আসন্ন নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
কেউ যেন সত্যি বলেছেন 'যে নির্বাচন কি জিনিস সেটা ভারতীয়রাই পারেন' । আর হ্যাঁ সেটাই সত্যি ভারতে যখনই কোন নির্বাচন হয় তখন ছাড়া দুনিয়াব্যাপী তার খবর জানতে পারে। আর সেই ভারতেরই এক রাজ্য যেখানে যেকোনও নির্বাচন হোক না কেন প্রত্যেক দিনের খবর জানতে পারে সারা ভারত। হ্যাঁ সে রাজ্যটি হল পশ্চিমবঙ্গ । সেখানে লোকসভা থেকে পঞ্চায়েত ভোট সবই থাকে উত্তপ্ত রাজ্য। প্রত্যেক সপ্তাহে কোন না কোন হত্যা ও খুনের খবর আসতেই থাকে। সামনের জুলাই মাসেই বঙ্গে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন আর সেই উপলক্ষে রাজ্য জ্বলছে নির্বাচনের আগুনে।
গত পঞ্চায়েত ভোট থেকে শাসকদলের পর অভিযোগ আছে যে তারা গুন্ডামি করে ভোট নিয়েছিল। সেই পরিপেক্ষিতে এইবার বেশ তোর জোরে নেমেছে গেরুয়া শিবিরও। পশ্চিমবঙ্গে এমন রাজ্য যেখানে আঞ্চলিক পার্টি ছাড়া জাতীয় পার্টির খুব জোর। ইতিহাস দেখতে গেলে স্বাধীনতার পর ভারতীয় কংগ্রেস পার্টি ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি প্রায় ৩৪ বছর রাজত্ব করে এবং ২০১১ তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে রাজত্ব শুরু হয় তৃণমূলের। একমাত্র গেরুয়া শিবিরই এই রাজ্যে রাজত্ব না করলেও গত লোকসভা নির্বাচনে তাদের ফল প্রায় ভালই ছিল।
গত বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দল থেকে বহু জনই পার্টির বদল করেন কিন্তু ফল ভালো হয়নি। তাই এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে গত বছরের দুর্নীতি ও গন্ডামির গল্প উঠিয়ে গেরুয়া শিবির ও বাকি দলগুলোও প্রচারে নেমেছে। বিজেপি ছাড়া প্রায় দলগুলি সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে করছে টানাটানি।
নির্বাচন কমিশন যখন ভোটের তারিখ ঘোষণা করলেন সেই থেকে রাজ্য শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। শাসক দল তৃণমূল ছাড়া বিজেপি, কংগ্রেস- সিপিআই জোট, আইএসএফ,মীম ও নির্দল সমুহ সকল দলই নেমে পড়েছে যুদ্ধের ময়দানে ।
তৃণমূল:
২০১১ সালে শাসনে আছে তৃণমূল সরকার। দলনেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হাতে জয়ের পর থেকে এখনো শাসন করছে সেই তৃণমূল। মমতা দিদি চেয়েছিলেন যে তার বিপক্ষে কোন দল যেন বিরোধিতা হিসেবে না থাকে। সেই সূত্র অনুসারে তিনি পূর্বে সরকার সিপিআইএমকে বাংলা থেকে মুছে দেওয়ার আন্দোলন চালাই। সেই সূচনায় মমতা দিদি প্রায় সাফল্য অর্জন করেন। আজ বাংলায় দেখতে গেলে সিপিএমের গড় থেকে সব মুছে গেছে যারা সিপিএমের সবাই দুর্নীতি ও ভন্ডামির কাজে লিপ্ত ছিল তারাই আবার সামিল হল তৃণমূল ও আর তৃণমূলও পরিণত হলো দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে।
তাদের মন্ত্রী নেতারা সারদা কান্ড ও নারদা কান্ড সবে তারা নিযুক্ত ছিল আর সেই থেকে একের পর এক জেলে ঢুকতে থাকে আজও রেহাই পায়নি।
গত বছর থেকে চাকরি দুর্নীতিতে আবারো ভাসতে থাকে তৃণমূলের নেতা ও মন্ত্রীরা আবারও এডি ও সি বি আই দ্বারা তদন্তে গ্রেফতার হয়ে অনেক জনই এখন জেলে।এছাড়া গরু পাচার ও কয়লা কাণ্ডে নিযুক্ত এদেরই নেতা ও মন্ত্রীরা।কেউ কেউ আবার এইসব কান্ড থেকে নিজেকে বাঁচাতে বদল করে দল। অভিযোগ আছে যে গত বিধানসভায় গেরুয়া শিবির যখন নিজের পতাকা গাড়তে না পারায় সিবিআই ও এডিকে হাত করে বাংলায় তদন্তে পাঠায়।
হ্যাঁ এটা সত্যি যে শুধুই একদল নয়, সব দলের মধ্যেই কোন না কোন মন্ত্রী বা নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে আছে। কারণ রাজনীতি মানেই এক খেলা যেখানে বিভিন্ন রূপের চালাকি ও কৌশলতা খুবই প্রয়োজন। আর সেই চালাকির মধ্যে দ্বারা অধিকাংশ রাজনীতিকরা জড়িয়ে পড়ে বেআইনি কাজে। কিন্তু সঠিক সময় উন্মুক্ত হয়।
এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে যেমনটা তাদের মাইনাস পয়েন্ট হল যে তাদের মধ্যে অধিকাংশ কৌশলী নেতারা এখন জেলে। আরেক সমস্যা হল যে মনোনয়ন জমা নিয়ে। যখন পঞ্চায়েতের টিকিট একজনকে না দিয়ে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে তখন অপরজন গররাজি হয়ে জমা করেছে নির্দল প্রার্থী হিসেবে।
বিজেপি:
এখন ব্যবধানে দেখতে গেলে জড়ুয়া শিবিরই এ রাজ্যে বিরোধী দল যে তৃণমূলের এক বড় কাঁটা। আর তাদের মূল এজেন্ডা হল তৃণমূলের দুর্নীতি ও বেআইনি কাজে কান্ড করে তুলে ধরে ভোট চাওয়া। তাদের প্লাস পয়েন্ট দেখতে গেলে বড় বড় নেতাও আছে যেমন শুভেন্দু অধিকারী,সুকান্ত মজুমদার ও দিলীপ ঘোষরা।
কংগ্রেস- সিপিএম জোট:
যখন তৃণমূলের শুরু হয় চর্চা আর শেষ হয়ে যায় সিপিএম ও কংগ্রেসের শাসনের আসার আশা তখন দুই চির শত্রু হয়ে যায় বন্ধু সেই থেকে ভাগ করে নেয় আসন ও বুথ।এই বার তোর জোরে দুই পক্ষই নেমেছে ময়দানে আশা করছে করছে ভালো ফলের।
সিপিএমের নেতারা সেলিম, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বাকি প্রমুখরা বিশেষ প্লাস পয়েন্ট ।
কংগ্রেসের বিশেষ করে সংসদ অধীর চৌধুরী ও প্রমুখরা খুব জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে আর প্রস্তুতি নিচ্ছে সামনের পঞ্চায়েত যুদ্ধের জন্য।
আইএসএফ ও মীম:
আইএসএফের সুপ্রিম নেতা ও সংসদ নওশাদ সিদ্দিকী প্রায় জোর কদমে নেমেছে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে। সংখ্যালঘুদের নেতা হিসেবে নিজেকে দাবি করছেন।মনোনয়নপত্র জমা ক্ষেত্রে ভাঙ্গড়ে নাকি তুমূল তাণ্ডব চালায় নওশাদ সিদ্দিকী। এর উপর অভিযোগ আর কর্মীদের আহত হওয়ায় সিদ্দিকী বাকি অন্য ভুতে প্রার্থী না দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
শুধুমাত্র আইএসএফ না আরেক মুসলিম দল আসাউদ্দিন ওয়াইসির মিমও প্রার্থী দিচ্ছে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে। ২৪ পরগনার বারাসাতে মিমের প্রার্থী হিসেবে প্রচারে দেখতে পাওয়া যায় কিছু প্রার্থী ও কর্মীদের। তাদের আবেদন জনগণের কাছে যে অন্যদেরকে তো অনেকবারই সুযোগ দিলেন এবার একবার আমাদেরকেও দিয়ে দেখুন।
রাজ্য যখন জ্বলছে রাজনীতি ও নির্বাচনের আগুনে এক এক দিনের মৃত্যু হচ্ছে কর্মী নামে জনগণের। বঙ্গে বর্তমানের অবস্থা প্রায় বাংলার প্রবাদ 'রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।' কোনও দিন তৃণমূল কর্মীদের খুন কোনদিন বিজেপি বা কংগ্রেসের কর্মীর খুন। প্রত্যেকদিনই এক দুঃসংবাদ ও আবেগ ভরা ঘটনা ঘটতে আছে বাংলার বুকে। যে বাংলা এক সময় ছিল ভারতের পথ পরিদর্শক অর্থাৎ সমস্ত শিল্প ও সাহিত্যের সেন্টার আজ সেই বাংলা জ্বলছে শুধু রাজনীতি আর হিংসার আগুনে। অবশেষে ভাবতে হবে যে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে বাংলায় এত কেন তাণ্ডব? পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে নির্বাচিত যে মেম্বার গুলো হয় তারা অনেক ধরনের সরকারি প্রকল্পের বরাদ্দ অধিকাংশ তাদেরই পকেটে যাই। প্রধান ও মেম্বার সকলে মিলে শুধু নিজের বাড়িতে পাকা করার জন্য নামে রাজনীতিতে। বাংলায় এখন নির্বাচনে ভোট দেওয়া মানে সেটা নিজ ইচ্ছাই না বরং ভোট কিনে নেওয়া হয়। প্রতিম মাথাপিছু হাজার দু হাজার করে টাকা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভোট কিনে।আর এটা বাংলায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ভারতের অন্য রাজ্যগুলির থেকে বাংলায় কেন এত তাণ্ডব হচ্ছে যতদিন না এই সিস্টেম ভোট কিনে নেওয়া বন্ধ না হবে ও প্রশাসন বিশেষ পদক্ষেপ না নেবে যে আবাস যোজনা ও বিশেষ ধরনের প্রকল্পের বরাদ্দ প্রধান ও মেম্বারের পকেটে যেন না যায়। সেই দিন বাংলায় আবার ফিরে আসবে শান্তির পঞ্চায়েত নির্বাচন।