ফ্রান্সের দাঙ্গা: নাহেলের হত্যা এবং কিছু কথা
গত পাঁচ দিন ধরে ইউরোপের অন্যতম উন্নত ও সভ্য দেশ ফ্রান্সে জ্বলছে বিক্ষোভ-পরিণত-দাঙ্গার আগুন। ৪০ হাজারের অধিক ম্যাক্রোঁ সরকারের পুলিশ নিয়ন্ত্রণ অভিযানে যুক্ত হয়েও ব্যর্থ। প্যারিস এবং অন্যান্য মহানগরে অভিযান প্রক্রিয়া আরও কড়া। এই পরিস্থিতির জন্ম হয় মঙ্গলবার যখন প্যারিস শহরতলির নান্তেরে ১৭ বছর বয়সী আলজেরিয়া বংশোদ্ভূত আফ্রিকান নাহেল এম নামে এক কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে ফরাসি পুলিশ।
নাহেল এম-এর হত্যা
অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণ নাহেল এক ডেলিভারি ড্রাইভার। পিতাহারা নাহেল তার একাকী মায়ের সঙ্গে আলজেরিয়া থেকে অভিপ্রায়ণ করে ফ্রান্সে স্থায়ী হয়েছে। ক্রমানুসারে নেহালের পরিবার সদস্য ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে। সে রাগবি লীগেও অংশগ্রহণ করেছে। ইলেকট্রিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করত, যদিও স্কুলে যেতে সে অনিয়মিত ছাত্রদের মধ্যে এক। তবুও কিন্তু তার নৈতিক শিক্ষা উন্নত মানের যেহুতু সবার সঙ্গে ভালোবাসা ও হাসি খুশি মেজাজে থাকতো। আর্থিক দিক দিয়েও এই পরিবার খুব একটা সম্বল নয় - বৃদ্ধ্যা বয়স্ক মায়ের সঙ্গে একা। রাজধানী প্যারিস সংলগ্ন নান্তেরে অঞ্চলটি মূলত দরিদ্রদেরই বাস। "আমি তোমাকে ভালোবাসি, মা" বলে সে কাজে যাওয়ার আগে তার মাকে একটি বড় চুমু দেয় (বিবিসি)।
আল জাজিরা সংবাদ মাধ্যমের এক প্রতিবেদন অনুসারে: ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি দ্বারা প্রমাণিত সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে দুই পুলিশ অফিসারকে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। একজন জানালা দিয়ে ড্রাইভারের দিকে তার অস্ত্র নিক্ষেপ করে দৃশ্যত গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় কাছে থেকে গুলি চালায়। দুর্ঘটনার আগে গাড়িটি কয়েক মিটার এগিয়ে যায়। জরুরি পরিষেবাগুলি ঘটনাস্থলে কিশোরটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিফলে।
বিবিসি প্রচারিত এক ভিডিওতে নাহেলের বৃদ্ধা মাকে অশ্রু ভাষায় বলতে শুনা যায়: "আমি এখন কি করবো… তার জন্য আমি সবকিছুই উৎসর্গ করেছি। সে আমার একমাত্র ছেলে, আমার দশজন বাচ্চা নেই।"
বিক্ষোভ-পরিণত-দাঙ্গার মাত্রা
পরের দিন পরিস্থিতি অনুকুলতার উদ্দেশ্যে দেশের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ পুলিশি গুলিতে বালকের হত্যার ঘটনাকে নিন্দা করেন। অবশ্যই পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ উঠিয়েছে যে গাড়ি না থামার অপরাধী গুলি করার অধিকার দিল কে।
কিন্তু সমস্যা এখন বিক্ষোভের আকার এতই ভয়ংকর মাত্রা গ্রহণ করেছে যে ফরাসি পরিস্থিতি এখন দাঙ্গার মুখোমুখি। রাজধানী কেন্দ্র করে সারা দেশে বিক্ষোভ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি এড়িয়ে সরকারি সম্পদ লুটপাট, ভাঙচুর, এবং অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। জনসাধারণের পরিবহন এবং জাগতিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটেছে।
ন্যায় বিচারের অবশ্যই হওয়া চাই, কিন্তু তার প্রাপ্তির পদ্ধতি সহিংসতা ত্যাগ করে শান্তির হওয়া দরকার। অন্য পদক্ষেপ পরবর্তী সময়ে প্রযোজ্য। এতেই দেশ ও জাতির কল্যাণ আছে।
নাহেলের মা অবশ্যই সকল সমর্থকদের সাধুবাদ জানিয়েছে। বালক হত্যার বিচার অবশ্যই শীঘ্রই যাতে তার মত অন্য সংখ্যালঘু বাচ্চাদেরও একটি সুরক্ষার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। অন্যদিকে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্ত উপলব্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু পারস্পরিক চিন্তাভাবনার স্বিকারুক্তি ছাড়া অন্য কোন বিকল্প দেখা যায় না।
কিছু সমাধান বাক্য
উক্ত ঘটনা মানব অধিকার অলংঘন করে হত্যার বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের প্রতীক যা একইভাবে ২০২০ সালে আমেরিকার মিনিয়াপলিসে একজন পুলিশ অফিসার দ্বারা কালো জাতির জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার কথা স্বরণ করিয়ে দেয় যেখানে ব্লাক লাইভস ম্যাটার নামের বিশ্বব্যাপী আলোড়ন হয়েছিল।
ইতিহাসের বৃহৎ ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ফ্রান্স পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনতার বিস্তৃত ধারনা দেখিয়ে লোকেদের গ্রহণ করে। তাছাড়া দেশেরজীবন শৈলী এবং অর্থনৈতিক সুযোগ ভাল উন্নত বলে সকলেই ধেয়ে পরে। ফ্রান্সকে নতুনভাবে গড়তে আন্তর্জাতিক নাগরিক বিশেষ অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি জাতীয় ফুটবল টিম আফ্রিকার প্রতিভাশালী খেলোয়াড়ে ভর্তি।
পশ্চিমা দেশ যতই বৈশ্বিক ঐকতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সংখ্যালঘু সুরক্ষার মত সার্বিক চিন্তাধারার ডাক দেক না কেন, সংখ্যালঘু একীকরণের দ্বারা সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার ভয় তাদের সর্বদা তাড়িত করে। ফলস্বরূপ, জাতি, বর্ণ, ভাষার ভিত্তিতে শক্তির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহার সর্বদা সঞ্চালিত হতে দেখা গেছে ইউরোপ-আমেরিকার দেশে। প্রতিক্রিয়ায় ফ্রান্সের মতো পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ হয়। সমাধান সূত্র হচ্ছে - শুধুমাত্র ঘোষণায় নয়, কর্মক্ষেত্রেও সর্বজনীনতা অনুশীলন করতে হবে। অগ্র জাতীয়তাবাদী ত্যাগ করে, অবশ্যই সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মেনে নিতে হবে।