ্বে ইসলামের ঐতিহ্য ও শিক্ষা অটুটভাবে প্রচারিত হয়।

উপসংহার

কোরআনের সংরক্ষণ মানবজাতির ইতিহাসে এক অনন্য ও বিস্ময়কর অধ্যায়। নবী –এর জীবদ্দশায় মৌখিক পাঠের ঐতিহ্য, হযরত আবু বকর (রা.)–এর লিখিত সংকলন এবং হযরত উসমান (রা.)–এর মানদণ্ডীকরণ—এই তিন ধাপে আল্লাহর বাণী যুগে যুগে অক্ষত ও অম্লানভাবে রক্ষা পেয়েছে। এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টা নিশ্চিত করেছে যে কোরআনের পাঠ, উচ্চারণ ও ক্রম সবসময় একই রকম থাকে।

আজ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মুসলিম যদি কোরআনের একটি আয়াত পাঠ করেন, তা অন্য প্রান্তের মুসলিমের পাঠের সঙ্গে হুবহু মিলবে। এই একক মানদণ্ডের প্রতিষ্ঠা কোরআনের অক্ষুণ্ণতা ও ইসলামী উম্মার ঐক্যের প্রকাশ। উসমানীয় মানদণ্ডীকরণের এই সাফল্যই প্রমাণ করে যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে—কোরআন যুগে যুগে অক্ষত রয়ে গেছে।

কোরআনের সংরক্ষণ কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব পূরণই নয়; এটি মুসলিম সমাজের ঐক্য, পাঠের ধারাবাহিকতা এবং ইসলামের বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রতীক। ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো ধ্বংস বা বিভ্রান্তি কোরআনের পাঠে প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই অক্ষুণ্ণতা মুসলিম উম্মাকে একত্রিত রাখে এবং বিশ্বে ইসলামের শিক্ষা অটুটভাবে প্রচারিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন—

لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ ۖ تَنْزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ
“এতে মিথ্যা ঢুকতে পারে না—না সামনে থেকে, না পেছন থেকে; এটি প্রেরিত হয়েছে প্রজ্ঞাময়, প্রশংসনীয় আল্লাহর পক্ষ থেকে।” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১:৪২)

ফলস্বরূপ, কোরআনের সংরক্ষণে নবী –এর নির্দেশ, সাহাবাদের প্রচেষ্টা এবং উসমানীয় মানদণ্ডীকরণ একত্রিত হয়ে একটি যুগান্তকারী ইতিহাস তৈরি করেছে, যা মুসলিম উম্মার জন্য আজও দিশারী ও প্রেরণার উৎস।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter