প্রয়াত বাংলার বিশিষ্ঠ সমাজসেবী ও বিজ্ঞানী ও শিক্ষা-পিতা স্যার ড. মুনকির হোসেন (১৯৫৪ - ২০২৫) সাহেব

সাহেব মুহাম্মদ মুনকির হোসেন (১৯৫৪ - ২০২৫) একটি জীবনের বিভিন্ন চরিত্রের সমাহার। আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী হয়েও সর্বস্ব ত্যাগ করে মাতৃভূমির উন্নতি প্রধান লক্ষ্যে রাখেন। বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে বোম্বে (এখন মুম্বাই), জাপান এবং তাইওয়ানের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানসমূহে রসায়ন বিজ্ঞানে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বেক্তিগত জীবনে তিনি সর্বদা সুফী-সাধকদের চরিত্র-বৈশিষ্ট অবলম্বন করে দিন কাটিয়েছেন। অপরুন্তু, তাঁর স্বপ্ন - প্রতিটি গ্রামীণ ব্যক্তির স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি তাঁর সমস্ত উপার্জন আসন্ন প্রজন্মের জন্য উৎসর্গ করে দেন। এই ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ গত পাঁচ তারিখ বুধবার রাত ১১'টার মধ্যে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন তাঁর শিক্ষা-সন্তান শিষ্যদের অর্পণ করে না ফিরে আসার দেশে চলে গেলেন। সারা বাংলা এবং সুদূর কেরালা বিলাপ শোকে ভেঙে পরে।

প্রান্তিক গ্রাম থেকে উঠে বড়ো মানের এক বিজ্ঞানী হওয়া পর্যন্ত মুনকির হোসেনের জীবন রহস্য, পরিশ্রম, সংগ্রাম, ধৈর্য ও স্বপ্নের বিভিন্নতায় পরিপূর্ণ। গবেষণা-পরবর্তী অবসরকালে তাঁর চিন্তাধারা ও ভাবমূর্তিতে দার্শনিক ছাপ ও সার্বজনীন সৌন্দর্যতা পরিলক্ষিত হয়। বাস্তবে মুনকির হোসেনের জীবন শ্রেণীকরণে ‘অবসর’ শব্দটি প্রয়োগ করলে অবিচার হবে। তাঁর সক্রিয়তা কখনই থামেনি - এক অনন্ত শক্তি যা শুধুমাত্র নিয়তিরই রহস্য। উপরন্তু, জীবন মেয়াদ সমাপ্ত হলেও প্রভাব চিরস্থায়ী - জ্ঞান, আদর্শ, সেবা ও নির্মাণের মাধ্যমে যেসবের মধ্যে মুনকির হোসেন নিজেকে নিমজ্জিত করেছিলেন। উক্ত রহস্যের অন্নেষণে পটভূমি হিসেবে সংক্ষেপে এই সংগ্রামী, অনুসন্ধানী, মনীষী, পুণ্যার্থী জীবনী তুলে ধরা হল।

গ্রাম থেকে গ্রামের বিজ্ঞানী

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মুরারই বাজার থেকে উত্তর-পূর্বে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভীমপুরে নানীর বাড়িতে মুনকির হোসেনের শৈশব ও যৌবন কাল কাটে। ফলত এটাই তাঁর গ্রাম হিসেবে সবার জানা। কিন্তু তাঁর পিতৃগৃহ ছিল আরও এক কিলোমিটার গিয়ে পাগলা নদী পেরিয়ে খুটকাইল গ্রামে। তিনি ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনার পিতার নাম ছিল ফায়েজ হোসেন এবং মাতা ছিলেন রাজিয়া বিবি। পরিবার একেবারেই অর্থসম্পর্ণ ছিল না। পিতা ফায়েজ দিন মজুরের শ্রম করতেন। দিনে পাঁচ থেকে দশ টাকার বেশি উপার্জন হতো না। বাল্যকালে তিনি সময় সময় চাষে বাবাকে সহায়তা করতে মাঠে নামতেন।

বাল্যকাল থেকেই মুনকির হোসেনের স্বপ্নের বাঁধা নেয়। লেখে পড়ে বড়ো হওয়া ছিল চিরন্তর ভাবনা। ভাগ্য তাঁকে ওই পথেই নিয়ে যায়। প্রধানত আর্থিক প্রতিকূলতাই তাঁকে পাশে গ্রামে ভীমপুরে তাঁর নানার বাড়ি নিয়ে আসে। গভীর অভ্যন্তরীণ গ্রাম হলেও, ভীমপুর বীরভূম ইতিহাসের একটি সুপরিচিত নাম। এই গ্রামীণ মাটি থেকেই জাতীয় ও রাজ্যব্যাপী খ্যাতিসম্পন্ন বেশ কয়েক বেক্তিত্ব বেরিয়েছেন।

১৮ মাস বয়সেই শিশু মুনকির হোসেনকে নানা মাজেদ শেখ এবং নানী সাহিবা বিবির বাড়ি ভীমপুরে নিয়ে আসা হয়। এখানেই তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত হয়। ভীমপুরই হয়ে যায় তাঁর আসল গ্রাম। চার বছর বয়সে ভীমপুর প্রাইমারি স্কুলে যান। বড়ো হয়েও মুনকির হোসেন তাঁর জীবনে প্রাইমারি স্কুলের অবদান ভুলেননি। তিনি কৃতজ্ঞ মনে জ্ঞাপন করেন:

“ওই প্রাথমিক স্কুলটি ছিল বলেই আমার পড়াশোনা করা সম্ভব হয়েছে। না হলে কি হত জানি না। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সব সময় আমার পাশে থেকে জ্ঞানের খিদে বাড়াতে সাহায্য করেন। তাঁদের মতো শিক্ষক পাওয়ার জন্যই আমি তাইওয়ান, জাপানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছি।” পুবের কলমের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন।

প্রায় ১৯৬৬-এর দিকে নয়াগ্রাম ওয়াইএম (ইয়াকুব মন্ডল) জুনিয়র হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৬ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে মাধ্যমিক পড়েন পাইকর হাই স্কুলে। মুনকির সাহেব স্বরণ করেন যে এখানে তিনি খুব ভালো ও উপকারী বন্ধু আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গতা পান। ১৯৭৩ সালে প্রায় ১৯ বছর বয়সে হেতমপুরের কৃষ্ণ চান্দ্রা কলেজে স্নাতকের জন্য ভর্তি হন।

তারপর মুরারাইতে অবস্থিত কাজী নজরুল কলেজে মুনকির সাহেব শিক্ষকতার সুযোগ পান। প্রথমবারের মতো তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার আকর্ষণ তাঁর মধ্যে দৃঢ় হচ্ছিল। ছয় মাস পর ২৬ বছর বয়সে ১৯৮০ সালে গবেষণা স্তরের পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর্থিক অনটনের কারণে, মুনকির সাহেবের প্রথমে ভর্তিতে অসুবিধা হয়। কিন্তু আত্মীয়তার মামা মোতাহার হোসেনের মধ্যবর্ত্তিতায় অবশেষে মুনকির সাহেব বিশেষ আসনে স্থান পান। অধ্যাপক আরএল দত্তের তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৮৬ সালে। তাঁর থিসিসের ছিল ‘স্টাডিস অন সালেট কমপ্লেক্স অফ হাইড্রোজেন চিপ বাসিস’

মালদার সুজাপুর হাই মাদ্রাসায় শিক্ষকতার জন্য আবার নিযুক্ত হন। কিন্তু পাঁচ মাসের মধ্যেই সিএসআইআর (কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ)-এর একটি বিশেষ প্রোজেকটে সুযোগ পান। অধ্যাপক আরএল দত্ত এবং প্রদীপ মাথুরের তত্ত্বাবধানে, তিনি বর্ধমানে দুই বছর এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (বোম্বে)-তে তিন বছর এই প্রকল্পের জন্য কাজ করেন।

এর পর তাঁর জীবনের ২০ বছর বিদেশে কাটে। জাপান ও তাইওয়ান দুই দেশে তিনি বিশেষ ফেলোশিপ পেয়ে বহু গবেষণা করেছেন। তাইওয়ানের ন্যাশনাল সিন্চ ইউনিভার্সিটিতে প্রথমে এক বছর থাকেন (১৯৯৬-১৯৯৭)। তারপর দুই বছরের জন্য জাপানে যান এবং আবার ১৯৯৯ তাইওয়ান ফিরে আসেন ও একাডেমিয়া সিনাকেতে ২০১৬ পর্যন্ত পোস্ট ডক্টরিয়াল গবষেণায় থাকেন। এখানে থেকে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের তদারকি করেন এবং অনেক গবেষণায় সাহায্যও করেন।

ড. মুনকির হোসেন সাহেব তাঁর গবেষণা কর্মজীবনে ৩০টি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নালে ৪০টিরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন, যার অনেকগুলি এখনও ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। পুবের কলমের এক সাক্ষাৎকারে জাতীয়, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তাঁর রিসার্চ ওয়ার্কের সংখ্যা ৫৫টি বলা হয়েছে।

গুগল গিয়ে তাঁর রিসার্চ গেট (ResearchGate) প্রোফাইল বিশ্লেষণ করলে এই তথ্য পাওয়া যায়। ড. মোহাম্মদ মুনকির হোসেন ইনস্টিটিউট অফ কেমিস্ট্রি, একাডেমিয়া সিনিকার পিএইচডি গবেষক। তিনি ৪৭টি গবেষণা নিবন্ধ এবং অধ্যয়ন প্রকাশ করেছেন, যা সম্মিলিতভাবে ১,০৯৬টি পঠিত এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সাইটেশন সংগ্রহ করেছে। তাঁর কাজ সক্রিয়ভাবে সহ গবেষকদের দ্বারা উদ্ধৃত করা হয় যা বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনার প্রভাব প্রতিফলিত করে। ডক্টর সাহেব বিজ্ঞান ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সহ প্ল্যাটফর্মে ১,০২১ সংযোগের একটি নেটওয়ার্ক বিনিয়ে রেখেছেন যা এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রোফাইলে এটারও ইঙ্গিত পাওয়া যে তিনি ৫০ জন আন্তর্জাতিক খ্যাতির সহ-লেখকদের সঙ্গে গবেষণা করেছেন।

মানুষের সেবায়

গবেষণাকালে মাঝে মাঝে যখন তিনি দেশে ফিরে আসেন বিভিন্ন মানবিক ও জনহিতকর কাজে লেগে নিযুক্ত হয়ে যান। এই ক্ষেত্রে তাঁর একটি স্থায়ী অবদান হল ভীমপুরের মাটিতে কেরাল-ভিত্তিক দারুল হুদা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির শাখা দারুল হুদা বেঙ্গল ক্যাম্পাসের বাস্তবায়ন ।

দারুল হুদা বেঙ্গল ক্যাম্পাস ভীমপুর গ্রামের মাটিতে তাঁর উচ্চ স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে প্রতি বছর প্রায় 80 জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় এবংসম্পূর্ণ বৃত্তিতে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বারো বছরের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা লাভ করে। এই বিরাট কেরালা মডেল প্রতিষ্ঠানের জন্য মুনকির স্যার তাঁর জীবনের উপার্জিত সমস্ত সম্পদ ব্যয় করে ১১ একর জমি প্রদান করেন এবং এর সার্বিক প্রগতিতে বিভিন্ন ভাবে অবদান রাখেন। স্যার এখন ক্যাম্পাসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মনোনীত। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন এবং দেখতে শিখিয়েছেন, এখন তাঁর শত শত আধ্যাত্মিক সন্তান বাংলা এবং পূর্ব ভারতের ভবিষ্যত গঠনের মাধ্যমে তা পূরণ করতে সক্ষম।

মুনকির সাহেব এতেও প্রশমিত ছিলেন না। তিনি একটি বিশেষ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে গ্রামীণ জনসংখ্যা তাদের অবসর সময়ে অবাধে যোগ দিতে এবং কিছু শিখতে পারে। তিনি একটি নৈতিক বালিকা বিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেন যেখানে একজন ভবিষ্যতের আদর্শ মাকে লালন-পালন করা যায় এবং এটি এখন দারুল হুদা বেঙ্গল ক্যাম্পাসের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন। তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি প্রসূতি হাসপাতালের যেখানে যদি এখন তাঁর মা জীবিত থাকতেন তাহলে শুধুমাত্র মহিলাদের হাতেই চিকিৎসা পাবেন। সাধক, সেবক রসায়ন বিজ্ঞানী ড. মুনকির হোসেন স্যার রিক্ত হয়েও, সিক্ত হয়েও দিয়ে গেছেন সর্বশ্র।

মূল্যবোধের মানুষ

বিজ্ঞানী ড. মুনকির হোসেনের জীবনের অবিচ্ছেদ পরিচয়দ্বয় আত্ম সংযম ও সমাজ সেবা সংক্ষেপেই সারতে হচ্ছে, তাছাড়া প্রত্যেকটিই পৃথক বিশেষ আলোচনার বিষয়। ঈশ্বর সন্তুষ্টিই তিনার মূল উদ্যেশ্য ছিল। তাঁর আচার-আচরণে, কথা-বার্তায়, খাওয়া-দেওয়াতে ইসলামী ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে মহা আদর্শ মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি চিরন্তর নিরুত্তর ভালোবাসা প্রকাশ পায়। তিনি সর্বদা সার্বিক সমাজের চিন্তা করেন যেখানে সবাই সকল বাধা এড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ; তাদের আনন্দ-বেদনা একত্রে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।

তিনি সর্বদা কর্মে বোঝান যে আত্মসমৃদ্ধি, অহংবোধ এই সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান বাধা। তবে তিনি আত্ম ত্যাগ, সন্তুষ্টি, সংযম, ধৈর্য, স্থিতিস্থাপকতা, সদিচ্ছা, সরলতা, নম্রতা ও অবিলাসিতার খুব সুন্দর দৃষ্টান্ত দেখান যেরকম তাঁর জীবন পর্ব থেকে জানা যায় - কখনও পায়ে ছিড়া চটি পরে, কিপ্যাড ফোন ব্যবহার করে, মায়ের স্বরণে নিজস্ব বাসস্থান না বানিয়ে, রাতের পর রাত মসজিদেই অতিবাহিত করে, এক দিন পর এক দিন রোজা (উপবাস) পালন করে, সমগ্র উপার্জন সমাজ নির্মাণে ব্যায় করে এবং হজ্জ্ব ভ্রমণের উদ্দেশে মাঠে চাষের মাধ্যমে।

সারাজীবনে বিজ্ঞানী মুনকির সাহেবের বিলাসিতা বলতে দুটি প্যান্ট আর দুটি শার্ট। সেই দিয়ে গোটা বিশ্ব ঘুরেছেন তিনি। বাংলা সংস্কৃতির মঞ্চের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দুঃস্থদের কল্যাণ থেকে লকডাউন থেকে ঘুর্ণিঝড়, আমফানের সময় ত্রাণের কাজ চালিয়ে গেছেন।

তিনি ধর্মের প্রতি একটি উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতেন; ঐক্য এবং অন্তর্ভুক্তির উপর জোর দেন। ড. সাহেব কেবল পবিত্র গ্রন্থেই ঐশ্বরিক সৌন্দর্য দেখেননি। তবে তিনি বলতেন সবুজ মাঠ, উঁচু গাছপালা, ক্ষুদ্র পিঁপড়া বা সাধারণ থেকে জটিল রাসায়নিক এবং অণুজীব সহ সমস্ত সৃষ্টিই স্রষ্টার লক্ষণ। স্রষ্টার আদেশ অনুসরণ করে মানব যেরকম ইবাদত বা উপাসনা করে অনুরূপ, সমস্ত সৃষ্টিই তাঁর সত্যিকারের সেবায় রয়েছে, যদিও তাদের ভাষায় ও ধরন ভিন্ন, যেহেতু তাদের সেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যাইহোক, অন্যান্য সৃষ্টির বিপরীতে, মানুষকে তাদের আনুগত্যের পরীক্ষা হিসাবে ইখতেয়ার স্বাধীন ইচ্ছার সাথে সৃষ্টি করা হয়েছে। ধর্ম শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠানের বিষয় নয়, ড. হোসেন সাহেব বিশ্বাস করতেন যে এটি একটি বিস্তৃত জীবনধারার প্রতিনিধিত্ব করে। মানব অস্তিত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত নবী মারফত প্রাপ্ত এক সামগ্রিক ব্যবস্থা। তাঁর কাছে, ধর্ম কেবল বাহ্যিক প্রদর্শন বা প্রতীক নয় বরং প্রকৃতপক্ষে আন্তরিকতা এবং অর্থপূর্ণ কর্মের মধ্যে নিহিত। তিনি জোর দিয়ে বলতেন: তোমার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় এবং তোমার পেট ভরা, তবে তা ইসলাম নয়। এটা তাঁর প্রত্যয় যে সত্যিকারের বিশ্বাস অন্যদের যত্ন এবং দৈনন্দিন জীবনে মানবিক মূল্যবোধের ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।

ডক্টর হোসেনের শিক্ষার দর্শন বর্তমান ব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণকে সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা করে। তিনি যুক্তি দেন যে শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে, শিক্ষার পণ্যীকরণ তাদের গতিশীল ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করে, শেষ পর্যন্ত বেকারত্বের দিকে পরিচালিত করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ জীবনের দক্ষতা এবং নৈতিক মূল্যবোধকে লালন করার চেয়ে ক্যারিয়ার গঠনকে অগ্রাধিকার দেয়, যা তিনি বিশ্বাস করেন যে শিক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত।

না ফেরার দেশে

প্রায় সত্তরের ঘর পেরিয়েও, রোগ পীড়া উপেক্ষা করে মুনকির স্যার দৃঢ় সংকল্প, উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গি, সার্বিক স্বপ্ন ও সমগ্র সম্ভাব্য কার্যের সঙ্গে জীবন যাপন করছেন। মনে হচ্ছিলো এখনও কিছুই রুগ্ন হয়নি। এমনকি এই সর্বস্য ত্যাগী তাঁর শেষ দিনেও কোনো প্রচার ছাড়াই মৃত্যু কামনা করেছিলেন। একবার তিনি বলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে দাফন করতে যাতে দূর থেকে লোকেদের এখানে আসতে অসুবিধা না হয়।

তাঁর ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়ে। বিভিন্ন শহরে চিকিৎসাও হয়। দারুল হুদা কর্তৃপক্ষ, পরিবার সদস্য বিশেষ করে জামাতা আমিনুল ইসলাম ও বহু শুভাকাঙ্খী তাঁর সেবা, যত্ন ও চিকিৎসায় যথেষ্ট চেষ্টা করেন। তবে অবশই অনেকেই এই পরোপকারীর সঙ্গে অকৃতদারের পরিচয় দিয়েছে। তবুও আনন্দের সঙ্গে সকলকে আলিঙ্গন করেছেন তিনি। অবশেষে গত পাঁচ তারিখ বুধবার রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে না ফিরে আসার দেশে চলে গেলেন। সারা বাংলা এবং সুদূর কেরালা বিলাপ শোকে ভেঙে পরে। তাঁর স্বপ্নালোয় দারুল হুদা বেঙ্গল ক্যাম্পাসের জুমা মসজিদ প্রাঙ্গনে তিনাকে দাফন করা হয়। দূর-দুরন্ত থেকে জনগণের প্লাবন দ্রুত ভেঙে পরে এই পরোপকারী মানুষের তরে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter