ইসলামে মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা ও আদর্শ মূল্যবোধ সংরক্ষণ

ভুমিকা:

ইসলাম মানবতার সম্মানের ধর্ম, শান্তি ও নিরাপত্তার বাহক। উচ্চ মানবিক মূল্যবোধ ও মানবতার প্রতি সম্মান রক্ষাই এর
প্রধান ইশতেহার। বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম ইসলামকে প্রায়ই ভুল বোঝানো হয় এবং মিডিয়াতে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়।
যাইহোক, এর পেছনে ইসলাম মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং আদর্শ মূল্যবোধ সংরক্ষণের প্রচার করে। আজ আমরা
ইসলামের শিক্ষাগুলি আলোচনা করব যা সমস্ত মানুষের জন্য সম্মানকে বৃহত্তম রূপে প্রকাশ করে। এবং সেই নীতিগুলি যা
মুসলিমদের অন্যদের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়ায় আদর্শ মূল্যবোধ সংরক্ষণে গাইড করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি আদম
সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও নদীতে চড়ার ব্যবস্থা করেছি এবং তাদেরকে পবিত্র বস্ত্র প্রদান করেছি
এবং তাদেরকে বহু সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরাঃ বানী ইসরাইল)

সম্মানের মৌলিক নীতি:

ইসলামের শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হল ঈশ্বরের একত্ববাদে বিশ্বাস, যা শাহাদাতে প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বাসের ইসলামী ঘোষণা:
“আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, এবং মুহাম্মদ তাঁর রসূল”। এই মৌলিক বিশ্বাস সমস্ত মানবতার জন্য সম্মানের ভিত্তি স্থাপন
করে, কারণ এটি মানব জাতির অপরিহার্য ঐক্যকে স্বীকৃতি দেয়। ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে আল্লাহ বলেন, “হে
মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে নর ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে
অপরকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধার্মিক সেই ব্যক্তি”। (৪৯:১৩)
এই এই আয়াতটি প্রমাণ করে দেয় যে, মানব বৈচিত্র্য তা জাতিগত, ভাষা বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই হোক না কেন, বিভাজন বা
শ্রেষ্ঠত্বের উৎস নয় বরং মানুষের জন্য একে অপরের কাছ থেকে শেখার এবং পারস্পরিক সম্মান বৃদ্ধির একটি সুযোগ। ইসলাম
যে কোনো ধরনের বর্ণবাদ বা বৈষম্যকে দৃঢ়ভাবে নিরুৎসাহিত করে। প্রমাণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকার সম্মান সামাজিক মর্যাদা
বা জাতিগততার চেয়ে ধর্মপরায়ণতা এবং ধার্মিকতার মধ্যে নিহিত।

মানব জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা:

ইসলাম একটি রহমতের ধর্ম, জাতি ও ধর্মের ভেদাভেদ ছাড়াই, সকল মানুষের প্রতি করুণা ও দয়ার বৈশিষ্ঠের অন্তর্ভুক্ত।
ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা সভ্যতায় আপনি মানবতাবাদ এবং সাধারণ মানুষের প্রতি করুণা ও দায়ার ধারণা খুঁজে পাবেন না,
যা ইসলাম উপস্থাপন করেছে। মানব জীবনের পবিত্রতা ইসলামের একটি মূল নীতি। আল্লাহ তায়াআ বলেন, “যে ব্যক্তি একটি
আত্মাকে হত্যা করে ব্যতীত কোন আত্মার জন্য বা দেশে দুর্নীতির জন্য - সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করেছে। আর যে
একজনকে বাঁচায় - সে যেন সম্পূর্ণ মানবজাতিকে রক্ষা করল”। (৫:৩২)
এই আয়াতটি মানব জীবনের অপরিসীম মূল্যকে তুলে ধরেছে এবং অন্য ব্যক্তির জীবন অন্যায়ভাবে নেওয়ার মাধ্যাকর্ষণকে তুলে
ধরেছে। ইসলাম নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে হত্যা ও সহিংসতাকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করে। ইসলাম অন্যদের প্রতি, বিশেষ করে
অসহায়ের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শনকে উৎসাহিত করে। সাদাকাহ এবং যাকাত ধারণাটি অভাবীদের সাহায্য করার এবং
সম্প্রদায়ের দুর্বল সদস্যদের সমর্থন করার ধারণাকে প্রচার করে। এটি করার মাধ্যমে, মুসলমানদের সকল মানুষের মর্যাদা
এবং মঙ্গলের জন্য সহানুভূতি এবং সম্মান গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা হয়।

বিশ্বাসের স্বাধীনতা:

ইসলাম বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয় এবং ব্যক্তির ধর্ম বেছে নেওয়ার অধিকারকে সম্মান করে। যেমন আল্লাহ এরশাদ
করেছেন, “ধর্ম গ্রহণে কোন জবরদস্তি থাকবে না”। ( আল-বাকারা:২৫৬)
এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, বিশ্বাস ব্যক্তিগত প্রত্যয়ের বিষয় হওয়া উচিত এবং কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
মুসলমানদেরকে বলপ্রয়োগ বা জবরদস্তি না করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং সংলাপের মাধ্যমে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দিতে
উৎসাহিত করা হয়। ইসলামে আদর্শ মূল্যবোধের সংরক্ষণ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রেও উপযোগী। কুরআন বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করে এবং
সম্মানজনক সহাবস্থানের পক্ষে সমর্থন করে, কুরআন শরীফে বর্ণিত আছে যে, “তোমার কাছে তোমার ধর্ম, আমার কাছে আমার
ধর্ম”। (১০৯:৬) এই আয়াতটি ধর্মীয় সহনশীলতার নীতির উদাহরণ দেয় এবং অন্যদের বিশ্বাস ও অনুশীলনকে সম্মান করার
গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।

লিঙ্গ সমতার প্রতি শ্রদ্ধা:

ইসলাম নারী-পুরুষের সমান মর্যাদার প্রদান করে। লিঙ্গের মধ্যে অন্তর্নিহিত পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময়, ইসলাম
নিশ্চিত করে যে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই ঈশ্বরের কাছে আধ্যাত্মিক সমান। কুরআন শরীফে বর্ণিত আছে যে, “যে ব্যক্তি সৎ
কাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, সে ঈমানদার অবস্থায়, আমরা অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন প্রদান করব এবং অবশ্যই তাদের
(পরকালে) পুরষ্কার দেব যা তারা করত তার সর্বোত্তম অনুসারে”। (১৬:৯৭)

নারীর অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা:

ইসলাম নারীর অধিকার এবং সমাজের অবিচ্ছেদ্য সদস্য হিসেবেও ভূমিকার পালন করে। ইসলাম নারীদের শিক্ষা, সম্পত্তির
মালিকানা এবং উত্তরাধিকারের অধিকার প্রদান করে। নবী মুহাম্মদ (সা.) নারীদের অধিকারের পক্ষে ছিলেন এবং তাদের সাথে
অত্যন্ত সম্মান ও সদয় আচরণ করতেন। তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম”।
ইসলাম অভিভাবকত্বের ধারণাকেও প্রচার করে, যেখানে পুরুষরা তাদের পরিবারের সুরক্ষা এবং আর্থিক সহায়তার জন্য দায়ী।
যাইহোক, এই দায়িত্বটি মহিলাদের সাথে ভালবাসা, সহানুভূতি এবং সম্মানের সাথে আচরণ করার বাধ্যবাধকতার সাথে আসে।
যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছে, “এবং তাঁর নিদর্শনগুলির মধ্যে এটি হল যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সঙ্গী সৃষ্টি
করেছেন, যাতে তোমরা তাদের সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পার এবং তিনি তোমাদের মধ্যে প্রেম ও করুণা স্থাপন করেছেন”।
(৩০:২১)

উপসংহার:


ইসলামে মানুষের পবিত্রতা ও শালীনতা কতটা সুরক্ষিত, তা এথেকেই অনুমান করা যায় যে, মৃত্যুর পরও একজন ব্যক্তির সম্মান
করা আবশ্যক এবং মৃতকে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার সাথে গোসল করানো, পরিষ্কার কাফন পরিয়ে সুগন্ধি মাখানো, যানাযার নামায
পড়া, তারপর কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং আদর্শ মূল্যবোধ সংরক্ষণ ইসলামের
মৌলিক নীতি। ইসলাম তার অনুসারীদের মানব জীবনের পবিত্রতাকে মূল্য দিতে, অন্যের অধিকার ও বিশ্বাসকে সম্মান করতে এবং
ন্যায়বিচার, সমবেদনা এবং সমতার নীতিগুলিকে সমুন্নত রাখতে শেখায়। এই শিক্ষাগুলোকে আলিঙ্গন করে, মুসলমানরা একটি
সুসংগত ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ তৈরি করার চেষ্টা করে। যেখানে সকল ব্যক্তিকে তাদের পটভূমি বা বিশ্বাস নির্বিশেষে মর্যাদা ও
সম্মানের সাথে আচরণ করা হয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter