ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান সমস্যা ও সংকট  (দ্বিতীয় পর্ব )

মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমস্যা : ভারতীয় মুসলমানদের চতুর্থ সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। ইতিহাসের  দর্শন ও বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের কাহিনী অধ্যয়নে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, অর্থনৈতিক অবস্থা যেকোন জাতির চিন্তা-চেতনা, স্বাস্থ্য, ও বুদ্ধি বৃত্তিক ক্ষেত্রে বড় ধরণের প্রভাব বিস্তার করে। যে জাতি আর্থিক দুরাবস্থা, ক্ষুৎ দারিদ্র্য, অন্নাভাবের শিকার হয়, সে জাতি উন্নতির দিশা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, ভবিষ্যত হয় অন্ধকার এবং নব প্রজন্ম হতাশ ও সাহসহারা হয়ে গুরুদায়িত্ব পালনে অক্ষম থেকে যায়। যারা উন্নত ও দুঃসাহসী জাতির সারি থেকে দূরে সরে দাঁড়ায় জলদি  তারা পশ্চাদপদ, মর্যাদাহীন ও ভীরু জাতির কাতারে শামিল হয়। তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা ও ধীশক্তির তীক্ষ্ণতা নিঃশেষ হয়ে যায়।

 ইংরেজদের রাজত্বকালে ভারতীয় মুসলমানদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল সরকারী উচ্চ পদ ও বড় মাপের ব্যবসা। দেশ বিভাগের পর জমিদারী শেষ হয়ে যায় এবং এ পদক্ষেপ ভারতীয় সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনে সঠিক ছিল। সরকারী পদ ও চাকুরীতে মুসলমানদের অনুপাত দিন দিন হ্রাস পাওয়ায় তাঁদের আর্থিক ও সামাজিক জীবনের ভবিষ্যত তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্ন বিভাগে বিশেষত পুলিশ, সেনাবাহিনী ও দায়িত্বশীল পদে লোক নিয়োগের অনুপাতিক হারের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে অপরিচিত যেকোন ব্যক্তি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে, হয়তো এদেশ হতে মুসলমানগণ হিজরত করে চলে গেছেন অথবা যারা আছেন তারা এতই গন্ডমূর্খ যে, সরকারী চাকুরী করার যোগ্যতাই তাঁরা রাখেন না। কিছু দিনের মধ্যে পুরোনো  মুসলমান অফিসার বিভিন্ন দফতর হতে সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কৃত হয়ে যাবেন। ১৫ কোটি মানুষের বিশাল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কোন দায়িত্বশীল প্রতিনিধিত্ব আমলাতন্ত্রে ও সরকারের প্রশাসনযন্ত্রে আর দেখা যাবেনা।

 আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে কতিপয় কর্তৃপক্ষীয় তথ্য-উপাত্ত পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। প্রথম উদাহরণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুর ওই ভাষণের অংশ বিশেষ উল্লেখ করছি যা তিনি ১৯৫৮ সালের ১১ মে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি সম্মেলনে প্রদান

করেছিলেন:উপরিউক্ত বাস্তব তথ্যের আলোকে অনুমান করা যায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদে কতজন মুসলমান কর্মরত রয়েছেন, যদিও এখনো মুসলমানদের মধ্যে যোগ্যতা ও দক্ষতা পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। অতীতেও দক্ষতা ও কর্তব্য নিষ্ঠার জন্য মুসলমানদের ব্যাপক খ্যাতি ছিল এবং বর্তমানেও তাদের পড়া-লেখা ও যোগ্যতার মান ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের সংবিধান যদিও ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমান সুবিধের গ্যারান্টি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারে ভিন্ন ও উল্টো। বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে ভারতে চাকুরী না পেয়ে মুসলমানদের ছেলে মেয়েরা হতাশ। বহু শিক্ষিত যুবক দেশ ত্যাগ করে প্রতি বছর পাকিস্তানে পাড়ি জমাচ্ছেন। এতদসত্ত্বেও আশা করা যায় সংবিধানের বৈশিষ্ট্যাবলী বর্তমান অস্বাভাবিক অবস্থার অবসানে সক্ষম কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে সংবিধানের মৌল চেতনার পরিপন্থী। তবে এর জন্য পূর্বশত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণ তাদের আবেগকে সংযত করে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব যদি মেনে নেন তাহলে অতীতের তিক্ত স্মৃতি মুছে ফেলা সম্ভব।

মুসলিম পারিবারিক আইন :- ভারতে বসবাসরত মুসলমানগণ নিজেদের ধর্মীয় বলয়ে অবস্থান করে ব্যক্তিত্ব (Personalities) ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা এমন একটি প্রশ্ন সাম্প্রতিককালে দেখা দেয়। সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর একটি চরমপন্থী শ্রেণীর মনোভাব হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন সম্পদ্রায়ের মানুষের জন্য একই দেওয়ানী-আইন (Uniform Civil Code) হওয়া চাই। এটা ছাড়া জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হতে পারেনা। এ বিপদ আশঙ্কার মাত্রা ছাড়িয়ে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে হাযির হলো মুসলমানদের সামনে। সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির মাঝে প্রদত্ত বিতি ও অভিমত একই দেওয়ানী আইন প্রবর্তনের দাবীকে শক্তি যোগায়। আবদুল হামিদ দিলওয়ায়ী নাম জনৈক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি চিহ্নিত গ্রুপও ওই একই দাবী জানাতে থাকে এবং রীতিমত আন্দোলনের সৃষ্টি করে। এ দাবী মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক নৈরাজ্য ও ইসলামী শরীয়তের সাথে বিদ্রোহের শামিল। আল্লাহর নির্ধারিত বিধান যারা 

লঙ্ঘন শরীয়তের সাথে বিদ্রোহের সামিল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান যারা লঙ্ঘন করে তারা মুসলমান অভিধায় পরিচিত হতে পারেনা মহান আল্লাহ বলেন আল্লাহর নাযিলকৃত বিধি-বিধান অনুযায়ী যারা নিজেদের জীবন পরিচালনা করে না তারা কাফির. ৫. নিরাপদ রাখা রাষ্ট্র পরিচালকদের জন্য নেহায়েত কঠিণ হয়ে দাঁড়ায়।১ একথা মুসলমানদের ঈমান আকীদার অংশ যে, তাদের পারিবারিক আয়ন এই আল্লাহর তৈরী যিনি পবিত্র কুরআন অবতরণ করেছেন, আর আইন ইবাদতের বিধি বিধান দান করেছেন। গোটা কুরআন এসব বর্ণনায় ভর্তি। এ আকিদার প্রতি ঈমান আনতে মুসলমান নারী পুরুষ একান্তভাবে বাধ্য। এছাড়া কেউ মুসলমান থাকতে পারেনা। এ আইন সর্বজ্ঞ ও সর্বত্র বিরাজমান মহান আল্লাহর তৈরী যিনি মানুষের স্রষ্টা ও বিশ্বজগতের স্রষ্টা। তিনি মানুষের প্রয়োজন ও দূর্বলতা সম্পর্কে সম্যক অবগত।

দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী যে, অপ্রয়োজনীয় মানসিক অস্থিরতা, সন্দেহ ও ভীতিপ্রদ পরিবেশের সমাপ্তি ঘটুক। কোন দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যখন নিজেদের ভবিষ্যত, জীবনধারা, আকিদা, বিশ্বাস, শরীয়তের বিধি বিধান সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয়ে পতিত হয় তখন সে দেশে ও কখনো উন্নতি করতে পারেনা। যে দক্ষতা ও প্রাণশক্তি দেশের সংহতি, অগ্রগতি ও উন্নয়নে ব্যয় হতে পারতো সেটা সন্দেহ, সংশয় দূর করার কাজে যদি নিঃশেষিত হয় তাহলে এর চাইতে দূর্ভাগ্যের কথা আর কী হতে পারে? যদি মুসলমানদের এ আশঙ্কা হয় যে, আমাদের মত আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও ধর্ম ও ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে অধিকার ও স্বাধীনতা পাবেনা তখন তাদের মধ্যে এমন উদ্বেগজনক অস্থিরতার জন্ম নেবে যা কেবল মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর হবেনা বরং দেশ ও জাতির জন্য হবে বেদনাদায়ক ও ধ্বংসাত্মক। এহেন পরিস্থিতি শান্তি, স্থিতি, পারস্পরিক আস্থা, সম্মান, দেশের উন্নয়ন ও যৌথ কর্মপ্রয়াসের পথে বড় ধরণের অন্ত রায় ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে।

ঐতিহাসিক মসজিদগুলোকে মন্দিরে পরিণত করা দাবী

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ১৯৮৪ সালে ৭,৮ এপ্রিল এক গুপ্ত সম্মেলন আহবান করে। এতে সারা ভারতের বিপুল সংখ্যক চরমপন্থী হিন্দু অংশ গ্রহণ করে। সম্মেলনে মুসলিম জাতি গোষ্ঠীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে বিনাশ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব পাশ হয়। সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতের বুক থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ (Ethnic cleansing) এবং স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে তারা যেন পরিচয় দিতে না পারে। বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার ঈদগাহ ও অযোধ্যার বাবরী মসজিদকে মুসলমানদের হাত থেকে মুক্ত করে যথাক্রমে প্রথমটাকে বিঘুনাথের মন্দির, দ্বিতীয়টিকে কৃষ্ণ জন্মভূমি ও তৃতীয়টাকে রাম জন্মভূমিতে পরিণত করার দাবী জানানো হয়। ইতোমধ্যে বিশ্বহিন্দু পরিষদ দিল্লির কুতুব মিনার আগ্রার তাজমহলের নিচে মন্দির থাকার কাল্পনিক তথ্য প্রচার করে এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন ভেঙে ফেলার দাবী জানায়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (RSS) সাধারণ হিন্দু জনগণকে একথা বুঝাবার চেষ্টা করে যে, বর্তমানে যেখানে বাবরী মসজিদ প্রতিষ্ঠিত সেখানে ষোড়শ শতাব্দীর আগে জহিরুদ্দীন মুহামমদ বাবর এটা ভেঙ্গে মসজিদ তৈরী করেন। গোটা ভারতের ইংরেজী ও হিন্দী সংবাদপত্র সমূহ অত্যন্ত জোরালো ভাষায় রামজন্ম ভূমির পক্ষে উম্মত্ত প্রচারণা চালাতে থাকে। 

১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারী মসজিদের তালা আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হয়। আগে থেকেই মসজিদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মুর্তি স্থাপন করা হয়। এটা ছিল বড় ধরণের ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সঙ্কেত। আতঙ্ক ও দূর্যোগের ঘণঘটায় আচ্ছন্ন পরিবেশে দ্বীনি, জাতীয় গবেষণা, শিক্ষা বিষয়ক কোন কাজ হতে পারেনা। সম্পদ্রায় হিসেবে মুসলামনদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বই সংকটের আবর্তে পড়ে যায়। বাবরী মসজিদ রাম জন্ম ভূমিতে তৈরী হয়েছে এ গুজব ও প্রোপাগান্ডা খন্ডন করে লক্ষ্ণৌর ইসলামিক রিসার্চ ও পাবলিকেশন একাডেমী, আজমগড়ের দারুল মুসান্নিফীনের পক্ষ হতে বিজ্ঞ হিন্দু ও মুসলমানের লেখায় সমৃদ্ধ অনেক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ বেরিয়েছে। এসব নিবন্ধে বিজ্ঞ লেখকগণ প্রমাণ করেছেন যে, বাবর কোন মন্দিরকে ধ্বংস করে মসজিদ বানিয়েছেন এমন কোন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক  প্রমাণ নেই। থাকলেও তা বিতর্কিত স্থানের বাইরে।

উপসংহার :- ঘুমন্ত অস্থিরতাকে জাগিয়ে তোলা অনুচিত :ইতিহাসের চাকাকে উল্টো দিকে ঘুরাতে গেলে অপ্রয়োজনীয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটা একটি ঘুমন্ত বাঘ, তাকে জাগানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় গুলোর বিষয়ে ইতিহাসের ধ্বংসস্তুপ থেকে সত্য-মিথ্যা তথ্যাদি বের করে পুরণো অবয়বে ফিরে নেয়ার দাবী- একটি বড় ধরনের উত্তেজনার জন্ম দেবে এবং এর ধারাবাহিকতা শেষ হবার নয়। আমি প্রথম এ পরামর্শই দিয়েছি। অতঃপর আমি এই নিবন্ধ টা লিখার মাধ্যমে সরকার কে বলতে চাই যে, সরকার প্রকাশ্যে ঘোষণা করুক যে, প্রতিটি সম্প্রদায়ের উপাসনালয়গুলো ১৯৪৭ সালে ১৫ আগষ্টের পূর্ববর্তী অবস্থায় থাকবে। কোন সম্প্রদায়ের অপর সম্প্রদায়ের উপাসনালয় দখল করার অথবা কল্পিত পুরণো অবয়বে ফিরে নেয়ার অনুমতি দেয়া যাবেনা।

বর্তমান সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আমার আন্তরিক পরামর্শ তাঁরা যেন উপাসনালয় ও পবিত্র স্থান সমূহের পরিবর্তন ও পরিবর্দ্ধন করার বা আধিপত্য বিস্তারের অনুমতি না দেন। ইতিহাসকে পেছনের দিকে নেয়ার পরিবর্তে সামনে দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ কারণ- জীবন চলমান ও   প্রবাহমান। পৃথিবী দ্রুততর সাথে উন্নতির পথে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের দেশ বিশেষভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর সমস্যায় জর্জরিত। কল্যানকামিতা, মানবতা, শান্তিপ্রিয়তা ও নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এদেশকে পৃথিবীর নৈতিক নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হতে হবে। এটা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাভাবিকতা। পৃথিবীর বৃহত্তর শক্তিগুলো এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে এবং দুর্নামের ভাগী হয়েছে অনেকাংশে।



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter