মহৎ চরিত্র (৩): নবীজীর ﷺ মানবসেবা
ইসলামের বৈশিষ্ট অন্যান্য দার্শনিক মতবাদের মতো সর্বজনীক ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ভুয়া হয়ে যায় না। প্রত্যেকটি শিক্ষা সর্বজ্ঞানী মহান স্রষ্টা আল্লাহ প্রদত্ত নীতিমালা এবং নির্দেশিকার উপর গঠিত। আল্লাহ তাআ’লা প্রেরিত সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) বাস্তব জীবনে সমস্ত কার্যকারিতা দেখিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও আদর্শ নমুনা রেখে গেছেন যাতে ঐশরিক রাস্তার পথিকরা বিভ্রান্ত না হয়ে পরে। বিশ্ব নবীর (ﷺ) জীবনাদর্শে অনুরুপ দেখা যায় সমাজসেবার অনন্য নমুনা যা বিশ্বের ইতিহাসে কোনো সমাজ বিজ্ঞানী বা সমাজসেবক কখনও দিতে পারেননি।
বর্তমান সমাজ থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং অন্যান্য দুর্নীতি দূর করতে ইসলাম প্রদর্শিত জীবন পদ্ধতিই হচ্ছে একমাত্র উপায়। মহা সমাজবিজ্ঞানী মুহাম্মদ (ﷺ) ন্যায় ও স্থিতিশীলতার উপর নির্মিত সমাজ ব্যাবস্থা প্রদান করেছেন। একটি আদর্শ সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ হল দরিদ্র, ধনী বা অন্য যে কোনও মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেককে অন্তর্ভুক্ত করা। নবী (ﷺ) এই মানবকেন্দ্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ ও প্রচার, যেহুতু এমন সমাজসেবা যেখানে মানুষের কোন মৌলিক অস্তিত্ব থাকেনা তা নিছক। অর্থাৎ, নবীজির (ﷺ) সমাজসেবা অবশ্যই মানবসেবার ওপর গঠিত।
একে ওপরের প্রতি
একটি সমাজ তখনই সুগঠিত হয় যখন পারস্পরিক সোহার্দ, সংহতি এবং সহকারিতা বিদ্যমান। নবী (ﷺ) সেই শিক্ষারই প্রয়োগ এবং প্রচার করেছেন। সর্বজনীন সমাজ নির্মাণে এই উম্মতের গুণমান আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন। (প্রবন্ধে ব্যাবহৃত হাদিস অনুবাদসমূহ বিভিন্ন ইন্টারনেট সূত্র থেকে গৃহীত)
তিনি বলেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিমের ওপর অবিচার করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না এবং অবজ্ঞা করবে না। আল্লাহভীতি এখানে!” এ কথা বলে তিনি (ﷺ) নিজের বক্ষের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করে বললেন: “একজন মানুষের জন্য এতটুকু অন্যায়ই যথেষ্ট যে, সে নিজের মুসলিম ভাইকে হেয় জ্ঞান করবে। মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান হারাম।” (মুসলিম)
এই সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের আরেকটি অনন্য উপস্থাপনা দেখতে পাওয়া যায় আবূ মূসা (রাঃ)-এর বর্ণনায় যা ইসলামী মূল্যবোধ ব্যতীত কোনো সমাজই কখনোই প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। নবীজির (ﷺ) বাক্য, “এক মু’মিন আর এক মু’মিনের জন্য ইমারত তুল্য, যার এক অংশ আর এক অংশকে সুদৃঢ় করে রাখে। (বুখারী) বর্ণনায় আরও আসে যে তিনি (ﷺ) তাঁর এক হাতের আঙ্গুল আর এক হাতের আঙ্গুলে প্রবেশ করে ইঙ্গিত করে দেখান। এই ভাতৃত্বের উদাহরণ আরেকটি বর্ণনায়, “তোমাদের কেউ প্রকৃত মু’মিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে।”
দরিদ্রের ক্ষেত্রে
বর্তমান সমাজ দিনের পর দিন অর্থনৈতিকভাবে অস্থির এবং ভারসাম্যহীন হয়ে পরছে। সহস্র সাংগঠনিক উদ্যোগ, সরকারি স্কিম সত্ত্বেও দরিদ্র আরও পদদলিত, বঞ্চিত শেষ বর্জিত। আসলে ভূল সমীকরণ অনুশীলন করে সমাধান অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সার্বজনীন সফলতার জন্য ঐশিরিক সূত্র প্রয়োজন যা নবী প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। বর্তমান বৈশিক সমস্যার সমাধান ইসলাম প্রদত্ত একমাত্র পথেই উপলব্ধ। ইসলামে অর্থনীতিক বন্টন বিভিন্ন ধরণে বিভক্ত, কোনটা বাধ্যতামূলক (যাকাত), কোনটা স্বেচ্ছায় (স্বাদকা)।
দারিদ্রতা নিবারণের সন্ধানে নবীজির (ﷺ) আদর্শ অন্নেষণ হোক। আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবী (ﷺ)-এর নিকট কোন ভিখারী অথবা অভাবগ্রস্ত লোক আসলে তিনি (ﷺ) বলতেন, “তোমরা সুপারিশ (সাহায্য) করো, তাহলে তোমরা সাওয়াব পাবে। অবশ্য আল্লাহ তাআলা তার রাসূলের দু’আ অনুযায়ী যা ইচ্ছা তা দেন।” (বুখারী)
প্রতিবেশীর নিকটে
আল্লাহ তাআ’লার কানুনের ওপর গঠিত, নবীর উদাহরণে পরিচালিত এই সর্বজনীনতার সমাজে প্রতিবেশী যে মান, মর্যাদা ও অধিকার পেয়েছে তা পৃথিবীর মনুষ্যসৃষ্ট সমগ্র নীতিতে ফাঁকা। যিনি পূর্ণতা হিসেবে প্রেরিত হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করে।” (মুসলিম) “যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (মুসলিম)
এগুলি অভিনবপূর্ণ বা কাল্পনিক বাণী নয়, বাস্তব প্রভাবের শক্তি। এই সার্বজনীন পথের পথিকরা অক্ষরে-আকারে মেনে, পালন করে দিখেয়িছে। পৃথিবীর ইতিহাস যেমন সাক্ষী আছে তেমনি বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও হবে।
শ্রমিকের স্বার্থে
সমাজের প্রত্যেকটি উপাদানে ইসলামের সহস্র সাক্ষর যা বিশ্বের কোনো মতবাদই প্রদান করতে পারেনি। শ্রম এবং শ্রমিকের স্বার্থে এমন নীতি নবী (ﷺ) শিক্ষা দিয়েছে যা বিশ্ব আজও উদযাপন করে। বিশ্ব শিক্ষকের আদেশ, “তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করে দাও।” (সুনানে ইবনে মাজাহ)
বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে নবীজি (ﷺ) নিজে শ্রমে যোগ দিয়েছেন। বাণিজ্যিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ইসলামের প্রথম মসজিদে নির্মাণে নিজ সহচর-শিষ্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে একটি বিশ্বমানের উদাহরন ও শ্রমিক-কেন্দ্রিক আদর্শ দেখিয়েছেন।
সার্বিক সূত্র
তওহীদ বা একেশ্বরবাদের মূল নীতির ওপর গঠিত ইসলাম মানুষকে সার্বজনীনভাবে ঐক্যের দিক নিয়ে আসে। ইসলামের পন্থা এমন যে ব্যাক্তিগত, সামাজিক এবং সার্বিক সকল উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণ হয়। শুক্রবার ৯ জুল-হিজ্জা ১০ হিজরীতে (মোতাবেক ৬ মার্চ ৬৩২) অজ্ঞতার অভিশাপ নির্মূলে বিলপ্তিকরণের পর দীর্ঘ ব্যাবহারিক অনুশীলনপ্রাপ্ত জনসাধারণ এবং নবীন অনুসারীদলের সামনে আরাফাহ থেকে বিশ্বনবী সর্বপ্রথম বিশ্বের পরিপূর্ণ মানবধিকার ঘোষণা করেন (সামান্য পরিবর্তনের সাথে এই ঐতিহাসিক ঘোষণার বিভিন্ন বর্ণনা আছে): হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো! আরবীর উপর অনারবীর এবং অনারবীর উপর আরবীর, কৃষ্ণকায়ের উপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের উপর কৃষ্ণকায়ের কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল ‘তাক্বওয়া’ বা ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতেই। (মুসনাদে আহমাদ)
পুরুষ-স্ত্রীর সমন্বয়ে এই ঐশরিক মানবকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক পন্থা রচিত। মহিলা কখনই বহিরাগত নয়। এটি সেই সময় যখন কন্যা জন্ম হলে অধিপতির ‘চেহারা কালো’ হয়ে যেত। । হুজ্জাতুল বিদা ঘোষণার আর একটি মৌলিক বিষয়বস্তু: যে রকম পুরুষের উপর তাদের স্ত্রীরির অধিকার রয়েছে, অনুরুপ স্ত্রীরির ওপর পুরুষের অধিকার আছে।
সমসাময়িক দাস-দাসী, এতিম-মিসকিন, যুদ্ধ-বন্দি প্রভৃতি ঝুঁকিপূর্ণ বিভাগ সম্পর্কে কথা অনেক, তবুও বাকি থাকলো। আবার হিংসা, মিথ্যা, পরচর্চা, অত্যাচার, বৈষম্য ইত্যাদি ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রান পথ প্রদান করেছেন যা সমাজসেবার মধ্যে দুর্নীতির জোয়ার নিয়ে আসে। ইসলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন বিধান প্রদান করেশুধু সমাজ নয়, মানুষ নয়; রাসূলের (ﷺ) চারিত্রিক আদর্শ মানবতার সেবা! আর মহা নবী (ﷺ) আঁকায়িত মনোবরেখার গন্ডিবৃত্ত কত প্রসারিত তা স্পষ্ট, অতুলনীয়।