ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম বীরদের অবদানঃ কিছু অজানা সংগ্রামীদের পরিচিতি

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে ধর্মীয় নিরপেক্ষতা বজায় রেখে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীগণ ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের ঐকতা‌ ভ্রাতৃত্বের বিনিময়ে আমরা ভারতবাসী ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের কবল থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

সেই স্বাধীনতা সংগ্রামে, যদিও, বিভিন্ন মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামীরা প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন, কিন্তু ডানপন্থী সংগঠনগুলি তাদের ইতিহাস মুছে ফেলার প্রচেষ্টায় রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতের স্বাধীনতায় মুসলিম সম্প্রদায়ের অবদানের সম্পর্কে জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আসুন নিচে কিছু অজ্ঞাত বীর মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চিনিঃ-

) আবিদ হাসান সাফরানি

হায়দ্রাবাদের একজন আযাদ হিন্দ বাহিনীর (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আরমি) সৈন, আবিদ হাসান সাফরানি হায়দ্রাবাদের অজ্ঞাত সংগ্রামী নায়কদের মধ্যে একজন। তিনি শুধু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেই ভূমিকা রাখেননি বরং 'জয় হিন্দ' স্লোগানটি তিনারই সৃষ্টি, যা পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সরকারি কর্মচারীদের অভিবাদন হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

ঔপনিবেশিক বিরোধী বিশ্বাস পরিবারে ১৯১১ খৃষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল হাইদ্রাবাদ শহরে জন্ম গ্রহণ করেন আবিদ হাসান সাফরানি, এবং উক্ত শহরেই বড় হন। কিশোর বয়সে, গভীর দেশপ্রেমিক আবিদ ভারতীয় পিতা মহাত্মা গান্ধী-এর একজন শিষ্য ছিলেন, এবং সবরমতী আশ্রমে তিনার সঙ্গে অনেক সময়ও কাটিয়েছেন।

পরে, যখন তার সমবয়স্ক বন্ধুরা যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জন করতে যায়, তখন আবিদ প্রকৌশলে ডিগ্রি করার নিমিত্তে জার্মানিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং সেখানেই, ১৯৪১  সালে, তিনি ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের একটি বৈঠকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের  সঙ্গে  প্রথম দেখা করেন। নেতাজির ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তার কলেজ ছেড়ে দেন এবং তার INA আর্মি স্কুলে যোগ দেন, এবং জার্মানিতে থাকার সময়কালিন তিনি নেতাজির ব্যক্তিগত সচিব এবং দোভাষী হয়ে যান।

শীঘ্রই, যখন নেতাজি জার্মানি থেকে ফিরে আসেন তখন আপন যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শিবিরে ধার্মিক এবং জাতিগত বাধা ভেঙ্গে মুসলিম সম্প্রদ্রায়ের যুবকদের যূদ্ধের ট্রেনিং দিতে আরম্ভ করেন, আর তখনই এক এমন স্লোগানের দরকার পরে যা ধার্মিক জাতিগত সীমা থেকে যুবকদের দূরে রেখে ভারতীয় ভ্রাতৃত্ব-এর উপর উৎসাহিত করবে, তখনই আবিদ হাসান সাফরানি "জয় হিন্দ" স্লোগানটির পরামর্শ দেন, এবং সকল সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতারা মনেপ্রাণে এটিকে গ্রহণ করেন।

হাসান সাফরানি বার্মা থেকে ভারতের ইম্ফল পর্যন্ত আইএনএ-এর সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করেন। এবং ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু তাকে ভারতীয় ফরেন সার্ভিসে (IFS) অন্তর্ভুক্ত করেন। তাকে মিশর, চীন, সুইজারল্যান্ড, ইরাক, সিরিয়া, সেনেগাল এবং ডেনমার্ক সহ বেশ কয়েকটি দেশে পোস্ট করা হয়।

বিভিন্ন সরকারি পদে ব্যাপক অবদানের পর তিনি অবসর গ্রহণ করেন, এবং হায়দ্রাবাদের টলিচৌকি নামক নগরে  শাইকপেট-- স্থায়ী হন, এবং ১৯৮৪  সালে পরলোক গমন করেন।

ইতিহাস সাক্ষ্য যে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্যে নিম্মজিত মোট ৫১ হাজারের ঊর্ধ্বে মুসলিম আলেম আলেমাদের ব্রিটিশ সরকার আগুন লাগিয়ে হত্যা করে দেয় এবং তাদের জ্বলন্ত দেহকে চাঁদনী চক থেকে নতুন দিল্লি পর্যন্ত কিলোমিটার রাস্তার সমস্ত গাছে ঝুলিয়ে দেয়। 

সিরাজ উদ-দৌলা থেকে আরম্ভ করে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সকলেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নিম্মজিত থাকার কারনে ব্রিটিশদের দ্বারা কয়েকবার কারাবদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু তবুও মুসলিম সম্প্রদায় নিজ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থেকেছেন এবং ভারতবর্ষ স্বাধীনতায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। 

আমরা সকলেই ফিরাউনের ব্যাপারে শুনেছি যে সে বানি ইসরাইলের মেয়েদের কারাবদ্ধ করে রাখত এবং ছেলেদের হত্যা করে দিত। কিন্তু ব্রিটিশরা তো স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরুতে ১৮৫৭ সালে ২২৫ মুসলিম মহিলাকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে খুন করেছিল। 

) মির কাসিম খান 

মির কাসিম খান রাজকীয় নবাব পরিবারের যোদ্ধা, ১৭৬০ থেকে ১৭৬৩ পর্যন্ত বেঙ্গল সহ বিহারের নবাব ছিলেন, যদিও তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্দিয়া কোম্পানির সাহায্যে পূর্ব নবাব মির জাফারকে হারিয়ে নবাব হয়েছিলেন, কিন্তু তবুও তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই ১৭৬৩ সালেই আরম্ভ করে দেন। তিনি আপন শেষ শ্বাস অবধি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তিনি শুধু এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেন যে শুধুমাত্র ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়িয়ে আপন রাজ্যের নিরাপত্তা এবং জনগণের স্বাধীনতা সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। 

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে পাটনার গণহত্যা এর একটি উত্তম উদাহরণ। বাংলার নবাব মীর কাসিম এবং বিহারের কোম্পানির কারখানার প্রধান উইলিয়াম এলিসের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের ফলে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের প্রাণ হারাতে হয়। ঘটনাটি ১৭৬৩ সালের অক্টোবর মাসে বিহারের পাটনা জেলায় ঘটে। 

ওয়িল্লিয়াম এলিস নবাব মির কাসিমকে পদচ্যুত করতে বাধ্য করার জন্যে অভ্যন্তরীণ শুল্ক প্রদানের ক্ষেত্রে কোম্পানি অসংযত আচরণ শুরু করে, কোম্পানি থেকে পাঁচ মণ সল্টপিটার কেনা নবাবের অফিসারকে গ্রেপ্তার করে, এছাড়া এলিস তার কমান্ডের অধীনে সৈন্যদের পাটনা শহরটি দখল করার নির্দেশ দেয়।

আগ্রাসনের এই কাজের প্রতিক্রিয়ায়, মীর কাসিম পাটনায় আক্রমণ শুরু করেন, কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে আলীবর্দী খানের ভাই হাজি আহমদের বাড়িতে বন্দী করেন এবং বন্দীদের গণহত্যার নির্দেশ দেন। তিনি স্বাধীনতার এই লড়ায়ে মে ১৭৭৭ সালে পরলোক গমন করেন  

) হায়দার আলী

১৭২২ সালে মহীশুর শহরের বুড়িকোট নগরে জন্মগত হায়দার আলী, ১৭৬১ থেকে ১৭৮২ পর্যন্ত মহীশুর রাজ্যের শাসক ছিলেন। তিনি আপন প্রাথমিক জীবন সৈনিক হিসাবে শুরু করেন, পরে নিজাম হিসাবে কাজ করেন, দক্ষিণ ভারতে মুঘল ডেপুটি সেনাবাহিনীতে তুলনামূলকভাবে নিম্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু, যখন মহীশূরের মন্ত্রীর রাজা নাঞ্জরাজা হায়দার আলীর সেবাকে স্বীকৃতি দেন তখন তিনি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৭৭২- পেশওয়া মাধব রাও-এর মৃত্যুর পর তিনি আপন রাজত্ব কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। 

তিনি সর্বদা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কাজ করেছেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করেছেন। ১৭৬৭ থেকে ১৭৬৯ পর্যন্ত চলা এই প্রথম অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধ তার প্রমাণ। ১৭৬৭ সালে মারাঠা এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম সহ ব্রিটিশরা মহীশূরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। হায়দার আলী আপন দক্ষ কূটনীতির মাধ্যমে মারাঠা নিজামদের তার পাশে আনতে সক্ষম হন। মাদ্রাজের সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা আতঙ্কের পর, ইংরেজরা এপ্রিল, ১৭৬৯- হায়দার আলীর সঙ্গে একটি অত্যন্ত অপমানজনক চুক্তি করতে বাধ্য হয়- মাদ্রাজের চুক্তি, যা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়।

তিনার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার সহযোগীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আলস্যহীন লড়াই এবং দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশদের সম্প্রসারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাতিল করার জন্য তিনি 'দক্ষিণ ভারতের নেপোলিয়ন' নামে পরিচিত। এই বীর যোদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামী ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর ইহলোক থেকে পরলোক গমন করেন। 

) সৈয়দ মীর নিসার আলী

তিতু মীর নামে পরিচিত সৈয়দ মীর নিসার আলী, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের  জেলা-২৪ পরগনার বসিরহাটে ১৭৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাক-স্বাধীন ভারতে তিনি একজন অদম্য এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। সৈয়দ মীর হাসান আলী এবং আবিদা রুকাইয়া খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণকারী এই নেতা কিছু শোষক জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকরদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বিখ্যাত ওহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

তিতু মীর ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে "বারাসাত বিদ্রোহ" নামে পরিচিত একটি সক্রিয় অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেন। বিদ্রোহের উন্মাদনা ২৪ পরগণা, নদীয়া এবং ফরিদপুর (বর্তমানে বাংলাদেশের) জেলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তিনিই "কৃষক-রাজ" (কৃষকদের শাসন) ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন, বিদেশী অস্ত্র গোলাবারুদ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় তিতুমীর দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে ব্রিটিশদের সাথে অনিবার্য সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হন। লাঠি, ধনুক, তীর এবং বর্শার মতো মৌলিক অস্ত্রে সজ্জিত ১৫,০০০ জনেরও বেশি কৃষক সৈন্য সমাবেশ করে তিনি নিজেকে একজন দেশীয় শাসক হিসাবে জাহির করেন।

ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ২৪ পরগণা জেলার বারাসতের কাছে নারকেলবেড়িয়ায় তিতু মীর একটি বিশাল বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। ১৮৩১ সালের ১৮ নভেম্বর, ব্রিটিশ মেজর স্কট, লেফটেন্যান্ট শেক্সপিয়ার এবং মেজর সাদারল্যান্ড, অশ্বারোহী এবং পদাতিক সৈন্যদের সাথে নিয়ে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় একটি ভয়ঙ্কর আক্রমণ শুরু করে। প্রায় তিন ঘন্টা স্থায়ী একটি সাহসী প্রতিরক্ষার সত্ত্বেও, দুর্গটি ব্রিটিশ কামানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এবং এই যুদ্ধে তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন।



) শেখ ভিখারি আনসারি 

শেখ ভিখারি আনসারি ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি শহরে এক তাঁতি আনসারি পরিবারে অক্টোবর ১৮১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে শরিক ছিলেন। তিনি একজন কারিগর ছিলেন, যিনি মোটা কাপড় তৈরি করে শৈশব থেকেই স্থানীয় হাট বাজারে বিক্রয় করে জীবিকা অর্জন করতেন।

টিকাইত উমরাও সিং-এর সঙ্গে মিলে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীকে রাঁচি দখল করতে বাধা দেন। দুই সাহসী যোদ্ধা কোম্পানির বাহিনী যেন অগ্রযাত্রা না করতে পারে তাই রাঁচিতে অবস্থিত চুতুপলু নামক গ্রামের ঘাটিতে সকল গাছ কেটে ফেলেন। জানুয়ারী ১৮৫৮ সালে চুতুপলি ঘাটের বৃক্ষ কেটে ফেলার কারনে ব্রিটিশরা তাদের দুইজন কেই ফাঁসি দেই এবং তারা শাহাদাত বরন করেন।  

এছাড়া টিপু সুলতান, হাজী শরীয়তুল্লাহ, গোলাম রসুল খান, মাওলানা পীর আলী খান রহঃ, মৌলভী আহমদুল্লাহ শাহ ফয়জাবাদী, আজিমুল্লাহ খান, মোহাম্মদ বখত খান, খান বাহাদুর খান, বাহাদুর শাহ জাফর, মোহাম্মদ শের আলী, বেগম হযরত মহল, মৌলভী সৈয়দ আলাউদ্দিন, প্রমুখ মুসলিম বীর যোদ্ধা স্বাধীনতার সংগ্রামে সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু ডানপন্থী সংস্থাগুলি এদের নাম ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টায়। আমাদের প্রতি অনিবার্য যে আমরা তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় নিজ লেখা লেখির মাধ্যমে তুলে ধরি এবং তাদের অবদান সকলকে পরিচিত করাই। 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter