ইয়ামানের শহীদ ওলামা ও বারেলির রূহানী সেতুবন্ধন: ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ”
ভূমিকা :
ইসলামের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এখানে কেবল নামাজ-রোজা বা আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা নেই; বরং রয়েছে ত্যাগ, কুরবানি, ইলমের চর্চা ও রূহানিয়তের অব্যাহত ধারা। উম্মাহর ইতিহাসে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য আলেমে দ্বীন, সুফিয়ানে কিরাম ও শহীদ আত্মপ্রকাশ করেছেন, যাঁরা দীনের হেফাজতে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ইয়ামান ও শাম অঞ্চল বহু শতাব্দী ধরে ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, আর ভারতবর্ষে বারেলি শরীফ ইমাম আহমদ রজা খান (১৮৫৬–১৯২১) রহ.-এর মাধ্যমে আহলে সুন্নত-ওয়াল-জামাআতের আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে।
এই দুই অঞ্চলের মধ্যে রূহানী ও ইলমী সম্পর্কের ইতিহাস গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইয়ামানের শহীদ আলেমরা যেমন আহলে সুন্নতের আকীদা, আহলে বাইতের ভালোবাসা ও সুফিবাদের শিক্ষা প্রচারে অগ্রণী ছিলেন, তেমনি ইমাম আহমদ রজা খান বারেলভীও উপমহাদেশে একই ধারাকে সমুন্নত রাখেন। ফলে বলা যায়, ইয়ামান থেকে বারেলি পর্যন্ত এটি ছিল ইলম, আধ্যাত্মিকতা ও ঐক্যের এক সেতুবন্ধন।
কোরআন ও হাদীসে ইয়ামান ও শামের গুরুত্ব:
কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمۡ وَبَيْنَ ٱلۡقُرَى ٱلَّتِي بَٰرَكۡنَا فِيهَا قُرًى ظَٰهِرَةٗ وَقَدَّرۡنَا فِيهَا ٱلسَّيۡرَۖ
(সুরা সাবা, ৩৪:১৮)
এ আয়াতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে ইয়ামান ও শাম অঞ্চল বরকতময়। অন্যদিকে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন:
“আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি শামিনা, আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি ইয়ামানিনা।” (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৭৩৮৪)
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাদের শাম ও ইয়ামানকে বরকতময় করো। এমনকি হাদীসে আরও বর্ণিত হয়েছে যে ইয়ামানের লোকেরা “সবচেয়ে কোমল হৃদয় ও ঈমানের অধিকারী।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৫৩৫) এ থেকে স্পষ্ট হয়, ইয়ামান শুধু ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, বরং ইসলামের আধ্যাত্মিক মানচিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইয়ামানের হাদরামাউত ও সাদাত বালভী:
ইয়ামানের হাদরামাউত অঞ্চল ইসলামী জ্ঞানের এক ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্র। এখানকার সাদাত বালভী (আলওয়াই) ছিলেন ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর বংশধর। তাঁদের বংশলতিকা হযরত ইমাম জাফর সাদিক (রহ.) পর্যন্ত পৌঁছায়। তাঁরা ইসলামী দাওয়াত ও তাসাওউফের এমন এক ধারা সৃষ্টি করেন, যা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে শরীয়ত, তরিকত ও হাকীকতের সমন্বয় ঘটায়। ঐতিহাসিক গবেষণায় দেখা যায়—
তাঁরা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ে শাফেয়ী মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেন। আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল এবং ভারতবর্ষেও তাঁদের দাওয়াত পৌঁছে যায়। ভারতবর্ষের কেরালা, গুজরাট ও মহারাষ্ট্র অঞ্চলে তাঁদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী ছিল।
(দেখুন: আলী, সৈয়দ মুবারক, হাদরামাউত অ্যান্ড দ্য স্প্রেড অব ইসলাম ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া, জার্নাল অব ইসলামিক স্টাডিজ, ২০০২)
ইমাম আহমদ রজা খান বারেলভী ও ইয়ামানের আলেমগণ :
ইমাম আহমদ রজা খান রহ. ছিলেন উপমহাদেশের আহলে সুন্নতের সবচেয়ে প্রভাবশালী আলেম। তাঁর রচনাসমূহ, বিশেষ করে ফতোয়া-এ-রিজভিয়া, কেবল ভারতবর্ষেই নয়, বরং আরব বিশ্বের আলেমদের মাঝেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তিনি ইয়ামানের ইমাম আবদুল্লাহ আল-হাদ্দাদ রহ.-এর (মৃত্যু: ১৭২০ খ্রিস্টাব্দ) তাসাওউফকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করেছেন। তাঁর রিসালাগুলোতে ইয়ামানের আলেমদের আধ্যাত্মিক অবদানকে আহলে সুন্নতের জন্য আদর্শ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে, তাঁর আইনগত কাজ এবং পদ্ধতি ইসলামী বিশ্বের অন্যান্য অংশের পণ্ডিতদের দ্বারা স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হয়েছিল, যার মধ্যে আরব বিশ্বের কিছু পণ্ডিতও ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, মক্কাতুল মুকাররমার গ্রন্থাগারের কিউরেটর শেখ ইসমাইল খলিল আলা হযরতকে লিখেছিলেন, "আল্লাহর কসম, যদি আবু হানিফা (রাদ্বিআল্লাহু আনহু) এই ফতোয়াগুলি পড়তেন, তাহলে নিঃসন্দেহে এটি তাঁর হৃদয়ের আনন্দের কারণ হত এবং তাঁর ছাত্রদের মধ্যে এর লেখককে স্থান দিত।"
ইমাম আহমদ রজা খান তাঁর ভ্রমণকালে ইয়ামানি সুফি শাইখ হুসাইন বিন সালেহ আল-ইয়ামানির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এই সাক্ষাৎ তিনি তাঁর সফরনামা-এ-হিজাজ-এ বর্ণনা করেছেন। এ সাক্ষাৎ কেবল পরিচিতি নয়, বরং ইলম ও রূহানিয়তের এক আলোকিত সংযোগ।
ইয়ামানের শহীদ আলেমগণ :
২১শ শতাব্দীতে ইয়ামান সন্ত্রাসবাদ ও ওহাবি আগ্রাসনের শিকার হয়। আল-কায়েদা ও দায়েশের মতো গোষ্ঠী সুন্নি সুফি আলেমদের টার্গেট করে। বহু আলেম শহীদ হন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
শাইখ ইসমাইল বিন মুহাম্মদ আল-ইমরানি – ইয়ামানের প্রাক্তন গ্র্যান্ড মুফতি, যিনি বহুবার হত্যাচেষ্টার পরও শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আহলে সুন্নতের উপর দৃঢ় ছিলেন।
শাইখ আবদুর রহমান বিন আবদুল্লাহ আল-হুসাইনী – যাঁর মাদ্রাসা আল-কায়েদা জ্বালিয়ে দেয়, অবশেষে ২০১৩ সালে তাঁকে শহীদ করা হয়।
শাইখ মুহাম্মদ বিন সালিম বিন হাফিজ – বিশ্বখ্যাত দারুল মুস্তফার প্রতিষ্ঠাতা, যিনি একাধিক হত্যাচেষ্টা থেকে আল্লাহর হেফাজতে রক্ষা পান।
শাইখ হাসান মুহাম্মদ আল-বার – যাঁর ছাত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়।
(সূত্র: থমাস হেক, দ্য ক্রাইসিস অব সুফিজম ইন ইয়েমেন, মিডল ইস্ট জার্নাল, ২০১৭)
তাঁদের শহাদাত আসলে ইসলামের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের উপর আঘাত ছিল। এভাবে ওহাবি-নজদি মতাদর্শ আহলে সুন্নতের আলো নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
বারেলি ও ইয়ামানের রূহানী সেতুবন্ধন :
ইমাম আহমদ রজা খান রহ. ও ইয়ামানের আলেমদের মধ্যে রূহানী বন্ধন কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং ছিল আকীদা, তাসাওউফ ও আহলে বাইতের ভালোবাসায় দৃঢ় এক সংযোগ।
সাদাত বালভীরা মিলাদুন্নবী ﷺ উদযাপন, নাত পাঠ, জিয়ারতে কুবুর ও আহলে বাইতের সম্মান রক্ষায় দৃঢ় ছিলেন। ইমাম আহমদ রজাও একইভাবে আহলে বাইতের মহব্বত, মিলাদ ও নাত, সুফি রীতিনীতি রক্ষায় ছিলেন অবিচল। উভয়েই খারেজী-ওহাবি মতাদর্শের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রবল কণ্ঠস্বর তুলেছিলেন। আজও দারুল মুস্তফা (তারিম, ইয়ামান) এবং উপমহাদেশের জামিয়া রিজভিয়া (লাহোর), জামিয়া আশরফিয়া (মুবারকপুর) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এই ঐক্য ও সংযোগের প্রতীক।
উপসংহার :
ইয়ামানের শহীদ ওলামা ও বারেলির রূহানী সম্পর্ক প্রমাণ করে যে ইসলাম একটি সীমাহীন আধ্যাত্মিক ধারা। এর ভিত্তি হলো কোরআন, সুন্নাহ, আহলে বাইতের ভালোবাসা ও তাসাওউফের আলো। ইয়ামানের আলেমরা তাঁদের রক্ত দিয়ে ইসলামী ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন। ইমাম আহমদ রজা খান বারেলভী তাঁদের ইলমী ও রূহানী ধারা উপমহাদেশে শক্তিশালী করেছেন। আজ মুসলিম উম্মাহ নানা সন্ত্রাস, বিভক্তি ও ভ্রান্ত মতাদর্শের শিকার হলেও ইয়ামান ও বারেলির এই ইতিহাস আমাদের শেখায়— ইসলাম হলো শান্তি, জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। আহলে বাইতের ভালোবাসা হলো ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওহাবি-খারেজী মতাদর্শ থেকে উম্মাহকে রক্ষা করা প্রতিটি আলেম ও মুসলমানের দায়িত্ব।
অতএব, ইয়ামানের শহীদ আলেম ও বারেলির ইমাম আহমদ রজার মধ্যে যে আত্মিক বন্ধন ছিল, সেটি আজও উম্মাহর জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।