এরদোগান: আধুনিক যুগের এরতুগ্রাল
"আমরা বলেছিলাম যে এমন ভাবে আমরা সফল হবো যাতে কারো পরাজয় না হয়। তাই আজ শুধুমাত্র তুরস্ক বিজয়ী!" ২৮ মে তারিখ দ্বিতীয় দফার নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরের দিন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রাজিব তাইয়েব এরদোগান এই ঘোষণার সঙ্গে বিজয় বার্তার ইঙ্গিত দেন। সেই সঙ্গে উক্ত দিন যথা ২৯ মে-তে প্রলক্ষিত ১৪৫৩ সালে মুহাম্মদ দ্বিতীয় কর্তৃক কনস্টান্টিনাপোলে বিজয়ের ৫৭০ বার্ষিকী। অর্থাৎ তুরস্ক শাসনে রাজিব তাইয়েব এরদোগানের আরোহণ ওসমানী সাম্রাজ্যের সুলতানী প্রশাসন সমতুল্য। আবার নবযুগের নতুন এক নিদর্শন যার প্রভাব বিশ্বব্যাপী স্পর্শিয়া।
কার লড়াই?
পৃথিবীর মধ্যে অনেক কম এরকম দেশ যার নির্বাচনী প্রভাব আন্তর্জাতিক বিস্তারে প্রতীক্ষিত হয়। তার মধ্যে নতুন তুর্কি একটি। আমেরিকা থেকে ভারত পর্যন্ত সকল দেশের নজর তুরস্ক সাধারণ নির্বাচন ফলাফলের উপর ছিল। এমনকি নির্বাচন প্রস্তুতির পূর্বেও এইসকল দেশে তুরস্ক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-কলহল দেখা যায়। এসব দেখে এটাই স্পষ্ট যে আগামী বৈশ্বিক নীতি নির্মাণে তুর্কির বড় ভূমিকা থাকবে যা কোন দেশি সহ্য করতে পারে না।
দেশের ঐতিহ্যগত ইসলামী প্রভাব কে নষ্ট করার জন্য বিশ্ব রাজনীতি তুর্কিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেয় - চরম ধর্মনিরপেক্ষতার (Ultra-secularism) নামে কামালবাদ (Kemalism) এবং ইসলামবাদ (Islamism) কক্ষে। অনুরূপ মতবাদে বিভক্ত দেশব্যাপী যথাক্রমে দুটি জোট বা দলও সামনে আসে যথা কামাল কিলিচদারোলুর ন্যাশনাল অ্যালিয়ান্স (National Alliance) এবং এরদোগানের পিপলস অ্যালিয়ান্স (People's Alliance)।
তুর্কি নির্বাচনে এই সমীকরণের কারণে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। যদিও এটা রাজনৈতিক সংগ্রাম, তবুও কিন্তু এক পূর্ব-পশ্চিমের যুদ্ধ বা ইসলাম ও অ-ইসলামের সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রচারে এরদোগানকে এক ইসলামী-চরমপন্থী, স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এই ক্যাম্পে সব থেকে বেশি জোর নিয়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম প্রিন্ট মিডিয়া। তাছাড়া এই প্রতিচ্ছবির পিছনে এরদোগানের নিজস্ব বেশ ভূমিকা আছে।
অটোম্যান ঐতিহ্য
রজব তাইয়্যেব এরদোগান গত ২০০৩ থেকে তুর্কির জাতীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে - ২০১৪ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং ২০১৪ থেকে বর্তমান রাষ্ট্রপতি। ইদানিং সফলতা এই মেয়াদে আগামী পাঁচ বছরও যুক্ত করে দেয়। এরও বিলুপ্ত ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত দেশের অন্যতম শহর, ইউরোপ-এশিয়ার বাঁধ, পূর্ব অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন। ২০০১ এ আদালত ও কালকিনমা পারটিসি (Justice and Development Party, AKP) গঠনের পর এরদোগান তুর্কির রাজনীতিতে নিজেও প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরদোয়ানের তুলনা অনেক সময় অটোমান সাম্রাজ্যের প্রাণপুরুষ ওসমানের পিতা এরতুগ্রুলের সঙ্গে করা হয় যেহেতু একেপি পার্টির মূল প্রচার হল ধর্মগত ঐতিহ্যের সঙ্গে জাতীয় উন্নতি। কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক ১৯২৪ সালে খেলাফতের সম্পূর্ণ বিলুপ্তের পরে আধুনিক সেকুলার সৃষ্টি হয় যেখানে জনসাধারণের ধর্মগত সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে বাধ্যতামূলক পশ্চিমাকরণে ঠেলে দেওয়া হয়। ভাষা, শিক্ষা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, রীতি-বিধি সকল পদক্ষেপে কামালবাদের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আন্দোলনও শুরু হয়। রাজনৈতিক স্তরে এই প্রতিরোধের শীর্ষক নেতা হয়ে দাঁড়ায় রজব তাইয়েব এরদোগান। বিগত কুড়ি বছর থেকে তুর্কির ঐতিহ্য আবার কোন জাগরণের ভোর খুঁজছে।
শুধুমাত্র দেশীয় চৌহাদদের মধ্যে নয়, এরদোগান প্রভাব বিশ্ব পর্দায় স্পষ্ট। শীঘ্রই এরদোগান আন্তর্জাতিক মুসলমানের অপ্রচারিত প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম ও মুসলিম কেন্দ্রিক বিষয় সমূহে এরদোগান পরিচালিত তুর্কির নির্দিষ্ট এক স্থান দেখা গেছে। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা বা সিরিয়া মুসলমানদের নিয়ে তুর্কির উদারতা মুসলিম বিশ্বের হৃদয় জয় করেছে। তাছাড়া, বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক কর্মকলাতেও তুর্কির ভূমিকা স্বাধীন এবং সংবেদনশীল।
কিছু পরিসংখ্যান
নির্বাচন নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে তুর্কির বর্তমান সংবেদনশীল অবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ৬৪ মিলিয়ন ভোটারের ৮৮% টার্ণঅফ নিয়ে ১৪ই মে নির্বাচন সমাপ্ত হয়। কনিষ্ট আঙ্গুল কামরের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষার পর ফলাফল বের হয় - এরদোগানের দলে ৪৯.৫ শতাংশ এবং কিলিকদারগুলুর ৪৪.৮ শতাংশ অর্থাৎ যথাক্রমে ৬০০ সিটের মধ্যে এরদোগান ৩২৩ এবং কিলিকদারগুলু ২১৩ সিট অর্জন করে। দুই দলই অর্ধ শতাংশ ভোট পেতে ব্যর্থ হয়।
নিয়ম অনুসারে অর্ধশতাংশের উর্ধ্বে না হলে কোন দলই সরকার গঠন করতে পারে না। তুরুস্ক রানঅফ অর্থাৎ পুনরায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেই। তারিখ সাবস্ত হয় ২৮ মে। ২৯ মে-এর ফলাফল: ভোটদানে ৮৪ শতাংশ টার্নঅফ। বর্তমান সরকারের খাতায় ৫২ শতাংশ এবং মুখ্য বিরোধী দলের ৪৮ শতাংশ যথাক্রমে ২৭.৭ মিলিয়ন এবং ২৫.৪ মিলিয়ন দুই দলে ভোট প্রাপ্ত করে।
পরিষ্কার যে প্রাথমিক পরিসংখ্যানে কোন বড়ো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু হ্যাঁ অবশ্যই, সরকারহীনতার দুর্ভাসটা দূর হয়েছে। স্পষ্টতেই যে, আগামীতে অবস্থার প্রতিকূলতা আরও জটিল হতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
যেসব মুখ্য বিষয়গুলি কেন্দ্র করে এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ক্যাম্পেন চলে সেগুলোকে লক্ষ্য করে দেশের আগামী অগ্রগতি হওয়া উচিত। প্রধান বিরোধী কামাল কিলিচদারোলুর পার্টি জুমরিয়াত হাল্ক পার্টিসি (Republican People's Party, CHP) এবং তার ছয় দলীয় জোট বর্তমান সরকারকে যেসব প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল তা অনেকটাই অপেক্ষার নয়, যদিও সেগুলি জনসাধারণের মানে বসতে পারেনি।
রজব তাইয়েব এরদোগানের ওপর আন্তর্জাতিক স্তরে অভিযোগ আসে যায় তাঁর সরকার বিরোধী প্রতিরোধ এবং সংখ্যালঘু অধিকার একেবারে ছিন্ন করে। নতুন সরকারকে সংখ্যালঘুর অধিকার এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চয়তা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সরকারের আর্থিক পরিকল্পনা আর ওসব বিচারপন্য হওয়া দরকার। ২০১৮ থেকে জাতীয় মুদ্রার অবনতি ৮০ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতির হার ৪৪ শতাংশ। তৃতীয় বিষয় হল পড়শী দেশ আশ্রয়হীন সিরিয়ার উদ্বাস্তু সমস্যা। এক শান্তিপূর্ণ সমাধানের সঙ্গে তাদের জীবন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা দুই দেশেরই কর্তব্য। অনুরূপ অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির ওপর সরকারের বিশেষ লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন যার অভিযোগ বিগত বিধ্বস্ত ভূমিকম্পের পর বিরোধীদের আলোচনায় আসে।
দেশ ও জনগণের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে এগুলো বর্তমান সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুরস্কের ভূমিকা আরও গ্রহণযোগ্য এবং শক্তিসম্পূর্ণ হবে।
তুর্কির বৈশ্বিক নীতি
ইতিহাস থেকে বৈশ্বিক নীতি প্রণয়নে তুর্কির এক ভূমিকা আছে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে আরম্ভ করে অটোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত এর পরিষ্কার ঐতিহ্য, যদিও দ্বিতীয়র বিলুপ্তির পর ইউরোপের অসুস্থ মানুষের (Sick Man of Europe)। কিন্তু ইদানিং কিছু বছর গুলিতে, দেশটি তার পুরনো ঐতিহ্য পুনরায় প্রাপ্তি করতে চলেছে।
আন্তর্জাতিক মুসলিম বিষয়ে সর্বদা তুর্কি এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে, তাদের বৈশিষ্টিক সমস্যায় দ্রুত সাড়া দিয়েছে, বাহ্যিক আক্রমণে শীঘ্রই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এইসব কারণে মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ দিশারী হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
দ্বিতীয়তঃ শীতল যুদ্ধ (Cold War) সমাপ্ত হলেও, এর প্রভাব কিন্তু শেষ হয়নি। বিশ্ব রাজনীতিতে এখনই মেরুকরণ স্পষ্ট। তুর্কি এই দ্বিমেরু বিশ্ব পদ্ধতি (Bipolar World System) উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র হয়ে বহুমুখীতার পরিচয় দিয়েছে। নাটোর একমাত্র মুসলিম সদস্য হয়েও, তুর্কি এখনও কারো পক্ষপাত হয়নি, বরং রাশিয়া-ইউক্রাইন যুদ্ধে মীমাংসার সংকেত নিয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সিল্ক রোড পরিকল্পনাতেও দেশটি অংশগ্রহণ করেছে। এখন দেখবার বিষয় এরদোগান সরকারের অধীনে তুরস্ক রুগ্ন মানুষের শয্যা ছেড়ে আন্তর্জাতিক স্তরে কতদূর দাঁড়াতে পারে। এই প্রবীণ সত্যিই কি এরটুগ্রালের পরিচয় দিতে পারে!