মেরাজুন্নবী: ইসলামী ইতিহাসের একটি মননশীল এবং শিক্ষণীয় ঘটনা

ভূমিকা :

মেরাজুন্নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং অলৌকিক ঘটনা। এটি এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছিল যখন তাঁর প্রচারিত ইসলামী আন্দোলন ও মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যক্তিগত জীবন চরম সংকটে নিপতিত ছিল। এই ঘটনা ইসলামী জগতের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই এর শিক্ষাগুলো কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য পথনির্দেশক হয়ে থাকবে। মেরাজের ঘটনা আমাদের শেখায় আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা রাখা, কঠিন পরিস্থিতিতে দৃঢ় থাকা এবং মহান লক্ষ্য অর্জনে আত্মত্যাগ করা।

মেরাজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত লাভের পর থেকে মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ব্যাপক বিরোধিতা এবং অত্যাচারের সম্মুখীন হন। শত্রুরা তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালায়। এমনকি হযরত আম্মার, সুমাইয়া এবং ইয়াসিরের মতো সাহাবিরা শহীদ হন। শুআবে আবি তালিবে তিন বছরের নির্যাতন ও বঞ্চনার পরও কুরাইশের মন গলাতে পারেননি মহানবী (সা.)। তাঁর দুই প্রধান আশ্রয়দাতা, হযরত খাদিজা (রা.) ও আবু তালিবের ইন্তেকালের ফলে নবুওয়াতের দশম বর্ষে তাঁর জীবন আরও বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই কারণেই উক্ত বছর ইসলামী ইতিহাসে ‘আমূল হুজন’  নামে পরিচিত।

এই দুঃসময়ে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবীকে এক রাতের বিশেষ সফরের মাধ্যমে স্বস্তি ও শক্তি প্রদান করেন। এ সফরেই তিনি পৃথিবী থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস (মসজিদে আকসা) এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বজগতের দিকে যাত্রা করেন। এই যাত্রার সারসংক্ষেপ পবিত্র কুরআনের সুরা আল-ইসরা ও সুরা আন-নাজমে উল্লেখিত হয়েছে।

মেরাজের সারসংক্ষেপ :

মেরাজের ঘটনা শুরু হয় পবিত্র কাবা থেকে, যেখানে ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আ.) মহানবীকে বোরাকে আরোহন করিয়ে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে তাঁরা পৌঁছান বায়তুল মুকাদ্দাসে, যেখানে অতীতের নবীদের সমাবেশে মহানবী (সা.) ইমামতি করেন। এই কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর ইসরা নামে আমরা জানি। এরপর ঊর্ধ্বজগতের যাত্রায় মহানবী (সা.) একে একে সাত আসমানের নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে তিনি মহান আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে ধন্য হন। মি'রাজ্ শব্দটি আরাজা عرج থেকে সংকলিত যার অর্থাৎ উর্ধে   সম্প্রসারিত হওয়া।

এ যাত্রায় মহানবী (সা.) জান্নাত-জাহান্নামের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন এবং বিভিন্ন ঐশী নিদর্শন দেখেন। আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের এ মুহূর্তে নামায পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত হয়, যা পরবর্তীতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়।

মেরাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা :

মেরাজুন্নবী শুধু একটি অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং এর রয়েছে বহুমুখী তাৎপর্য। এটি যেমন আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ, তেমনি এটি মানবজাতির জন্য বিশেষ শিক্ষার উৎস।

নামাযের গুরুত্ব: মেরাজে মহানবী (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে নামাযের আদেশ পান। নামায মুমিনদের জন্য মেরাজ, যা তাঁদের আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত করে। ধৈর্য ও আত্মত্যাগের শিক্ষা: মহানবী (সা.)-এর জীবন যন্ত্রণার মধ্যেও আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং ধৈর্যের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের অনুপ্রেরণা দেয়। ঐক্য ও নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা: বায়তুল মুকাদ্দাসে সকল নবীর ইমামতি করার মাধ্যমে ইসলামের নেতৃত্বের মূল বার্তা প্রতিফলিত হয়। ইসলামী আন্দোলনের পরিকল্পনা: মেরাজের ঘটনাগুলো মুসলিমদেরকে শিখিয়েছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে। জান্নাত ও জাহান্নামের বাস্তবতা: মেরাজে জান্নাত ও জাহান্নামের চাক্ষুষ অবস্থা দেখানো হয়, যা মুমিনদের ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করে এবং পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ: অতীতের নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাঁদের জীবনের শিক্ষা মুসলিম উম্মাহকে তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে।

উপসংহার :

মেরাজুন্নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের এক অনন্য ঘটনা, যা ইসলামের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়। এটি যেমন ইসলামের অলৌকিক দিককে তুলে ধরে, তেমনি মানবজাতির জন্য মূল্যবান শিক্ষা ও নির্দেশনা প্রদান করে। মেরাজের পরে মহানবী (সা.)-এর জীবন ও মিশনে এক নতুন গতি ও প্রেরণা আসে। হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণ, আকাবার চুক্তি, মদিনায় হিজরত, এবং বদর ও মক্কা বিজয়সহ ইসলামের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো মেরাজের ঘটনার পরে সংঘটিত হয়। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, মেরাজ মহানবী (সা.)-এর জন্য স্রষ্টার পক্ষ থেকে একটি বিশেষ মনোবল ও দিকনির্দেশনা ছিল। মেরাজের শিক্ষা থেকে আমরা শিখি ধৈর্য, আত্মত্যাগ, একতা, এবং আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের পথ। প্রতিটি মুসলমানের উচিত মেরাজের শিক্ষাগুলো জীবনে বাস্তবায়ন করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করা।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter