সুরা কাহফ: অবতীর্ণের কারণ, মর্যাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিশ্লেষণ
প্রস্তাবনা :
সুরা কাহফ কুরআনের ১৮ তম সুরা, যা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এই সুরায় আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার এবং শিক্ষণীয় বিষয়ের আলোচনা করেছেন যা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই সুরায় মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে: আসহাব কাহফের ঘটনা, হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনা, হযরত দুল-কর্ণাইন (আঃ)-এর ঘটনা এবং যাজু্জ মাজুজের ঘটনা। এই প্রবন্ধে সুরা কাহফের অবতীর্ণের কারণ, এর মর্যাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ ও তাফসির প্রদান করা হবে।
সুরা কাহফ অবতীর্ণের কারণ বা শানে নুযুল :
আল-নাদর ইবন আল-হারিস একজন ভ্রমণকারী ছিলেন এবং সেই সময়ে দেশের সভ্যতার জন্য পরিচিত ছিলেন। সে ছিল কুরাইশদের একজন শয়তান, এবং সে ছিল সেই ব্যক্তি যে রসূলকে কষ্ট দিয়েছিল কারণ সে এমনভাবে গল্প বলতে পারত যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মনোযোগ সরাতে পারে যখন তিনি বার্তার বিষয়ে লোকদের সাথে কথা বলতেন। সে তার লোকদের উপদেশ দে এবং তাদের বলে যে মুহাম্মদ এই ধর্মের বিষয়টি নিয়ে আসার আগে সত্যবাদী এবং বিশ্বস্ত এবং কুরাইশদের সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন এবং যখন তিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করলেন, তখন আমরা তাকে একজন কবি এবং একজন যাদুকর, একজন গণক এবং একজন পাগল বলেছিলাম, এবং আমরা তাঁর কাছ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধরনের কবিতা এবং গীতিকারদের কথা শুনেছিলাম এবং আমরা সেগুলি সম্পর্কে জানি এবং আমরা যাদুকরদের দেখেছি এবং আমরা যাদু সম্পর্কে জানি; তাই সে যা নিয়ে এসেছিল তা জাদু ছিল না এবং তার মধ্যে পাগলামির কোন চিহ্নও ছিল না। সে তাদের এই মহৎ বিষয়টি যা নবিজি নিয়ে এসেছেন তা তদন্ত করতে বলে, তাই কুরাইশরা তার পরামর্শ গ্রহণ করে আল-নাদর বিন আল-হারিস এবং উকবা বিন আবি মুয়াইতকে মদিনায় ইহুদি রাব্বিদের কাছে পাঠায় এবং কুরাইশরা বলে যে তাদের আল্লাহর নবী ও রাসূলদের সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। এবং যেহেতু ইহুদিরা কিতাবের লোক-তাওরাতের লোক - তাই তারা তাদের কাছে এসেছিল তাদের সঙ্গী-মোহাম্মদ ﷺ এর বিষয় সম্পর্কে বলার জন্য - এবং তারা তাদের কাছে তার গুণাবলী এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন তা বর্ণনা করে। ইহুদী রাব্বিরা তাদের প্রতুত্তরে বলে, তাকে তিনটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করুন:
- আসহাব কাহফ কারা ছিল?
- হযরত দুল-কর্ণাইন (আঃ)-এর ঘটনা কি ছিল?
- রূহের প্রকৃতি কি?
এই প্রশ্নগুলোর উদ্দেশ্য ছিল নবী ﷺ-এর নবুওয়তের সত্যতা পরীক্ষা করা। নবিজি তাদের প্রতুত্তরে বলেন, "আগামীকাল তোমরা যা জিজ্ঞাসা করেছিলে আমি তা আমি তোমাদের বলব, কিন্তু তিনি ইনশাল্লাহ বলতে ভুলে যান এবং তারা সেখান থেকে চলে যায়। নবীজি তিন দিন অবস্থান করেছিলেন, এবং তারা মক্কাবাসীদের কাছে যে খারাপ খবরটি ছড়িয়ে দিয়েছিল তাতে তিনি গভীরভাবে দুঃখিত হয়েছিলেন এবং তিনি তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরী করেছিলেন এটি নবীর জন্য একটি তিরস্কার ছিল কারণ তিনি ইনশাল্লাহ বলেননি। অবশেষে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নাজিল করেন:
(وَلا تَقولَنَّ لِشَيءٍ إِنّي فاعِلٌ ذلِكَ غَدًا* إِلّا أَن يَشاءَ اللَّهُ وَاذكُر رَبَّكَ إِذا نَسيتَ وَقُل عَسى أَن يَهدِيَنِ رَبّي لِأَقرَبَ مِن هـذا رَشَدًا)
কিন্তু আল্লাহ তাআলা সুরা কাহফের মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেছেন এবং মানব জাতিকে হেদায়াত প্রদানের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও দিয়েছেন। এই সুরার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের ঈমান এবং আল্লাহর হেদায়াতের গুরুত্ব বোঝানো।
সুরা কাহফের মর্যাদা
সুরা কাহফের অনেক বড় মর্যাদা রয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
“যে ব্যক্তি শুক্রবারে সুরা কাহফ পড়বে, তার জন্য আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত আল্লাহর নূর (আলোর) বরকত থাকবে। “
(জামি’ তিরমিজী)
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন: “সুরা কাহফ পড়া হল মনের প্রশান্তি এবং এটি ফিতনাহ থেকে রক্ষা করে।“
এই মর্যাদা আমাদের সুরা কাহফের গুরুত্ব এবং এর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে সহায়ক।
সুরা কাহফের চারটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
সুরা কাহফে চারটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, প্রতিটি ঘটনা মানব জীবনে বিশেষ শিক্ষা ও উপদেশ প্রদান করে:
১. আসহাব কাহফের ঘটনা
আসহাব কাহফের ঘটনা সুরা কাহফের প্রারম্ভিক আয়াতগুলোতে (৯-২৬) বর্ণিত হয়েছে। এটি সাতজন যুবক ও তাদের এক কুকুরের ঘটনাকে তুলে ধরে। তারা আল্লাহর ইবাদত করার জন্য অত্যাচারী শাসক থেকে বাঁচতে একটি গুহায় আশ্রয় নেয় এবং আল্লাহর রহমতে তারা ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে থাকে। তাদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে:
“তোমরা মনে করো তারা জেগে ছিল, অথচ তারা ঘুমিয়ে ছিল। এবং আমরা তাদের ডান-বামে পালটে পালটে ঘুমাতে দিয়েছিলাম।“
(সুরা কাহফ: ১৮)
এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর সাহায্য সর্বদা থাকে, যদিও আমাদের দৃষ্টিতে সেটা স্পষ্ট নাও হতে পারে।
২. হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনা
সুরা কাহফের ৬০-৮২ আয়াতে হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত খিজির (আঃ)-এর মধ্যকার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একদিন হযরত মূসা (আঃ) বলেছিলেন, “আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।“ তখন আল্লাহ তাঁকে হযরত খিজির (আঃ)-এর কাছে পাঠান।
হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত খিজির (আঃ)-এর মধ্যে তিনটি ঘটনা ঘটে: প্রথম ঘটনা (নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত করা)
হযরত খিজির (আঃ) একটি নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত করেন, যা দেখে হযরত মূসা (আঃ) অপ্রসন্ন হন। তবে হযরত খিজির (আঃ) ব্যাখ্যা করেন যে, এই নৌকার ক্ষতি একটি নেককার মানুষের জন্য, কারণ এটি একটি ظالم রাজা থেকে রক্ষা পাবে।
“এটি একটি নৌকা ছিল যা কিছু দরিদ্র মানুষের ছিল, আর তারা সমুদ্রের উপর এটি চালাতো।“
(সুরা কাহফ: ৭৯)
দ্বিতীয় ঘটনা (শিশু হত্যা)
হযরত খিজির (আঃ) একটি শিশু হত্যা করেন। হযরত মূসা (আঃ) এই ঘটনা দেখে প্রশ্ন করেন। হযরত খিজির (আঃ) ব্যাখ্যা করেন যে, এই শিশুর মৃত্যু তার অভিভাবকদের জন্য ভালো ছিল, কারণ এই শিশু তাদেরকে কুফর ও গোমরাহীর দিকে নিয়ে যেতে পারত।
“আমরা এই শিশুটিকে হত্যা করেছি যাতে তার বদলে একটি ভালো সন্তান প্রদান করতে পারি।“
(সুরা কাহফ: ৮১)
তৃতীয় ঘটনা (দেয়াল নির্মাণ)
হযরত খিজির (আঃ) একটি দেয়াল মেরামত করেন, যা দেখতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল। হযরত মূসা (আঃ) জিজ্ঞেস করেন কেন তিনি এটি করেছিলেন। হযরত খিজির (আঃ) বলেন যে, এই দেয়ালের নিচে দুইটি ইয়াতিমের গোপন ধন রয়েছে, যা তাদের জন্য নিরাপদ রাখতে এই দেয়ালটি নির্মাণ করা হয়েছে।
“এটি সেই ইয়াতিমদের জন্য ছিল, যাদের নিচে একটি ধন ছিল।“
(সুরা কাহফ: ৮২)
৩. হযরত দুল-কর্ণাইন (আঃ)-এর ঘটনা
হযরত দুল-কর্ণাইন (আঃ)-এর ঘটনা সুরা কাহফের ৯৩-৯৮ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি একটি বড় রাজা ও আল্লাহর নেক বান্দা ছিলেন। হযরত দুল-কর্ণাইন (আঃ) যাজু্জ মাজুজের আক্রমণ থেকে মানুষের রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী বাঁধ তৈরি করেন।
“এটি একটি বাধা ছিল, যা তাদের মধ্যে একটি অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল এবং তারা এর পেরিয়ে যেতে পারত না।“
(সুরা কাহফ: ৯৭)
৪. ইয়া’জূজ মা’জুজের ঘটনা
হযরত দুল-কর্ণাইন (আঃ) যাজু্জ মাজুজের জাতির আক্রমণ থেকে মানুষের রক্ষার জন্য বাঁধ তৈরি করেন। এই ঘটনা আল্লাহর ক্ষমতা এবং তাঁর পরিকল্পনার বৃহত্তম দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করে।
উপসংহার :
সুরা কাহফে বর্ণিত ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর অফুরন্ত হিকমত, শক্তি এবং সাহায্যের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। আসহাব কাহফের ঘটনা আল্লাহর সাহায্য ও বিশ্বাসের গুরুত্ব, হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনা আল্লাহর হিকমত ও রেজা বোঝার প্রয়োজনীয়তা, হযরত দুল-কর্ণাইন (আঃ)-এর ঘটনা আল্লাহর শক্তির উপর নির্ভরশীলতার শিক্ষা এবং যাজু্জ মাজুজের ঘটনা আল্লাহর পরিকল্পনা ও ন্যায় বিচারকে তুলে ধরেছে।