মোরো সংঘাত: ফিলিপাইনের মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম

ভূমিকা :

বিশ্বজুড়ে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীগুলোর যে সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে, তার মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রায় অবহেলিত অধ্যায় হলো ফিলিপাইনের মোরো সংঘাত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপদেশ ফিলিপাইনে বসবাসরত মুসলিম জাতিগোষ্ঠী ‘মোরো’ নিজেদের স্বতন্ত্র ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় নিয়ে টিকে থাকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে যে সশস্ত্র ও রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তা শুধু একটি জাতিগত বিদ্রোহ নয়; বরং এটি একটি ইসলামী আত্মপরিচয় ও অধিকার রক্ষার জন্য সংগঠিত ন্যায়সঙ্গত জিহাদ।

ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ :

মোরো জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ইসলাম আগমনের সময়ে। ১৩শ-১৪শ শতকে মালয় দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম আগমন ঘটে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে “সুলু, মাগুইন্দানাও”,“বাসিলান” অঞ্চলে। এখানে ইসলাম ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “সুলু সুলতানাত ও মাগুইন্দানাও সুলতানাত”। এই অঞ্চলের মানুষ আরবি ও স্থানীয় ভাষার মিশ্রণে গড়ে তোলা ইসলামিক শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষিত হতেন এবং শরিয়া আইনের আওতায় জীবন যাপন করতেন।

তবে ১৫৬৫ সালে স্পেনীয়দের উপনিবেশ স্থাপন এবং তাদের ক্যাথলিক মিশনারি কার্যক্রম শুরু হলে দক্ষিণ ফিলিপাইনের মুসলিম সমাজ একটি নব্য দখলদারিত্বের মুখে পড়ে। পরবর্তী ৩৩০ বছর ধরে স্পেনিয়রা চেষ্টা করে এই মুসলিম অঞ্চলগুলো দখল করতে, কিন্তু তারা কখনোই পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। মুসলিম জনগণ বারবার প্রতিরোধ গড়ে তোলে, এবং ইসলামের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল এই প্রতিরোধের প্রেরণা।

“স্পেনের পতনের পর আমেরিকান ও পরে স্বাধীন ফিলিপাইন রাষ্ট্রের শাসনেও মুসলিম জনগণের এই প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে” ফিলিপাইনের রাষ্ট্র কাঠামোতে মোরো জনগণের কোনো স্থান ছিল না। তারা বারবার ভূমি, সম্পদ, রাজনৈতিক অধিকার, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

জমি হারানোর ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক নিপীড়ন :

১৯৩৫ সালের "Resettlement Policy" অনুসারে, মিন্দানাও অঞ্চলে উত্তর ফিলিপাইনের খ্রিস্টান জনগণকে পুনর্বাসন দেওয়া শুরু হয়। ফলে মুসলিমরা তাদের পূর্বপুরুষদের জমি হারায়। অল্প কিছু দশকের মধ্যেই মুসলমানরা তাদের নিজ ভূমিতেই সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই খ্রিস্টান আধিপত্য গড়ে ওঠে।

ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সীমিত করে দেয়া হয়, শরিয়া আদালতের ক্ষমতা খর্ব করা হয়, এবং ইসলামিক সংস্কৃতিকে প্রকাশ্যে পালন করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকে মোরো মুসলিমরা কেবল বৈষম্য নয়, বরং "অস্তিত্ব সংকট"  (existencial crisis) হিসেবে দেখেছে।

সংগ্রামের রূপ ও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া :

এই অবস্থা থেকেই ১৯৭০-এর দশকে শুরু হয় সুসংগঠিত সশস্ত্র প্রতিরোধ। প্রথমে গঠিত হয় Muslim Independence Movement (MIM), পরে তা রূপান্তরিত হয় Moro National Liberation Front (MNLF)-এ। এর নেতৃত্বে ছিলেন নুর মিসুয়ারি, যিনি ফিলিপাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন এবং প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ছিলেন।

MNLF শুরুতে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই চালায়। পরবর্তীতে কিছুটা সমঝোতার পথ ধরে তারা ১৯৯৬ সালে ফিলিপাইন সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি করে এবং “স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম অঞ্চল ARMMগঠিত হয়। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান এই চুক্তিতে সন্তুষ্ট ছিল না, কারণ এটি শরিয়া ভিত্তিক বা পূর্ণ ইসলামিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়নি।

এ থেকেই জন্ম হয় Moro Islamic Liberation Front (MILF)-এর, যাদের লক্ষ্য ছিল ইসলামিক শরিয়া ভিত্তিক একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠন। তারা রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী সংগঠন এবং জনগণের মাঝে বেশি জনপ্রিয়তা পায়।

ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মোরো সংগ্রামের বৈধতা :

ইসলাম এমন কোনো ব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, যেখানে মুসলমানরা নিপীড়নের শিকার হয়, তাদের দীন পালন করা কঠিন হয়, কিংবা তাদের জমিন দখল করা হয়। বরং ইসলাম বলে:

"আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে; কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।"সূরা বাকারা: ১৯০

মোরো মুসলমানরা কখনো আগ্রাসী ভূমিকা নেয়নি; বরং তারা প্রতিরক্ষা ও আত্মরক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে। ইসলামিক আইন অনুযায়ী, যদি কোনো মুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের দীন, প্রাণ, সম্পদ ও সম্মান রক্ষায় বাধা দেয়া হয়, তবে সেখানে জিহাদ ফারদ হয়ে যায়।

নবী বলেন:

"যে ব্যক্তি তার মাল ও আত্মা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে এবং শহীদ হয়, সে শহীদ।"
সহীহ তিরমিযি

এই হাদিসের আলোকে মোরো সংগ্রাম একেবারে শরিয়তসম্মত আত্মরক্ষামূলক জিহাদ।

আন্তর্জাতিক মুসলিম উম্মাহর নীরবতা :

যেখানে ফিলিপাইনের মুসলমানরা দীন ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছিল, সেখানে মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র মৌন ছিল। কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন OIC মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিলেও বা আলোচনা করলেও তারা বাস্তবভিত্তিক চাপ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। এই অবস্থা আমাদের উম্মাহর ভ্রাতৃত্ববোধ ও দায়িত্ববোধের অবক্ষয়কে প্রতিফলিত করে।

বাংসামোরো শান্তিচুক্তি: এগিয়ে নাকি পিছিয়ে? :

২০১৪ সালে MILF-এর সঙ্গে ফিলিপাইন সরকারের "Bangsamoro Basic Law" স্বাক্ষরিত হয় এবং তার ভিত্তিতে গঠিত হয় Bangsamoro Autonomous Region in Muslim Mindanao (BARMM)। যদিও এটি একটি বড় অর্জন, কিন্তু অনেকে বলেন যে এ অঞ্চল এখনও পূর্ণ ইসলামিক শাসন বা আত্মপরিচয় রক্ষার উপযোগী নয়।

বাংসামোরোতে শরিয়া আদালতের কিছু সীমিত ক্ষমতা থাকলেও তা এখনো ফিলিপাইন সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই ইসলামিক ন্যায়বিচার সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পায়নি।

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ও করণীয় :

১. ইসলামি শিক্ষা ও চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া— তরুণ প্রজন্মকে ইসলামি ইতিহাস, আত্মপরিচয় ও জিহাদের ন্যায়বিচার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও মুসলিম উম্মাহর জাগরণ— OIC, আল আযহার ও ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর উচিত এ অঞ্চলের মুসলমানদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়া।
৩. আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি ও সামাজিক পুনর্গঠন— মুসলিম অঞ্চলগুলোতে দারিদ্র্য কমাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও স্থানীয় নেতৃত্ব বিকাশ করতে হবে।

উপসংহার :

মোরো সংঘাতের ইতিহাস শুধু একটি জাতির ইতিহাস নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহর একটি অনন্য অধ্যায়—একটি জাতি যারা ইসলামী চেতনাকে হারাতে দেয়নি, যারা নিপীড়নের মধ্যেও আল্লাহর প্রতি ঈমান ও নিজেদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অটল থেকেছে। এই সংগ্রাম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যদি আমরা ইসলামী ঐক্য ও সচেতনতা হারিয়ে ফেলি, তবে আমাদের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়ে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter