এঙ্গেলস এবং ইবনে খালদুন: সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এবং ইবনে খালদুন, উভয়ই সমাজ এবং ইতিহাসের উন্নয়ন নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন, যদিও তাদের সময় এবং স্থান আলাদা। এঙ্গেলস, ১৯শ শতকের সমাজতান্ত্রিক দার্শনিক, সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং শ্রেণী সংগ্রামের ওপর জোর দিয়েছেন, মনে করেন যে ইতিহাস একটি শ্রেণীগত সংঘর্ষের ধারাবাহিকতা। অপরদিকে, ইবনে খালদুন, ১৪শ শতকের মুসলিম ঐতিহাসিক, তার "মুকাদ্দিমা" গ্রন্থে সমাজের উত্থান-পতন, রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং সামাজিক প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করেছেন, যা তিনি 'আসাবিয়া' বা সামাজিক সংহতির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, ইতিহাসের উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবর্তন একটি অমীমাংসিত সম্পর্কের অংশ যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উপাদানের পারস্পরিক প্রভাব দ্বারা পরিচালিত হয়। এঙ্গেলসের শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব এবং খালদুনের ঐতিহাসিক পদ্ধতির মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য উল্লেখ করে তাদের চিন্তাধারার সমন্বয় একটি সমৃদ্ধ আলোচনা তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে, যা সমাজ এবং ইতিহাসের সমন্বিত বোঝাপড়ায় সহায়তা করে।
প্রারম্ভিক খ্রিস্টধর্ম এবং সমাজতন্ত্র
1894 সালে, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তার পরবর্তী বছরগুলিতে Neue Zeit পত্রিকায় প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের উপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তার প্রাথমিক গবেষণায়, এঙ্গেলস প্রাথমিক খ্রিস্টধর্ম এবং সমাজতন্ত্রের তুলনা করেছিলেন। "প্রাথমিক খ্রিস্টধর্ম এবং শ্রমিক সমাজতন্ত্র উভয়ই দাসত্ব ও দুর্ভোগ থেকে মুক্তির প্রচার করেছিল," তিনি বলেছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের জন্য, মৃত্যুর পরে স্বর্গে মুক্তি ঘটবে, অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের জন্য, সমাজের পরিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীতে মুক্তি ঘটবে।
এঙ্গেলস আরও উল্লেখ করেছেন যে মধ্যযুগে কৃষক ও শহুরে শ্রমিকদের বিদ্রোহ ছিল ধর্মীয় আধিপত্যের সামাজিক আন্দোলন। এই বিদ্রোহগুলি অবশ্যই একটি ধর্মীয় মুখোশ পরেছিল এবং প্রাথমিক খ্রিস্টধর্ম পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা হয়েছিল। তবে ধর্মীয় গোঁড়ামির পেছনে সব সময়ই বাস্তব ধর্মনিরপেক্ষ স্বার্থ থাকে। এঙ্গেলস বিশ্বাস করতেন যে প্রাথমিক খ্রিস্টধর্ম এবং সমাজতন্ত্র উভয়ই ব্যাপক শোষণ ও অসন্তোষের সামাজিক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত হয়েছিল।এঙ্গেলস প্রারম্ভিক খ্রিস্টধর্মকে শোষিত ও অধিকার বঞ্চিতদের ঐক্যবদ্ধ করার একটি প্রোটো-কমিউনিস্ট আন্দোলন হিসেবে দেখেছিলেন।
ইসলামী বিশ্বে ধর্মীয় বিদ্রোহ
ইসলামী বিশ্বের ধর্মীয় বিদ্রোহের একটি বৈশিষ্ট্য হল যে তারা প্রায়শই অর্থনৈতিক কারণের সাথে যুক্ত থাকে। ইসলামে ধর্মীয় অস্থিরতা, বিশেষ করে আফ্রিকায়, বেদুইনদের প্রভাব দ্বারা চালিত হয়েছিল, যারা শহরগুলিতে সমৃদ্ধ এবং শিথিল অনুগামীদের শাস্তি দিতে এবং "আইন" পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে একত্রিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের উদাহরণ আফ্রিকার আলমোরাভিড এবং আলমোহাদের স্প্যানিশ বিজয়গুলিতে দেখা যায়।
ইসলামী বিশ্বে এ ধরনের বিদ্রোহ প্রায়ই একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সফল হয়। আলমোরাভিদ এবং আলমোহাদের বিদ্রোহ ও বিজয়ের ইতিহাস ইবনে খালদুনের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইবনে খালদুন বিশ্বাস করতেন যে এই ধরনের বিদ্রোহ ও আন্দোলন প্রায়শই আদিম ধর্মীয় উচ্ছ্বাস দ্বারা চালিত হয়, কিন্তু তাদের পিছনে প্রকৃত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ ছিল। এই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণগুলি প্রাথমিক ইসলাম থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলনের মধ্যে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
ইবনে খালদুনের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা
ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত গ্রন্থ মুকাদ্দিমাহ-এ বেদুইনদের সাথে শহরের রাজবংশের দ্বন্দ্বের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে কাসাবিয়ার শক্তি, বা বেদুইনদের মধ্যে উপদলীয় ঐক্য তাদের অলস এবং ধনী নগর সরকারগুলিকে উৎখাত করতে দেয়। ইবনে খালদুন বিশ্বাস করতেন যে একটি রাজত্ব সাধারণত তিন প্রজন্ম বা 120 বছরের মধ্যে বিলাসিতা ও ভোগবাদে নেমে আসে।
ইবনে খালদুনের মতে, রাজত্বকালে প্রথম প্রজন্ম সাধারণত পরিশ্রমী এবং সংগ্রামী ছিল, দ্বিতীয় প্রজন্ম কিছুটা বিলাসিতা এবং শিথিলতায় বসবাস করত এবং তৃতীয় প্রজন্ম সম্পূর্ণরূপে বিলাসিতা এবং ভোগবাদে নিমজ্জিত ছিল, যার ফলে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নতুন বেদুইন বাহিনীর দ্বারা উৎখাত হয়েছিল। চক্রাকার ইতিহাস সম্পর্কে ইবনে খালদুনের ধারণা সামাজিক পরিবর্তন ও নবায়নের চলমান প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এঙ্গেলস ও ইবনে খালদুনের মতের তুলনা
এঙ্গেলস এবং ইবনে খালদুন উভয়েই ইতিহাস এবং সামাজিক পরিবর্তনে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এঙ্গেলস বিশ্বাস করতেন যে ইসলামী বিদ্রোহ প্রায়ই পুরানো অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটে। অন্যদিকে, পশ্চিমা খ্রিস্টান সমাজে ধর্মীয় আন্দোলন অর্থনৈতিক মডেলকে আক্রমণ করে এবং নতুন অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করে।
এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইবনে খালদুনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি মূল পার্থক্য হলো এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করেন, যেখানে ইবনে খালদুন ঐতিহাসিক চক্র এবং বেদুইন এবং শহুরে রাজবংশের সংঘর্ষের মাধ্যমে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করেন। এঙ্গেলসের মতে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি প্রায়শই শ্রমিকদের সংগ্রামের মাধ্যমে আসে, যেখানে ইবনে খালদুনের মতে, পরিবর্তনগুলি প্রায়শই বেদুইন এবং শহুরে রাজবংশের সংঘর্ষ এবং পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে আসে।
সমাপ্তি
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এবং ইবনে খালদুনের চিন্তাধারার মধ্যে কিছু মিল রয়েছে, যেমন তাদের উভয়েই ধর্মীয় উত্থান এবং সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে, যা তাদের নিজ নিজ সময় এবং সমাজের প্রেক্ষাপটে বোঝা যায়। এঙ্গেলসের সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণ এবং ইবনে খালদুনের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ উভয়েই সমাজ এবং ইতিহাসের জটিলতাকে বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
এঙ্গেলসের সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইবনে খালদুনের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ আমাদেরকে সমাজ এবং ইতিহাসের একটি সম্পূর্ণ চিত্র প্রদান করে, যা সমাজের পরিবর্তন এবং উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে বোঝার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। এই প্রবন্ধে এঙ্গেলস এবং ইবনে খালদুনের চিন্তাধারার মূল পয়েন্টগুলো তুলে ধরা হয়েছে।