নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সাফিয়্যা (রা.)-কে বিবাহ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও দুটি  প্রধান আপত্তির পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ

১. ভূমিকা

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সহিত বনু নাদীর গোত্রের সাফিয়্যা বিন্ত হুয়াইয়্য (রা.)-এর বিবাহটি আধুনিক পশ্চিমা সমালোচক, মিশনারি ও প্রাচ্যবিদদের (Orientalists) মধ্যে নিয়মিত আগ্রহ ও বিতর্কের বিষয়বস্তু হইয়া আসিয়াছে। এই আপত্তিসমূহ প্রধানত দুইটি মূল ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান:

  1. i) এই বিবাহ খায়বার নামক আরবের অন্যতম প্রধান ইহুদি-অধ্যুষিত অঞ্চলের বিজয়ের পর সম্পন্ন হয়—যেখানে সাফিয়্যা (রা.)-এর স্বামী ও পরিবারের অন্যন্য সদস্যগণ নিহত হইয়াছিলেন; তাঁহার পিতাও কয়েক বৎসর পূর্বে (বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনায়) নিহত হন। তখন তাঁহারা প্রশ্ন উত্থাপন করেন: কী প্রকারে সাফিয়্যা (রা.) স্বেচ্ছায় এমন এক ব্যক্তির সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইতে পারেন, যিনি তাঁহার স্বজনের এই পরিণতির জন্য দায়ী ছিলেন?
  2. ii) কোরআনে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধৃত নারীর অপেক্ষাকাল (ইদ্দাহ)—

 ﴿وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرَْبعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا﴾ 

(অর্থাৎ চার মাস ও দশ দিন) — পূর্ণ হইবার পূর্বেই নবী (সা.) তাঁহার সহিত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই তথ্যটি ব্যবহার করিয়া অভিযোগ তোলা হয় যে, নবী (সা.) স্বয়ং সেই আইন লঙ্ঘন করিয়াছেন, যাহা তিনি নিজেই প্রচার করিয়াছিলেন।

এই সমালোচনাগুলি প্রায়শই এমন সব তথ্যকে সচেতনভাবে উপেক্ষা করিয়া প্রণীত হয়, যাহা বিদ্বেষপ্রসূত প্রচারণার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য—প্রতিবেদিত তথ্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা, সেই তথ্যের আলোকে প্রকৃত চিত্র তুলিয়া ধরা এবং প্রাসঙ্গিক বিবরণসমূহ সতর্কতার সহিত উদঘাটন করত: অনিরীক্ষিত সংশয় ও সমালোচনার যৌক্তিক নিরসন করা।

২. সাফিয়্যা (রা.) কে ছিলেন?

২.১ তাঁহার নাম

প্রচলিত কতিপয় ধারণার বিপরীতে, তিনি নবী (সা.)-এর সহিত বিবাহের পূর্বেও সাফিয়্যা নামেই পরিচিত ছিলেন। এমন ধারণা যে, তাঁহার পূর্বনাম ছিল জয়নব এবং নবী (সা.) খায়বারের বন্দীদের মধ্য হইতে তাঁহাকে বাছাই (ইস্তফা) করার কারণে তাঁহার নাম পরিবর্তন করিয়া সাফিয়্যা রাখা হইয়াছিল—তাহার কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি পরিদৃষ্ট হয় না। খায়বার অভিযানের ঘটনাবলীতে তাঁহার নাম সাফিয়্যা বলিয়াই উল্লিখিত রহিয়াছে—যাহা পরবর্তীকালের পরিবর্তনের প্রক্ষেপণ বলিয়া ধরিয়া লওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নাই।

অধিকন্তু, জয়নব এমন কোনো নাম ছিল না যাহা নবী (সা.) পরিবর্তন করিতেন—কারণ তাঁহার দুইজন স্ত্রী এবং একজন কন্যার নামও ছিল জয়নব। তাঁহার নাম সাফিয়্যা হইবার পেছনে যুক্তি যে, এটি “সাফি” (الصفي) হইতে উদ্ভূত— অর্থাৎ নবী (সা.) তাঁহাকে বন্দীদের মধ্য হইতে বিশেষভাবে বাছিয়া লইয়াছিলেন—এই ধারণাটি সাধারণত নিম্নোক্ত বর্ণনার ওপর ভিত্তি করিয়া দাঁড় করানো হয়:

عن عائشة، قالت: «كانت صفية من الصفي»

ইহার প্রচলিত অনুবাদ করা হয়—

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন: সাফিয়্যা ‘সাফি’ হইতে নামকরণ হইয়াছিলেন—যাহা নবী (সা.)-এর বিশেষ অংশ (বাছিয়া লওয়া বন্দী)।

কিন্তু ইহা কোনো নিশ্চিত অনুবাদ নহে—বিশেষত আমরা ইতিপূর্বে লক্ষ্য করিয়াছি যে, নবী (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে আসিবার পূর্বেই তাঁহার নাম ছিল সাফিয়্যা। অধিকতর যুক্তিযুক্ত অনুবাদ হইবে—

সাফিয়্যা ছিলেন ‘আস-সাফি’-এর অন্তর্ভুক্ত।

এবং আশ-শা‘বি ‘আস-সাফি’ শব্দটির ব্যাখ্যা করিতে গিয়া বলেন—

كان للنبي صلى الله عليه وسلم سهم يدعى الصفي، إن شاء عبدا، وإن شاء أمة، وإن شاء فرسا يختاره قبل الخمس

নবী (সা.)-এর জন্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদের একটি বিশেষ অংশ নির্ধারিত থাকিত, যাহাকে বলা হইত ‘আস-সাফি’। তিনি ইচ্ছা করিলে সেই অংশ হইতে কোনো পুরুষ দাস, নারী দাসী অথবা অশ্ব নিজের জন্য নির্বাচন করিতেন—এবং তাহা খুমুস (অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা) লওয়ার পূর্বেই। অতএব, প্রতীয়মান হয় যে, যুদ্ধলব্ধ সম্পদে নবী (সা.)-এর বিশেষ অংশ নির্দেশকারী শব্দ ‘সাফি’ এবং সাফিয়্যা নামের মধ্যে সাদৃশ্যটি নিছকই কাকতালীয়।

২.২ তাঁহার ইহুদি পরিবার

সাফিয়্যা (রা.)-এর পিতা হুয়াইয়্য বিন আখতাব ছিলেন বনু নাদীর নামক ইহুদি গোত্রের প্রধান; মদিনার সনদ ভঙ্গের অপরাধে এই গোত্রকে নির্বাসিত করা হইয়াছিল। খন্দকের যুদ্ধের পর হুয়াইয়্য বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতায় উস্কানি দেন এবং পরবর্তীতে কুরাইজা গোত্রের সদস্যদের সহিত তিনিও নিহত হন। তাঁহার মাতা বাররা বিন্ত সামওয়ালও ছিলেন কুরাইজা গোত্রভুক্ত। প্রথমদিকে সাফিয়্যা (রা.) বিবাহ করিয়াছিলেন কুরাইজা গোত্রের সাল্লাম বিন মিশকামকে; পরে তাঁহাদের বিচ্ছেদ ঘটে এবং তিনি বনু নাদীর-এর কিনানা বিন আবি আল-হাকীককে বিবাহ করেন।

যদিও তাঁহার পিতা ও দ্বিতীয় স্বামী নিহত হইয়াছিলেন, তথাপি সাফিয়্যা (রা.)-এর ইহুদি আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজন বিদ্যমান ছিলেন, যাঁহাদের সহিত ইসলাম গ্রহণের পরেও তাঁহার সুসম্পর্ক অটুট ছিল। বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁহার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ তাঁহার এক ভাতিজার নামে বৈধ উইল করিয়াছিলেন—যিনি তখনও ইহুদি ছিলেন। আরেক ইহুদি আত্মীয়ের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা উল্লেখ করা হয়, যাহা ঘটে তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই।

তদ্রূপ, এক পরিচারিকা যখন তাঁহার ইহুদি স্বজনদের প্রতি ইতিবাচক অনুভূতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস পায়, তখন তিনি অকপটে স্বীয় রক্তের সম্পর্কের মর্যাদা তুলিয়া ধরিয়াছিলেন বলিয়াও উল্লেখ রহিয়াছে।

৩. নবী (সা.)-এর সঙ্গে সাফিয়্যা (রা.)-এর বিবাহ

৩.১ নবী (সা.)-এর দিহয়া (রা.) হইতে তাঁহাকে গ্রহণ করা

সহীহ আল-বুখারীতে খায়বার অভিযানের দীর্ঘ এক বর্ণনায় বলা হইয়াছে:

عن أنس بن مالك، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم غزا خيبر،فأصبناها عنوة، فجمع السبي، فجاء دحية الكلبي رضي الله عنه، فقال: يا نبي الله، أعطني جارية من السبي، قال: «اذهب فخذ جارية»، فأخذ صفية بنت حيي، فجاء رجل إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال: يا نبي الله، أعطيت دحية صفية بنت حيي، سيدة قريظة والنضير، لا تصلح إلا لك، قال: «ادعوه بها» فجاء بها، فلما نظر إليها النبي صلى الله عليه وسلم قال: «خذ جارية من السبي غيرها»، قال: فأعتقها النبي صلى الله عليه وسلم وتزوجها،

আনাস ইবন মালিক (রা.) হইতে বর্ণিত: আল্লাহর রাসূল (সা.) খায়বার অভিযান পরিচালনা করিলেন … আমরা খায়বার জয় করিলাম, বন্দীদের আটক করিলাম এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সমবেত করা হইল। দিহ্যাহ আল-কালবী (রা.) আগমন করিলেন এবং আরজ করিলেন, “হে আল্লাহর নবী! বন্দীদের মধ্য হইতে আমাকে একটি দাসী দিন।” নবী (সা.) বলিলেন, “যাও, যে কোনো দাসী লইয়া লও।” তিনি সাফিয়্যা বিন্ত হুয়াইয়্যকে লইয়া লইলেন।

এই সময় এক ব্যক্তি আসিয়া নবী (সা.)-কে বলিলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সাফিয়্যা বিন্ত হুয়াইয়্যকে দিহ্যাহকে দিয়াছেন, অথচ তিনি কুরাইজা ও নাদীর গোত্রের প্রধানা নারী—তিনি কেবল আপনার জন্যই শোভনীয়, অন্য কাহারও জন্য নহেন।” তখন নবী (সা.) বলিলেন, “তাহাকে (দিহ্যাহ) ও সাফিয়্যাকে লইয়া আসো।” দিহ্যাহ তাঁহাকে লইয়া আসিলে নবী (সা.) তাঁহাকে দেখিয়া বলিলেন, “বন্দীদের মধ্য হইতে অন্য কাহাকেও লইয়া লও।”

অতঃপর—বর্ণনাকারী বলেন—নবী (সা.) সাফিয়্যা (রা.)-কে মুক্তি প্রদান করেন এবং তাঁহাকে বিবাহ করেন।

৩.২ সাফিয়্যা (রা.)-কে কি স্বাধীনতার বিনিময়ে বিবাহে বাধ্য করা হইয়াছিল?

নবী (সা.) তাঁহাকে বন্দিনী হিসেবে গ্রহণ করেন, তাঁহার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেন এবং পরে তাঁহাকে বিবাহ করেন—এই তথ্যের উপর নির্ভর করিয়া অনেকে এই ধারণা পোষণ করিয়াছেন যে, সাফিয়্যা (রা.) যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই পরিণয়ে সম্মতি প্রদানে বাধ্য হইয়াছিলেন। আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়—স্বাধীনভাবে বাঁচিতে চাহিলে তাঁহার সম্মুখে নবী (সা.)-কে বিবাহ করা ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু প্রাপ্ত বর্ণনাসমূহ প্রমাণ করে—এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

দিহ্যাহ (রা.)-এর নিকট হইতে তাঁহাকে গ্রহণ করিবার পর নবী (সা.) যে প্রস্তাব দিয়াছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের নিকট সংরক্ষিত রহিয়াছে।

জাফর ইবন মাহমুদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন মাসলামা-এর বর্ণনা, যাহা আল-ওয়াকিদীর সূত্রে আসিয়াছে, এই প্রসঙ্গে সর্বাধিক বিস্তৃত দলিল উপস্থাপন করে:

যখন সাফিয়্যা (রা.) নবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন, তিনি তাঁহাকে বলিলেন: “তোমার পিতা আমার প্রতি শত্রুতা প্রদর্শনে কদাপি বিরত থাকে নাই, পরিশেষে আল্লাহ তাহাকে ধ্বংস করিয়াছেন।”

সাফিয়্যা (রা.) আরজ করিলেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তাঁহার পবিত্র কিতাবে বলিয়াছেন— ﴿وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ﴾ অর্থাৎ, ‘কেহ অন্য কাহারও বোঝা বহন করিবে না।’”

তখন নবী (সা.) তাঁহাকে বলিলেন: “তুমি স্বয়ং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো। যদি ইসলাম কবুল করো, তবে আমি তোমাকে আমার (স্ত্রী) রূপে গ্রহণ করিব; আর যদি স্বীয় ইহুদি ধর্মেই স্থির থাকো, তবে আমি তোমাকে মুক্ত করিয়া তোমার স্বজনদের নিকট প্রেরণ করিব।”

সাফিয়্যা (রা.) বলিলেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার আমন্ত্রণ শুনিবার পূর্বেই, আপনার নিকট আসিবার মুহূর্ত হইতেই আমার হৃদয় ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছে এবং আমি আপনাকে সত্য বলিয়া প্রত্যয় করিয়াছি। ইহুদি ধর্মের প্রতি আমার আর কোনো আকর্ষণ অবশিষ্ট নাই—সেখানে আমার কোনো অভিভাবক, পিতা বা ভ্রাতাও কেহ নাই।

আপনি আমাকে কুফর ও ইসলামের মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইবার সুযোগ দিয়াছেন। বস্তুত, স্বাধীনতা লাভ করিয়া স্বগোত্রে ফিরিয়া যাইবার অপেক্ষা আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলই আমার নিকট অধিকতর প্রিয়।”

এই বিষয়টি আনাস ইবন মালিক (রা.)-এর একটি প্রতিবেদনেও সমর্থিত হইয়াছে, যেখানে হাজ্জাজ ইবন ‘ইলাত খাইবার অভিযানের সংবাদ নবী (সা.)-এর চাচা আল-‘আব্বাসের কাছে পৌঁছাইয়া দেন:

واصطفى رسول الله صلى الله عليه وسلم صفية ابنة حيي فأخذها لنفسه، وخيرها بين أن يعتقها وتكون زوجه، أو تلحق بأهلها، فاختارت أن يعتقها وتكون زوجه

“রাসূলুল্লাহ (সা.) হুয়াইয়্যের কন্যা সাফিয়্যাকে স্বীয় তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করেন এবং তাঁহাকে দুইটি বিকল্প প্রদান করেন—

  • স্বাধীনতা লাভ করিয়া তাঁহাকে (সা.) বিবাহ করা, অথবা
  • নিজের পরিবারে ফিরিয়া যাওয়া;

কিন্তু তিনি স্বাধীনতা প্রাপ্ত হইয়া নবী (সা.)-এর সহধর্মিণী হওয়াকেই বাছিয়া লন।”

এই দুইটি বর্ণনা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, সাফিয়্যা (রা.)-কে দাসত্ব হইতে রক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নবী (সা.)-কে বিবাহ করিতে হয় নাই; বরং তাঁহাকে তাঁহার ইহুদি পরিবারের নিকট ফিরিয়া যাইবারও পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে নবী (সা.)-এর সঙ্গকেই বাছিয়া লইয়াছেন—স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

৩.৩ নবী (সা.)-এর প্রতি সাফিয়্যার অনুভূতি এবং তাঁহার পিতার প্রতি মনোভাব

পূর্বোক্ত জাফর ইবন মাহমুদের বর্ণনায় যেমনটি পরিদৃষ্ট হয়—নবী (সা.) সাফিয়্যা (রা.)-কে স্মরণ করাইয়া দেন যে, তাঁহার পিতা (হুয়াইয়্য) কী প্রকারে সর্বদা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়া গিয়াছেন এবং তাহারই পরিণতিতে তিনি তাঁহার কর্মফল ভোগ করিয়াছেন—এই বিষয়টি সাফিয়্যা (রা.)-ও উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।

এ প্রসঙ্গে ইবন ‘উমর (রা.)-এর বর্ণনায় আসিয়াছে:

كان بعين صفية رضي الله عنها خضرة فقال لها رسول الله صلى الله عليه وسلم: «ما هذه الخضرة بعينك؟» فقالت: قلت لزوجي إني رأيت فيما يرى النائم قمرا وقع في حجري فلطمني وقال: تريدين ملك يثرب. قالت: فما كان أبغض إلي من رسول الله صلى الله عليه وسلم قتل أبي وزوجي، فما زال يعتذر إلي ويقول: «يا صفية إن أباك ألب علي العرب وفعل وفعل» حتى ذهب ذاك من نفسي

সাফিয়্যা (রা.)-এর চোখে একটি সবুজ দাগ ছিল। নবী (সা.) তাঁহাকে জিজ্ঞেস করিলেন: “তোমার চোখে এই দাগটি কিসের?” তিনি বলিলেন: “আমি স্বপ্নে দেখিলাম, একটি চন্দ্র আমার ক্রোড়ে পতিত হইয়াছে। আমি স্বামীকে তাহা বলতেই সে আমাকে চড় মারিয়া বলিল: ‘তুমি কি ইয়াসরিবের (মদিনার) রাজাকে চাও?’

সেই সময় নবী (সা.)-এর প্রতি আমার অন্তরে তীব্র বিদ্বেষ ছিল—কেননা তিনি আমার পিতা ও স্বামীকে হত্যা করিয়াছিলেন। তবে নবী (সা.) বারবার আমার নিকট ব্যাখ্যা করিতে থাকিলেন: ‘হে সাফিয়্যা! তোমার পিতাই আরবদিগকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়াছে এবং এই এই ষড়যন্ত্র করিয়াছে।’ এইরূপে তিনি আমাকে বুঝাইতে থাকিলেন, যতক্ষণ না আমার অন্তর হইতে সমস্ত বিদ্বেষ দূরীভূত হইয়া গেল।” আবু আল-শাইখ (মৃ. ৩৬৯ হি./৯৭৯ খ্রি.) তাঁহার গ্রন্থ ‘আদাবুন নবী ওয়া আদাবুহু’-তে এই বর্ণনাটিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করিয়াছেন।

৩.৪ বৈবাহিক শিবিরে প্রহরী থাকিবার কারণ কী ছিল?

নবী (সা.) ও সাফিয়্যা (রা.)-এর মধ্যে বৈবাহিক শিবিরে যে আন্তরিক আলোচনার মুহূর্ত ছিল, সে সম্পর্কে অবগত না থাকায় সাহাবিদের মধ্যে অন্যতম—আবু আইয়ুব (রা.)—তাঁহাদের খিমার (তাঁবুর) বাহিরে কোষমুক্ত তরবারি হস্তে পাহারায় দণ্ডায়মান ছিলেন।

পরদিন সকালবেলা নবী (সা.) তাঁহাকে তাহার অবস্থানের কারণ জিজ্ঞেস করিলে তিনি বলিলেন—একটি মেয়ে, যাহার নিকটতম আত্মীয়দের যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করা হইয়াছে, তিনি হয়তো নবী (সা.)-এর কোনো অনিষ্ট করিতে পারেন—এই আশঙ্কা হইতেই তিনি প্রহরায় দণ্ডায়মান ছিলেন।

নবী (সা.) তখন হাসিলেন এবং তাঁহার এই সতর্কতাপূর্ণ আচরণের প্রশংসা করিলেন।

ইহা স্পষ্ট—আবু আইয়ুব (রা.) স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাহারা দিয়াছিলেন এবং নবী (সা.) এ বিষয়ে কিছুই জানিতেন না। বস্তুত, তাঁহার আশঙ্কা যে ভিত্তিহীন ছিল—পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহেই তাহা প্রমাণিত হইয়াছে।

৩.৫ নবী (সা.) সম্পর্কে সাফিয়্যার পূর্বধারণা

সাফিয়্যা (রা.)-এর নবী (সা.)-কে লইয়া পূর্ব ধারণা কেবল সেই স্বপ্ন-অভিজ্ঞতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, যাহা তিনি নবীর (সা.) নিকট নিবেদন করিয়াছিলেন। বরং তিনি তাঁহার বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখেও শুনিয়াছিলেন যে, মুহাম্মদ (সা.)-ই সেই প্রতীক্ষিত নবী—যাঁহার আগমনের সুসংবাদ তাঁহাদের আদি ধর্মগ্রন্থসমূহে উল্লিখিত রহিয়াছে। তিনি স্মরণ করিয়া বলেন:

كنت أحب ولد أبي إليه، وإلى عمي أبي ياسر، لم ألقهما قط مع ولد لهما إلا أخذاني دونه. قالت: فلما قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم المدينة، ونزل قباء، في بني عمرو بن عوف، غدا عليه أبي، حيي بن أخطب، وعمي أبو ياسر بن أخطب، مغلسين. قالت: فلم يرجعا حتى كانا مع غروب الشمس. قالت: فأتيا كالين كسلانين ساقطين يمشيان الهوينى. قالت: فهششت إليهما كما كنت أصنع، فو الله ما التفت إلي واحد منهما، مع ما بهما من الغم. قالت: وسمعت عمي أبا ياسر، وهو يقول لأبي حيي بن أخطب: أهو هو؟ قال: نعم والله، قال: أتعرفه وتثبته؟ قال: نعم، قال: فما في نفسك منه؟ قال: عداوته والله ما بقيت.

“আমি আমার পিতা ও চাচা আবু ইয়াসিরের সর্বাধিক স্নেহধন্যা কন্যা ছিলাম। যখনই আমি উপস্থিত থাকিতাম, তাঁহারা নিজেদের অন্য সন্তানদের তোয়াক্কা করিতেন না।

যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) মদীনায় আগমন করিয়া বনি ‘আমর ইবন ‘আউফ-এর মধ্যে কুবায় অবস্থান করিতেছিলেন—আমার বাবা হুয়াইয়্য ইবন আখতাব ও চাচা আবু ইয়াসির ইবন আখতাব তখন ভোরের পূর্বেই তাঁহার নিকট গেলেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত আর ফিরিয়া আসিলেন না।

অবশেষে তাঁহারা ক্লান্ত, অবসন্ন ও বিষণ্ণ অবস্থায় ফিরিয়া আসিলেন—পদক্ষেপ ধীর, শরীর নিস্তেজ। আমি যেমন সবসময়ই করিতাম, আনন্দে তাঁহাদের দিকে ধাবিত হইলাম; কিন্তু আল্লাহর কসম! তাঁহারা আমার দিকে ফিরিয়াও তাকাইলেন না—উভয়েই যেন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত।

আমি চাচাকে বলিতে শুনিলাম: ‘উনি কি-ই তিনি?’ বাবা বলিলেন: ‘হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, তিনিই!’ চাচা বলিলেন: ‘আপনি কি তাঁহাকে চেনেন এবং নিশ্চিত?’ বাবা বলিলেন: ‘হ্যাঁ!’ চাচা বলিলেন: ‘তাঁহার বিষয়ে আপনার মনঃস্থির কী?’ বাবা উত্তর দিলেন: ‘আল্লাহর শপথ! আমি যাবজ্জীবন তাঁহার শত্রুতাই করিয়া যাইব।’”

এইরূপ স্মৃতি ও উপলব্ধি হইতে একজন ন্যায়নিষ্ঠ ও প্রজ্ঞাবান মানুষের পক্ষে ইহা অনুধাবন করা কঠিন ছিল না যে, নবী মুহাম্মদ (সা.) এমন ব্যক্তি নন—যাঁহাকে ঘৃণা করিতে হইবে; বরং তাঁহার প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য ও অনুসরণই প্রকৃত নাজাতের (মুক্তির) পথ। সাফিয়্যা (রা.) প্রমাণ করিলেন—তিনি শুধু সৌভাগ্যবতীই নন, বরং সত্যের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ও উদারচিত্তও ছিলেন।

৪. ইদ্দত (প্রতীক্ষাকাল) সম্পর্কিত বিধান কি লঙ্ঘিত হইয়াছিল?

সমালোচকগণ অভিযোগ করেন—কুরআনের বিধান অনুযায়ী, যে নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করে, তাহার পুনর্বিবাহের জন্য চার মাস দশ দিন অপেক্ষার (ইদ্দত) বিধান রহিয়াছে, অথচ সাফিয়্যা (রা.)-এর ক্ষেত্রে দেখা যায়—তাঁহার স্বামীর মৃত্যুর অল্প সময় পরেই নবী (সা.) তাঁহাকে বিবাহ করেন। ফলত, এই অভিযোগ উত্থাপিত হয় যে, নবী (সা.) স্বয়ং স্বপ্রদত্ত বিধান লঙ্ঘন করিয়াছেন।

কিন্তু প্রকৃত সত্য ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত।

ইদ্দতের বিধান কেবল তখনই প্রযোজ্য হয়, যখন পূর্ববর্তী বিবাহ ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বলিয়া গণ্য থাকে।

কিন্তু সাফিয়্যা (রা.) যুদ্ধবিজয়ের পর বন্দি (সাবি) হিসেবে মুসলমানদের অধিকারে আসিয়াছিলেন; তাঁহার স্বামী কিনানা যুদ্ধে নিহত হয়। এমনকি সে যদি মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা পাইত এবং বন্দিও না হইত—তথাপি ইসলামি বিধি মোতাবেক তাঁহার পূর্বতন বিবাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচ্ছিন্ন্ন বলিয়া পরিগণিত হইত।

এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধান ‘ইদ্দত’ নহে, বরং তাহা ছিল ‘ইস্তিবরা’।

‘ইস্তিবরা’ অর্থ—নারীর জরায়ু যে গর্ভশূন্য, তাহার নিশ্চিতি। সাধারণত একটি হায়েয (ঋতুচক্র) সম্পন্ন হইলেই ইহার প্রমাণ মেলে—এবং স্বীকৃত বর্ণনায় আছে, সাফিয়্যা (রা.)-এর ক্ষেত্রেও এই নিয়ম যথাযথভাবে পালিত হইয়াছিল।

عن أنس بن مالك رضي الله عنه،فاصطفاها النبي صلى الله عليه وسلم لنفسه، فخرج بها حتى بلغنا سد الصهباء حلت، فبنى بها رسول الله صلى الله عليه وسلم

আনাস ইবন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন: “…অতঃপর নবী (সা.) সাফিয়্যাকে নিজের জন্য নির্বাচিত করেন এবং তাঁহাকে লইয়া রওনা হন। যখন আমরা সাদ্দুস-সাহবা’ নামক স্থানে উপস্থিত হইলাম, তখন সাফিয়্যা (রা.) পবিত্র হইলেন (অর্থাৎ, তাঁহার হায়েয সম্পন্ন হইল) এবং তখনই রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁহার সহিত বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করিলেন।”

আরেকটি বর্ণনায় এটি আরও স্পষ্টভাবে বিবৃত হইয়াছে:

عن أنس أن رسول الله صلى الله عليه وسلم استبرأ صفية بحيضة

আনাস (রা.) বর্ণনা করেন: “রাসূলুল্লাহ (সা.) সাফিয়্যা (রা.)-এর জরায়ু পবিত্র (গর্ভশূন্য) কি না, তাহা একটি হায়েয (মাসিক) দ্বারা নিশ্চিত করিয়া লইয়াছিলেন।”

ইহা কোনও ব্যতিক্রমধর্মী সিদ্ধান্ত ছিল না। একই বিধান রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যান্য অনুরূপ পরিস্থিতিতেও ঘোষণা করিয়াছিলেন। আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন:

عن أبي سعيد الخدريورفعهأنه قال في سبايا أوطاس: “لا توطأ حامل حتى تضع، ولا غير ذات حمل حتى تحيض حيضة

আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি এই উক্তিটি সম্বন্ধিত করেন যে— “ওতাস যুদ্ধের যুদ্ধবন্দিনী (সাবি) নারীদের প্রসঙ্গে নবী (সা.) নির্দেশ দিয়াছেন: গর্ভবতী স্ত্রীর সহিত সম্পর্ক স্থাপন করা যাইবে না—যতক্ষণ না সে সন্তান প্রসব করে; আর অগর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে—যতক্ষণ না সে একবার মাসিক সম্পন্ন করে।”

(রুয়াইফা’ ইবন সাবিত আল-আনসারী রাঃ) হইতে বর্ণিত: তিনি আমাদের মাঝে খুতবা প্রদান করিয়া বলিলেন:

“আমি তোমাদিগকে কেবল সেই কথাই বলিব, যাহা আমি রাসূলুল্লাহ –কে হুনাইন যুদ্ধের দিবসে বলিতে শুনিয়াছি কোনো ব্যক্তি, যে আল্লাহ ও পরকালীন দিবসে বিশ্বাস রাখে—তাহার জন্য যুদ্ধবন্দিনী কোনো নারীর সহিত সহবাস করা বৈধ নহে, যতক্ষণ না তাহার জরায়ুর পবিত্রতা (অর্থাৎ, একটি মাসিক সম্পন্ন হওয়া) নিশ্চিত হয়।”

অতএব, পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত ‘ইদ্দাহ’ (প্রতীক্ষাকাল)-এর বিধান সেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নহে, যেখানে পূর্বের বিবাহ-সম্পর্ক ইসলামী আইনে বৈধ বলিয়া গণ্য নয় এবং যেখানে আনুষ্ঠানিক দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল না।

এই বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করিতে গিয়া প্রসিদ্ধ হানাফি ফকীহ ইমাম আল-জাসসাস (মৃত্যু: ৩৭০ হি./৯৮০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখ করিয়াছেন, যুদ্ধবন্দিনী নারীদের পূর্ববর্তী বিবাহ-সম্পর্ক বাতিল হইয়া যায়; ফলে সেখানে ‘ইদ্দাহ’র বিধান আর প্রযোজ্য হয় না। বরং তাহাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় ‘ইস্তিবরাআ’, যাহার উদ্দেশ্য হইল— জরায়ু শূন্য কি না তাহা নিশ্চিত করা, যাহাতে বংশমিশ্রণজনিত কোনো বিভ্রান্তি দেখা না দেয়।

আল-জাস্‌সাস (মৃ. ৩৭০/৯৮০)-এর বর্ণনা:

ليس بين فقهاء الأمصار خلاف في وجوب استبراء المسبية على ما ذكرنا إلا أن الحسن بن صالح قال عليها العدة حيضتين إذا كان لها زوج في دار الحرب وقد ثبت بحديث أبى سعيد الذي ذكرنا الاستبراء بحيضة واحدة وليس هذا الاستبراء بعدة لأنها لو كانت عدة لفرق النبي صلى الله عليه وسلم بين ذوات الأزواج منهن وبين من ليس لها زوج لأن العدة لا تجب إلا عن فراش فلما سوى النبي صلى الله عليه وسلم بين من كان لها فراش وبين من لم يكن لها فراش دل ذلك على أن هذه الحيضة ليست بعدة فإن قيل قد ذكر في حديث أبي سعيد الذي ذكرت إذا انقضت عدتهن فجعل ذلك عدة قيل له يجوز أن تكون هذه اللفظة من كلام الراوي تأويلا منه للاستبراء أنه عدة وجائز أن تكون العدة لما كان أصلها استبراء الرحم أجري اسم العدة على الاستبراء على وجه المجاز

বিভিন্ন অঞ্চলের ফকীহগণের মধ্যে এই বিষয়ে কোনো মতভেদ নাই যে, যুদ্ধবন্দিনী নারীর ক্ষেত্রে (সহবাসের পূর্বে) তাহার জরায়ু মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা (ইস্তিবরা) স্বরূপ এক মাসিক চক্র অতিক্রান্ত হওয়া আবশ্যিক। তবে আল-হাসান ইবন সালিহ ব্যতিক্রমীভাবে এই মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, যদি ঐ নারী যুদ্ধের পূর্বে স্বামীযুক্ত হইয়া থাকে, তবে তাহার দুইটি মাসিক চক্র অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু পূর্বোক্ত আবু সাঈদ আল-খুদরীর হাদিস দ্বারা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, একটি মাসিক চক্র-ই এখানে যথেষ্ট। আর এইরূপ মাসিকচক্র অতিক্রম করাকে প্রকৃত ‘ইদ্দাহ’ বলা যাইবে না। কারণ যদি এটি প্রকৃত ‘ইদ্দাহ’ হইত, তবে নবী নিশ্চিতভাবেই স্বামীযুক্ত নারীদের সহিত স্বামীহীন নারীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন নির্দেশনা দিতেন। কেননা ‘ইদ্দাহ’ মূলত একটি স্বীকৃত বৈবাহিক সম্পর্কের (حقّ الفراش) পরিপ্রেক্ষিতেই ওয়াজিব হয়।

যেহেতু নবী উভয় শ্রেণির (স্বামীযুক্ত ও স্বামীহীন) নারীর ক্ষেত্রেই সমবিধান দিয়াছেন, সেহেতু ইহা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, এখানে কেবল জরায়ু মুক্ত থাকার নিশ্চয়তাই উদ্দেশ্য, যাহা ‘ইদ্দাহ’-এর প্রকৃত বিধান নহে।

যদি কেহ আপত্তি উত্থাপন করেন যে, কিছু বর্ণনায় আবু সাঈদ-এর হাদিসে “ইদ্দাহ পূর্ণ হইলে” (إذا انقضت عدتهن) কথাটি আসিয়াছে—এতে তো বোঝা যায় যে ইহাকে ‘ইদ্দাহ’ বলা হইয়াছে—তবে তাহার উত্তর হইবে:

এই শব্দটি সম্ভবত হাদিসের বর্ণনাকারীর নিজস্ব ব্যাখ্যামূলক সংযোজন; অর্থাৎ তিনি মাসিকচক্র অতিক্রম করাকে ‘ইদ্দাহ’-এর সমতুল্যভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। যেহেতু ‘ইদ্দাহ’-এর মৌলিক উদ্দেশ্যও জরায়ু মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা, সেই হেতু রূপক অর্থেই (مجازاً) এখানে ‘ইদ্দাহ’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।

পরিশেষে, সাফিয়্যা (রা.) সম্পর্কে যে বর্ণনায় আসিয়াছে— ﴿وَتَعْتَدُّ فِي بَيْتِهَا﴾ (অর্থাৎ, তিনি উম্মে সুলাইম (রা.)-এর গৃহে 'ইদ্দাহ' পালন করিয়াছিলেন)—ইহা যদি দৃষ্ট-সাক্ষ্যে প্রমাণিতও হয়, তবুও ইহার অর্থ হইবে:

তিনি সেখানে স্বীয় মাসিকচক্র সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করিয়াছিলেন, যাহা ঐ প্রবাদগত ব্যবহারেরই (রূপক অর্থে ‘ইদ্দাহ’ বলার) উদাহরণ।

৫. উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচিত তথ্যসমূহ সুস্পষ্টরূপে ইঙ্গিত করে যে, খায়বার অভিযানে মুসলিম বাহিনীর বিজয় ও তাহার পরবর্তী পরিস্থিতিতে সাফিয়্যা (রা.)-এর অন্তরে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি যে স্বাভাবিক বিদ্বেষের উদ্রেক হইয়াছিল, তাহা অতি দ্রুতই গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হয়।

তাঁহার শৈশবে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের নিকট হইতে গোপনে শ্রুত সেই স্বীকৃতি—‘নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত নবী’; খায়বার অভিযানের অব্যবহিত পূর্বে দৃষ্ট সেই অলৌকিক স্বপ্ন; এবং সর্বোপরি, স্বয়ং নবী (সা.)-এর পক্ষ হইতে প্রদর্শিত সম্মান, সৌজন্যবোধ ও অনুপম মানবিকতা—এই সকল কিছুই তাঁহার হৃদয়ের এই রূপান্তরে মৌলিক ভূমিকা পালন করে।

ফলত, তিনি স্বীয় ইহুদি স্বজনদের নিকট ফিরিয়া যাইবার পরিবর্তে স্বেচ্ছায় নবী (সা.)-এর সহধর্মিণী হিসাবে তাঁহার সন্নিধানে থাকিবার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেন। এবং এই বিবাহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তাঁহার মাসিকচক্র (ইস্তিবরা) সমাপ্ত হইবার পর, যাহা তৎকালীন পরিস্থিতিতে শরিয়তের সুস্বীকৃত ও আবশ্যিক নির্দেশনাই ছিল। সুতরাং, এই ঘটনাপ্রবাহে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আচরণের মধ্যে কোনো প্রকার অসংগতি, অনৈতিকতা বা শোভনতার লেশমাত্র ছিল—এমন প্রশ্ন উত্থাপনের কোনো অবকাশ নাই।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter