সুদান সংকট: ক্ষমতার ক্ষুধায় পেটের ক্ষুধা নিবৃত
১৫ এপ্রিলে শুরু হয়ে ১৫ মে পেরিয়ে গেল। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০০ মানুষ নিহত, ৫০০০ অধিক আহত এবং অসংখ্য নর নারী শিশু বৃদ্ধ বাস্তুচ্যুত, প্রবাসী বিদেশিরা রেহাইয়ের উপায়ে পলায়নরত। এতসত্বেও, কোনো বিরতির অবকাশ, কোনো সন্ধির আশ্বাস দেখা যায়না আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সুদানে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কেন্দ্ৰভূত হয়ে আছে আন্তর্জাতিক মনোযোগ।
দীর্ঘ সংঘাতে যুক্ত সৌদি আরব, ইরান, তুর্কি, সিরিয়া ইত্যাদি দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মনে হচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশ গুলিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রত্যাবর্তন ঘটবে। কিন্তু আফ্রিকার মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত সুদানে নতুন ঘটনা এই ভাবনাকে দুঃস্বপ্নে পরিবর্তন করে। সুদান নিজেই নিজের সঙ্গে লড়ছে। প্রকাশ্যে কোনো ব্যহিক শক্তির অংশগ্রহণ নেয়। সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ বুরহান এবং আধাসামরিক নেতা মুহাম্মদ হামদান দাগোলার ক্ষমতা অধিগ্রহণের লোভ দেশের সেনা ও প্যারামিলিটারি র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সকে (Rapid Support Force, RSF) যথাক্রমে লড়িয়ে দিয়েছে। ফলতঃ, রাজধানী খার্তুম এবং দাফোর অঞ্চলজুড়ে পুরোটা দেশে গৃহযুদ্ধের প্রকোপে জ্বলছে।
ক্ষেত্রফল ও জনসংখ্যায় আফ্রিকা মহাদেশ এবং আরব লীগের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সুদান (২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান বিভক্ত হওয়ার আগে দুই ক্ষেত্রেই সুদান বৃহত্তম দেশ ছিল) ১৯৫৬ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে দেশটি মুক্তি পাইনি। সুদানের ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে কখনো রাজনৈতিক তো কখনো জাতিগত দ্বন্দ্ব দেখা গেছে। এই সমগ্র ঝামেলায় ক্ষয়ক্ষতির হাত অত্যান্ত। সাম্প্রতিক উদাহরণ - কেন্দ্র সরকার ও দক্ষিণাঞ্চলের দুই গৃহযুদ্ধ ১৫ লাখের অধিক প্রাণ নিহত হয়। আরও বিভিন্ন দ্বন্দ্বে অসংখ্যা আশ্রয়হীন মানুষকে স্থানান্তর হতে বাধ্য হতে হয়।
প্রশাসন ক্ষমতা ক্ষুধায়
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের ইতিহাসে কখনো পক্তা স্থিতিশীলতা গড়ে তুলতে পারিনি। মিলিটারী কমান্ডার বারবার সামরিক অভ্যুত্থান করে সরকার পতন ঘটিয়ে তাদের শাসন শুরু করে। অনুরূপ দৃষ্টান্ত দেখা যায় ১৯৭৩ সালে। সামরিক নেতা ওমর আলবাশির শাসন পদে দখল করে। কিন্তু সে ভীত ছিল যে অন্য এক সামরিক অভ্যন্তরীনে সে যেন ক্ষমতাচ্যুত না হয়। তার শাসনের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিরোধকে দমন করার জন্য দেশের প্রতিটি অংশ থেকে তার অনুগত হিসেবে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৩ সালে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স বলা হয়।
দারফুর অঞ্চলে যখন ওমরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গতি জন্ম নিলে, বিশ্বস্ত বিশেষ ফোর্স প্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে উঠে। সরকার গণহত্যা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ওমর কখনোই ভেবে পাইনি যে ভবিষ্যতে তার ফাঁদে সে নিজেই পড়ে যাবে। এবার র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স নিজেই সরকারের বিরুদ্ধে অভুত্থান আন্দোলন আরম্ভ করে। কেন্দ্রীয় সৈন্য, আধাসামরিক এবং জনগণের একত্রিত শক্তি উমর আল বাশিরকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। এমনকি র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স তাকে বিভিন্ন গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক কোর্টে সমর্পিত করে দেয়।
তারপর কিছু সময়ের জন্য সুদানের রাজনৈতিক স্তরে সাভাবিক পরিস্থিতি দেখা দিলেও, ২০২৩ এর প্রাম্ভে এবার ক্ষমতার অধিকারে ঝামেলা বাঁধে সেন্ট্রাল আর্মির আবদুল ফাত্তাহ এবং প্যারামিলিটারি ফোর্সের হামদান দাগোলার। পরিস্থিতির প্রতিকূলতা কত ভয়ংকর হতে পারে যখন দেশের দুই সৈন্যদল সামনাসামনি লেগে পড়ে। আবার আরম্ভ হয় গৃহযুদ্ধ! পরিণাম বর্তমান সুদান - বোমাবর্ষণের ধোঁয়া, গলির আওয়াজ, ছিটকে পড়া রক্ত, শিশু-নারীর কান্না, পলায়নরত মানুষ, ধসে পড়া দালান, মরছে মানবতা, আর ক্ষমতার ক্ষুধা!
বিভিন্ন দেশ স্থিতিশীলতার জন্য নিস্ফল শান্তি প্রক্রিয়া গঠনে নিয়োজিত। উদ্ধার অভিযানও চলছে। সৌদি আরব এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। ভারত তার নাগরিকদের সঙ্কট থেকে নিরাপদ অঞ্চলে প্রত্যাবাসনের জন্য কাবেরি অপারেশন শুরু করেছে।
জনগণ পেটের ক্ষুধায়
সুদান বিভিন্ন জীবনমান ও উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকের (Global Hunger Index) রিপোর্টেও সুদানের অবস্থা অনুশোচনীয়।হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (Human Development Index) সুদানের স্থান ১৬৭ যা একেবারে শেষের দিকে। এসবের প্রধান কারণ সরকারের অস্থিরতা এবং ক্ষমতার লোভ। উদাহরণস্বরূপ, দুর্নীতি উপলব্ধি সূচক (Corruption Perception Index) অনুসারে সুদান বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ।
ক্ষমতার ক্ষুধায় যারা দেশের মধ্যে আগুন লাগাচ্ছে তারা অবশ্যই মানবতার সমীপে জবাবদিহি। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় (sanctions) দেশীয় মানুষের কোন প্রকারের উন্নতি নায়, তাদের প্রয়োজন সচ্ছল প্রশাসন এবং স্থিতিশীল শান্তির পরিবেশ। আফ্রিকার মধ্যে আবার সুদান হয়ে উঠুক সভ্যতার অগ্রাহী।