সূরা মুলকের মহিমা: কীভাবে আপনি এটিকে আপনার জীবনের একটি অংশ করতে পারেন
ভূমিকা
সূরা মুলক কুরআনের ৬৭তম সূরা, যা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ৩০টি আয়াত নিয়ে গঠিত এবং “রাজত্ব” বা “সার্বভৌম ক্ষমতা” নামেও পরিচিত। এই সূরা আমাদের আল্লাহর মহত্ব, জীবন ও মৃত্যুর উদ্দেশ্য এবং পরকালীন হিসাব-নিকাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ এই সূরার ফজিলত ও বরকত সম্পর্কে বিশেষভাবে বলেছেন যে, এটি কবরে শাস্তি থেকে রক্ষা করে এবং কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। এই প্রবন্ধে সূরা মুলকের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ও ফজিলতকে হাদিসের উদ্ধৃতিসহ বাংলায় সরল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে।
১. জীবন ও মৃত্যুর উদ্দেশ্য
সূরা মুলকের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেন:
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
“তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন যে তোমাদের মধ্যে কে সেরা কাজ করে। আর তিনি পরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল’। (সূরা মুলক: ২)
এই আয়াত আমাদের শেখায় যে জীবন ও মৃত্যু অকারণ নয়। আল্লাহ এগুলো পরীক্ষা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, যাতে আমাদের কাজের মূল্যায়ন করা যায়। এই পরীক্ষায় তারাই সফল হবে যারা আল্লাহর আদেশ মেনে চলবে এবং নেক কাজ করবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
أَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ
“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হল যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা সামান্যই হয়’। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৬৪৬৪) এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের পরীক্ষার মূল বিষয় বড় কাজ নয় বরং নিয়মিত, আন্তরিক প্রচেষ্টা।
২. আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি মনোযোগ
সূরা মুলকে আল্লাহ আমাদের তাঁর সৃষ্টিকে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন:
الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَٰنِ مِن تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِن فُطُورٍ۔ ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ
“যিনি সাত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা দয়াময়ের সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি দেখবে না। একবার দৃষ্টি ফেরাও, কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি? তারপর দৃষ্টি বারবার ফেরাও; তোমার দৃষ্টি ক্লান্ত ও অপমানিত হয়ে ফিরে আসবে’।
(সূরা মুলক: ৩-৪)
এই আয়াতগুলো আমাদের আল্লাহর সৃষ্টির পরিপূর্ণতা ও সৌন্দর্য নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। যখন আমরা বিশ্বজগতের সৌন্দর্য দেখি, তখন আল্লাহর মহত্ব সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ
“নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে’।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৮৩৯)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে আল্লাহর সৃষ্টিকে চিন্তা করলে আমাদের বিশ্বাস আরও মজবুত হয় এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
৩. কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা
সূরা মুলকের সবচেয়ে বড় ফজিলত হলো এটি কবরে শাস্তি থেকে রক্ষা করে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
سورة تبارك هي المانعة من عذاب القبر
“সূরা মুলক কবরে শাস্তি থেকে রক্ষা করার জন্য’।
(সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস ২৮৯০)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, যারা নিয়মিতভাবে সূরা মুলক পাঠ করেন, তাদের কবরে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়।
অন্য একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
إِنَّ سُورَةً مِنَ القُرْآنِ، ثَلاَثُونَ آيَةً شَفَعَتْ لِصَاحِبِهَا حَتَّى غُفِرَ لَهُ: تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ
“কুরআনের একটি সূরা, যার ৩০টি আয়াত রয়েছে, তা পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে: ‘তাবারাকাল্লাজি বিইয়াদিহিল মুলক’।
(সুনান আবু দাউদ, হাদিস ১৪০০)
এই হাদিস থেকে জানা যায় যে সূরা মুলক কিয়ামতের দিন আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশ করবে এবং আল্লাহর কাছে আমাদের ক্ষমা চাইবে।
৪. কাফিরদের জন্য সতর্কবার্তা
সূরা মুলকে আল্লাহ তাঁর নির্দেশ অমান্যকারী এবং কাফিরদের জন্য কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন:
وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ
“তারা বলবে, ‘যদি আমরা শুনতাম বা বুঝতাম, তবে জাহান্নামের বাসিন্দাদের মধ্যে থাকতাম না’।
(সূরা মুলক: ১০)
এই আয়াত থেকে জানা যায় যে যারা আল্লাহর নির্দেশনা মানেনি, তারা পরকালে তাদের দোষ স্বীকার করবে এবং অনুশোচনা করবে। কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকবে না।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ
“বুদ্ধিমান সেই, যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরে জীবনের জন্য কাজ করে’। (সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস ২৪৫৯)
এই হাদিস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমাদের উচিত জীবনকে পরকালের প্রস্তুতির জন্য ব্যয় করা।
৫. সূরা মুলক থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
সূরা মুলক থেকে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করতে পারি:
- জীবন একটি পরীক্ষা: আমরা এই পৃথিবীতে ভালো কাজ করার মাধ্যমে আমাদের সাফল্যের প্রমাণ দিতে এসেছি।
- আল্লাহর শক্তি ও মহত্ত্ব: সৃষ্টির সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা নিয়ে চিন্তা করলে আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস বাড়ে।
- ইমানের গুরুত্ব: আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসের মাধ্যমেই প্রকৃত সফলতা অর্জিত হয়।
- কর্মফল: প্রতিটি কাজের হিসাব হবে, তাই দায়িত্বের সঙ্গে জীবনযাপন করা প্রয়োজন।
- কবরে রক্ষা: নিয়মিত সূরা মুলক পাঠ করলে কবরে শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৬. সূরা মুলককে জীবনের অংশ করার উপায়
- প্রতিদিন রাতে পড়ুন
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَنَامُ حَتَّى يَقْرَأَ الْم تَنْزِيلُ وَتَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ
“রাসূল ﷺ রাতে ঘুমানোর আগে সূরা আস-সাজদা এবং সূরা মুলক পড়তেন’।
(সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস ২৮৯২)
- তাফসির ও অর্থ বুঝুন
আয়াতের অর্থ ও মর্মার্থ বুঝলে আমাদের আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি বৃদ্ধি পায়।
- পরিবার ও বন্ধুদের শেখান
সূরা মুলকের গুরুত্ব সম্পর্কে অন্যদের জানানো। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই, যে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়’।
(সহিহ বুখারি, হাদিস ৫০২৭)
- আমল করুন
শুধু পড়া যথেষ্ট নয়, আমাদের উচিত সূরার বার্তা অনুযায়ী জীবনযাপন করা।
উপসংহার
সূরা মুলক কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা, যা আমাদের জন্য বরকত, নির্দেশনা ও সুরক্ষার উৎস। এটি আমাদের আল্লাহর মহত্ত্ব, জীবনের উদ্দেশ্য এবং পরকালের বাস্তবতা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়। নিয়মিত সূরা মুলক পাঠ করা, এর অর্থ বোঝা এবং এর শিক্ষার ওপর আমল করা আমাদের জন্য কবরের শাস্তি থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা লাভের উপায় হতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সূরার ফজিলত গ্রহণ করার তৌফিক দিন এবং দুনিয়া ও পরকালে সফলতা অর্জনের সুযোগ দান করুন। আমিন।