ইউসিসি শুধুমাত্র মুসলমানের নয়, বরং দেশের বহুত্ববাদের প্রশ্ন

ভারত এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। ১২০ কোটির অধিক জনসংখ্যার এই দেশে ইতিহাস থেকে বহু সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছে - বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, জাতি এবং সংস্কৃতি শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেছে। বিশ্ব পরিধিতে ভারত বৃহত্তম গগতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা সকল বৈশিক কাঠামো থেকে উন্নত যেখানে সকল ধর্মকে নিজেস্ব স্বাধীনতা এবং সমান অধিকার প্রদান করা হয়। তাছাড়া, এই দেশে হিন্দু , মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ এবং অন্যান্যদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় যে সংহতি দেখা যায় তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দুর্লভ দৃশ্য।

   সকল প্রজাতি ভারতকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে। অতীতের যে কোন পরিযান ভূলে, রাষ্ট্র উন্নতির অভিযানে সবাই অংশীদার। একমাত্র ঐপনিবেশিক এবং পঁজিবাদী পশ্চিমা লোভী নেকড়েদের ছাড়া সবাই দেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রেখে গেছে।  তারা লুন্ঠন অনুষ্ঠান আরম্ভ করলে একত্রে ভারতবাসী প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝেঁপে পরে। ক্ষুধার্ত নেকড়েদের চক্রান্ত আরম্ভ হয় - দেশের শক্তি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যতায় ফাটল বাঁধতে।

   ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে গর্বের তিরঙ্গা স্বাধীন বাতাসের তরঙ্গে ভেসে উঠার আগে থেকেই  দেশের দূরদর্শী পথপ্রদর্শকরা ভবিষ্যৎ ভারত নিয়ে কৌশল পরিকল্পনা আরম্ভ করেন। তাঁদের মনোযোগ এক বিরাট প্রশ্নে কেন্দ্রীভূত হয় - ভারতের অভিনব পরিচয় বহুত্ববাদী পরিবেশ কিভাবে রক্ষ্যা করা যায়? সংবিধানে কেন্দ্রীয় স্থান পায় আদর্শপূর্ণ বিচারসমূহ। সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হয় ভারতবর্ষ। ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, মানবিক মর্যাদা এবং জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতা হয় দেশের মূল মান। ধর্মনিরেপক্ষতা এবং সর্ব ধর্মের সমান অধিকার দিয়ে ভারতের দর্শন সংঘবদ্ধতার উপরে গড়ে উঠে। সংবিধানের ২৫ এবং ২৯ অনুচ্ছেদ, যা প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মের স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করে, সকল ধর্মের নিজেস্ব কাঠামোর প্রতিরক্ষ্যা তালা হিসেবে রাখা হয়।     

তাহলে ইউনিফর্ম সিভিল কোড-এর প্রশ্ন কোথায়

সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদঃ ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপালস অফ স্টেট পলিসি। এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে  রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতিকরণে প্রণীত এই পরিধিতে বলা হয় যে সমগ্র ভারতের ভূখণ্ড জুড়ে সমস্ত নাগরিকের জন্য একটি দেওয়ানি সংহিতা হওয়া চায়। এর উদ্দেশ্য একটি একক, একীভূত ব্যক্তিগত আইনের কাঠামো প্রদান করা যা ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য প্রয়োগযোগ্য। তদুপরি, এই আইন বাধ্যতামূলক নয় বরং স্বেচ্ছাকৃত এবং প্রণয়নের জন্য অনুকূল সময় অনুসারী যা ভারতের বহুত্ববাদী সমাজের জন্য উপকারী নয়। 

   বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান প্রচারণা ইউসিসি নিয়ে আসা। ভোটের উদ্দেশ্য সমান আইনের ডাক ভারতীয় বহুসংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নষ্ট করতে পারে। ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার সৌন্দর্য বিনষ্ট হবে। ঐকতার নামে অন্যদিকে সামাজিক দূরীকরণের বিদ্বেষ জমাট বাঁধতে পারে। আরএসএস সমর্থিত বিজেপির তাত্বিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা যায় হোক না কেন, দেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐকতার শক্তি হ্রাস পাবে। কোন এক জাতি বিশেষ করে মুসলমানদেরই নয়, বরং অন্যান্য ধর্ম এবং সংস্কৃতিরও উপর এর প্রভাব পরবে যা কখনও স্বীকার্য নয়।               

কাদের বিষয় - মুসলমানের?

ইউসিসি-এর বিতর্ক আরম্ভ হতেই প্রতিরোধ ক্ষেত্রে সবে থেকে বেশি মুসলিম সমাজের অগ্রাধিকার। যেহেতু ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবন সম্পর্কিত  আইনগুলি যথা বিবাহ, উত্তরাধিকার, বিবাহবিচ্ছেদ, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে। তাছাড়া বর্তমান সরকারের ধর্মতাত্ত্বিক অভিসন্ধি এক প্রশ্নের বিষয়। তবে ইদানিং বেশি কিছু এইরূপ পরিস্থিতিতে মুসলমানরা প্রতিবাদের বৃত্তে জড়িয়ে থাকায় ইটা মনে রাখতে হবে যে সাংবিধানিক অধিকার প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার পিছনে শিক্ষা, স্বাস্থ, সামাজিক কল্যাণের মতো অন্যান্য মানব উন্নয়নের ব্যাপ্তি বিষয়গুলি হারিয়ে না যায়। বরং, একইসাথে তাদের আরও সজাগ এবং দূরদর্শী হওয়া উচিত।

  আউটলুক ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদন অনুসারে বিজেপির এমপি এবং সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান সুশীল কুমার মোদি পরামর্শ দেয় যে উত্তর-পূর্ব এবং আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রণকারী আইনগুলি আলাদা এবং এইভাবে তাদের ইউসিসি অনুসরণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত। এখন থেকে পূর্বের প্রশ্ন আবার উঠে - ইউসিসি-এর লক্ষ্য বিন্দু কোনো নির্দিষ্ট জাতি তো নয়?

   দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের খবর ২০১৮-এর ২১তম আইন কমিশন বিষয়টি পরীক্ষা করে শেষ মূল্যায়নে আসে যে দেশে এই পর্যায়ে ইউসিসি প্রয়োজনীয় বা কাম্য নয়। ব্যাক্তি, সংগঠন এবং অন্যান্য অংশীদারদের মতামত এবং পরামর্শ গ্রহণ করার জন্য আবার নুতুন কমিশন গঠন করা হয়েছে। 

   কিন্তু বিষয়টি শুধু মুসলমানদের নয়, বরং দেশের বহুত্ববাদীত্বের। একটি সহজ উদাহরণ - শুধুমাত্র উত্তরপূর্ব ভারতেরই সাংস্কৃতিক নিয়মনীতি এতো বৈচিত্র্যপূর্ণ যে তা এক দাঁড়িপাল্লায় পরিমাপ করা দুস্কর ব্যাপার। অতএব, ভারতের মত এক বৃহত গণতান্ত্রিক এবং অতি বৈচিত্রপূর্ণ দেশে ইউসিসি এক দুস্কর স্বপ্ন। ঐক্যতা দূরের কথা, এতে দেশের সৌন্দর্য্য নষ্ট হবে ও পারস্পরিক সম্প্রীতি হ্রাস পাবে।  আবার - ইউসিসি শুধুমাত্র মুসলমানের নয়, বরং দেশের বহুত্ববাদের প্রশ্ন। 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter