কেরালার মুসলমানদের মধ্যে পানাক্কাড পরিবারের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার
কেরালার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন কিছু বিশিষ্ট পরিবার রয়েছে, যারা কেবল ধর্মীয় নেতা হিসেবেই পরিচিত হননি, বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরে—রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন গভীর প্রভাব। এইসব পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল, সম্মানিত এবং প্রজ্ঞাশীল নাম হল পানাক্কাড সাদাত পরিবার। কেরালার মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা গঠনে তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁরা কেবলমাত্র মুসলমানদের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব দেননি, বরং হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে এক মহৎ ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, পানাক্কাড সৈয়দ সাদিক আলি শিহাব তাঙ্গাল ২০২৩ সালে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বড়দিন অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি কেবল উপস্থিত ছিলেন না, বরং খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের সঙ্গে সৌহার্দ্যের প্রতীকস্বরূপ কেক কাটায় অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁকে পাদ্রিরা শুভেচ্ছা উপহার প্রদান করেন, যা আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়। এই ঘটনাটি কেবল সামাজিক সৌহার্দ্যের প্রকাশ নয়, বরং কেরালার ধর্মনিরপেক্ষ মনের প্রতিফলনও বটে।
পানাক্কাড পরিবারের ইতিহাস ও ধর্মীয় নেতৃত্ব
কেরালার জনগণ যাঁদের শ্রদ্ধাভরে “তাঙ্গাল পরিবার” নামে অভিহিত করে, সেই পানাক্কাড সাদাতরা মূলত হাদরামাউত (বর্তমান ইয়েমেন) থেকে আগত একটি সায়্যেদ পরিবার। নবী করীম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর এই পরিবার দক্ষিণ ভারতে বিশেষত কেরালায় পা রাখে ১৮ শতকে, যখন সৈয়দ আলি শিহাবুদ্দীন হাদরামাউত থেকে এখানে আগমন করেন। তিনি কেবল একজন ধর্মীয় চিন্তাবিদ নন, বরং সমাজ সংস্কার, তাসাউফ এবং দাওয়াহর মাধ্যমে কেরালার মুসলমানদের মধ্যে এক নবজাগরণের সূচনা করেন।
তাঁর উত্তরসূরিরা এই আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে আরও বেগবান করেন। তাঁরা কেবল ধর্মীয় পাঠদান নয়, বরং সামাজিক নেতৃত্ব, ফিকহি আলোচনা, সংলাপ এবং জনগণের নৈতিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, যখন সারা ভারতে উত্তেজনা ও অস্থিরতা বিরাজ করছিল, তখন সৈয়দ মুহাম্মদ আলি শিহাব তাঙ্গাল শান্তি, সহনশীলতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের আহ্বান জানান। তাঁর দূরদর্শিতা কেরালার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাঁদের ঐতিহাসিক বাসভবন “কুদাপ্পনকাল হাউস” শুধুমাত্র একটি পরিবারিক নিবাস নয়, বরং কেরালার মুসলিম সমাজের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, আলাপ ও নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু। আজও এই ঘরটি কেবল ইতিহাস নয়, বরং বাস্তব কর্মযজ্ঞের একটি উজ্জ্বল চিহ্ন। বর্তমান নেতৃত্বে রয়েছেন সৈয়দ সাদিক আলি শিহাব তাঙ্গাল, যিনি আধুনিক চিন্তাধারাসম্পন্ন, ধার্মিক, প্রজ্ঞাবান এবং সর্বজনগ্রাহ্য এক উদার নেতৃত্বের ধারক।
শিক্ষা, রাজনীতি ও সমাজে বহুমাত্রিক অবদান
সৈয়দ মুহাম্মদ আলি শিহাব তাঙ্গাল ছিলেন পানাক্কাড পরিবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক, যিনি কেরালার মুসলমানদের রাজনৈতিক এবং শিক্ষাগত জগতে এক নবযুগের সূচনা করেন। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে তিনি কেবল একটি দল পরিচালনা করেননি, বরং একটি আদর্শিক ও নৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যার মূলে ছিল ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতা। তাঁর ভাষণে ছিল না কোনো কদর্যতা বা বিদ্বেষ, বরং গভীর চিন্তা, পরিশীলিত বোধ ও অন্তর্দৃষ্টি।
তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে বহু ইসলামি মাদ্রাসা, হাইস্কুল, দাওয়াহ কেন্দ্র এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে ধর্মীয় জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের পাঠদান চালু হয়। এর ফলে এক প্রজন্ম-পরম্পরাগত জ্ঞানচর্চার ধারা সৃষ্টি হয়, যা কেরালার মুসলমানদের মাঝে একটি শিক্ষাবিপ্লবের ভিত্তি রচনা করে।
এই ধারারই অংশ হিসেবে তিনি ছাত্র ও যুবসমাজকে সংগঠিত করতে বিভিন্ন শিক্ষা সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো “সামস্হা সুন্নি স্টুডেন্টস ফেডারেশন” এবং পরে “ইসলামি কলেজ সমন্বয় পরিষদ”, যার আওতায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানে ইসলামি ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো হয়, যাতে ছাত্ররা একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনচর্চায় অভ্যস্ত হয়।
২০২২ সালে একটি বন্ধুত্ব যাত্রার ভাষণে তিনি বলেন—“স্কুলশিক্ষায় পারস্পরিক সহাবস্থানের মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে ছোট থেকেই শিশুরা সম্প্রীতির পাঠ শিখে।” এই বক্তব্য তাঁর অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ বহন করে এবং সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতা প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা তুলে ধরে।
আধুনিক মিডিয়ায় উপস্থিতি ও সামাজিক শক্তি
পানাক্কাড পরিবার রাজনীতির ময়দানে সবসময়ই স্পষ্ট বক্তব্য ও নৈতিক অবস্থানের জন্য পরিচিত। তাঁদের অনেক সময় নীরব থাকা অবস্থাও ছিল গভীর চিন্তার প্রতিফলন, যা নীতিনিষ্ঠ অবস্থান থেকে পরিচালিত হয়েছে। সৈয়দ আব্বাস আলি শিহাব তাঙ্গাল যখন নীলাম্বুরে এক সামাজিক ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন, তখন জনগণ বুঝে নেয় এই পরিবার শুধু বক্তব্য প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কার্যকর সামাজিক হস্তক্ষেপের সাহসও রাখে।
তাঁরা আধুনিক প্রযুক্তি ও মিডিয়া ব্যবস্থার সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। মালাপ্পুরামে একটি প্রভাবশালী সংবাদপত্র ইউনিট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁদের উপস্থিতি, কিংবা কোটাক্কাল আয়ুর্বেদিক হাসপাতালকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত করার দাবিতে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, তাঁরা কেবল ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, জাতীয় উন্নয়নেও নিবেদিতপ্রাণ।
সাম্প্রতিক সময়ে এক বড়দিন অনুষ্ঠানে খ্রিস্টান ধর্মগুরুর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কেক কাটা, যদিও কিছু মহলে সমালোচনার সৃষ্টি করে, তথাপি সৈয়দ সাদিক তাঙ্গাল জোর দিয়ে বলেন—এমন আন্তধর্মীয় সৌহার্দ্য সমাজের ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে পানাক্কাড পরিবারের গুরুত্ব
বর্তমান যুগে যখন রাজনীতিতে আদর্শবিচ্যুতি, সমাজে বৈরিতা এবং নেতৃত্বে জড়তা দেখা দিচ্ছে, তখন পানাক্কাড পরিবারের দূরদর্শী ও ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্ব কেরালার মুসলিমদের জন্য এক আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তাঁরা কখনো অন্ধ কট্টরতা কিংবা সুযোগসন্ধানী রাজনীতির শিকার হননি। বরং মানুষের পাশে থেকে, তাদের কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে, ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে একটি মিতভাষী সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন।
২০২৪ সালে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন তাঁদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করলে, তাৎক্ষণিকভাবে কংগ্রেস, আই ইউ এম এল সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিবাদ জানান। কারণ পানাক্কাড পরিবারের ভূমিকা ছিল সর্বদা সামাজিক ঐক্য ও ধর্মীয় সহাবস্থানের পক্ষপাতী। উগ্রতা কিংবা বিভাজনমূলক রাজনীতি তাঁদের চিন্তার পরিসরের মধ্যে ছিল না।
বহুমাত্রিক নেতৃত্ব ও আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি
এই পরিবারের সবচেয়ে বড় অবদানগুলোর একটি হল আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলা। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, সমাজের প্রকৃত অগ্রগতি কেবল ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়; বরং মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে একটি পরিপূর্ণ সমাজ।
তাই তাঁরা সব সময় আন্তধর্ম সংলাপ, সম্মেলন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। শিবগিরি মঠে এক ধর্মীয় সংলাপে তাঁরা অংশগ্রহণ করেন, যেখানে তিনি খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের সঙ্গে আলোচনায় কেরালার সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দেন। এমনকি এক আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংলাপে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে কেরালার ঐতিহ্য তুলে ধরেন।
আজও এই পরিবারের দরবারে মানুষ আসেন কেবল ফাতওয়া বা দাওয়াত নিতে নয়, বরং সামাজিক দিকনির্দেশনা, রাজনৈতিক পরামর্শ এবং শিক্ষাগত আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করতে। তাঁদের নেতৃত্ব কেবল বক্তব্যে নয়, কর্মে প্রতিফলিত হয়।
উপসংহার: উত্তরাধিকার থেকে অনুপ্রেরণার পথে
সারসংক্ষেপে বলা যায়, পানাক্কাড সাদাত পরিবার কেরালার মুসলিম সমাজে এক অনন্য উত্তরাধিকার এবং আদর্শিক নেতৃত্বের প্রতীক। তাঁদের জীবন, চিন্তা ও কর্ম আমাদের দেখিয়ে দেয় কীভাবে প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও ঐক্যের মাধ্যমে একটি সমাজকে আলোকিত ও ঐক্যবদ্ধ রাখা যায়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাঁরা কেবল অতীতের উত্তরাধিকার বহন করছেন না; বরং নতুন প্রজন্মের জন্য পথনির্দেশক হিসেবেও কাজ করছেন। এই উদ্দেশ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে “পানাক্কাড কাজি ফাউন্ডেশন” গঠিত হয়েছে, যা শিক্ষা, সমাজসেবা এবং সংস্কৃতিকে আধুনিক পরিসরে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে।
আজকের প্রজন্মের উচিত এই আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশ করা, যাতে আগামী কালের কেরালা হয় আরও মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ এবং ঐক্যবদ্ধ। এই উত্তরাধিকার কেবল সংরক্ষণ নয়—তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করাই হবে প্রকৃত শ্রদ্ধা।