মানব উৎপত্তি: বিবর্তন, প্রকৃতিবাদের সীমাবদ্ধতা ও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি

মানুষের উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন যুগে যুগে জ্ঞানীদের আলোচনার বিষয় হয়েছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের বিবর্তন তত্ত্ব (Theory of Evolution) এবং দর্শনের প্রকৃতিবাদ (Naturalism) এই আলোচনাকে আরও তীব্র করেছে। এরা বলছে, মানুষসহ সব জীবজগত প্রাকৃতিক নিয়মে গঠিত হয়েছে, কোনো ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃত সত্তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সত্যিই কি তা-ই? এই প্রবন্ধে আমরা প্রথমে বিবর্তন ও প্রকৃতিবাদের ব্যাখ্যা ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা করব এবং পরে ইসলাম কী বলে তা সহজ ও বিশ্লেষণধর্মীভাবে দেখব।

চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব

বিবর্তন তত্ত্ব (Theory of Evolution), বিশেষ করে চার্লস ডারউইন প্রবর্তিত রূপটি, জীবজগতের পরিবর্তন ও বিকাশকে ব্যাখ্যা করার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ডারউইন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ On the Origin of Species (1859)-এ প্রথম বিশদভাবে এই তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, প্রাণীর বৈচিত্র্য এবং বর্তমান প্রাণীজগৎ ধাপে ধাপে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে, এবং এই প্রক্রিয়ার মূল চালিকাশক্তি হলো প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশে যে প্রাণীগুলি সবচেয়ে ভালোভাবে অভিযোজিত হয়, তারাই অধিক সম্ভাবনায় বেঁচে থাকে ও পরবর্তী প্রজন্মে নিজেদের জিন ছড়িয়ে দেয়। ধাপে ধাপে এই অভিযোজন ও বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর গঠন ও আচরণে পরিবর্তন আসে।

ডারউইনের তত্ত্বের আলোকে, মানুষও প্রাণীজগতের বিবর্তনের একটি ধাপ। মানুষের শারীরিক গঠন, মানসিক ক্ষমতা এবং সামাজিক আচরণেরও রয়েছে বিবর্তনগত ব্যাখ্যা। তবে এই তত্ত্ব কিছু নির্দিষ্ট জটিল মানবীয় বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যায় অনেক সময় অস্পষ্ট বা অপূর্ণ থেকে যায়।

যদিও ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব জীববিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং প্রাণীজগতের পরিবর্তন ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তবুও এটি মানুষের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ। আত্মসচেতনতা, যা মানুষকে নিজের অস্তিত্ব ও পরিচয় নিয়ে ভাবতে সক্ষম করে, শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য বিবর্তনের ফসল হিসেবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। একইভাবে নৈতিকতা বা ন্যায়-অন্যায়ের অনুভূতি—যেখানে মানুষ প্রয়োজনে আত্মত্যাগ করে বা দুর্বলকে সাহায্য করে—তা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভিত্তিতে ব্যাখ্যাতীত। আরও জটিল হলো সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনাশক্তির বিষয়টি; সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা কিংবা দর্শনের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও সৃষ্টিশীলতা জীবনের সরাসরি টিকে থাকার প্রয়োজনে নয়, বরং এক গভীর মানসিক তাগিদ থেকে উৎসারিত। উপরন্তু, চেতনা ও অনুভূতির ব্যাখ্যাও এই তত্ত্ব দিতে অপারগ, কারণ চেতনার সূচনা ও বিকাশ কীভাবে ঘটেছে তা নিয়ে বিজ্ঞান এখনও নিশ্চিত নয়। এসব দিক বিবেচনায়, ডারউইনের তত্ত্ব যেমন জীবের শারীরিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যায় সফল, তেমনি মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ও গভীর মানবিক গুণাবলি ব্যাখ্যায় এটি অনেকটাই অসম্পূর্ণ।

প্রকৃতিবাদের (Naturalism) দাবি

প্রকৃতিবাদ (Naturalism) একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দার্শনিক মতবাদ, যার মূল দাবি হলো—বিশ্বে যা কিছু ঘটে, তা সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক নিয়ম, পদার্থ ও শক্তির পারস্পরিক ক্রিয়ার ফল। এই মত অনুযায়ী, বাস্তবতার বাইরের কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি, স্রষ্টা, নৈতিক উদ্দেশ্য কিংবা আত্মিক জগৎ নেই; সবই বস্তুজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মানুষের মন, চেতনা, আবেগ, চিন্তা কিংবা আত্মা—এসব কোনো বিচ্ছিন্ন বা অলৌকিক সত্তা নয়, বরং মস্তিষ্কের নিউরন ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার জৈব-উদ্ভূত প্রভাবমাত্র। আমাদের ভালোবাসা, কল্পনা, বেদনা বা নৈতিক দ্বিধাও প্রকৃতিবাদের দৃষ্টিতে নিছক শারীরিক ও জৈবিক প্রতিক্রিয়া, যা কোনো পরম অর্থ বা আত্মিক সত্য বহন করে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গি কি সত্যিই আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? আমরা কি আমাদের অনুভব, উপলব্ধি ও নৈতিক বিচারে কেবল একটি জৈবিক যন্ত্র? যখন আমরা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করি, সৌন্দর্যে আবেগে আন্দোলিত হই, বা আত্মত্যাগমূলক সিদ্ধান্ত নিই, তখন কি তা কেবল নিউরনের সংযোগ ও প্রোটিনের কার্যকলাপ? প্রকৃতিবাদ একদিকে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার সীমারেখা মেনে চলার দাবি করে, কিন্তু অন্যদিকে মানুষের চেতনা, মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতার গভীরতা ব্যাখ্যায় এক ধরনের সংকীর্ণতা তৈরি করে। ফলে, প্রকৃতিবাদ একটি শক্তিশালী যুক্তি উপস্থাপন করলেও, তা মানব অস্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ ব্যাখ্যা দিতে পারে কি না—তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন থেকেই যায়। 

বিবর্তন ও প্রকৃতিবাদের সীমাবদ্ধতা

১. চেতনা ও যুক্তি ব্যাখ্যাতীত:
প্রকৃতিবাদ বলে আমরা কেবল জৈব প্রক্রিয়ার ফল। তাহলে আমরা কীভাবে সত্য-মিথ্যা বুঝি? চিন্তা করি? আত্মসমালোচনা করি? বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এলভিন প্ল্যান্টিঙ্গা বলেন, যদি আমাদের যুক্তিশক্তিও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে তা বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে, কারণ বিবর্তন সত্য নয়, বরং টিকে থাকার যোগ্যতা অনুসন্ধান করে।

২. জীবাশ্মের অভাব:
বিবর্তন বলে এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে, কিন্তু মধ্যবর্তী রূপের (transitional forms) অনেক জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষ ও বানরের মধ্যে যে হাজার বছরের পার্থক্য, তার মাঝে অসংখ্য রূপ থাকার কথা, কিন্তু তার প্রমাণ নেই।

৩. জেনেটিক কোড ও বুদ্ধিদীপ্ত নকশা:
প্রাণের ভেতরের জটিল কোড (DNA) এমনভাবে তৈরি, যা একটি প্রোগ্রামিং ভাষার মতো। এত জটিল ও সুনির্দিষ্ট ডিজাইন দৈবভাবে সৃষ্টি হওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই ধারণা করেন অনেক বিজ্ঞানী।

৪. নৈতিকতা ও আত্মা:
মানুষ কেবল প্রাণী হলে সে আত্মত্যাগ কেন করে? অপরিচিত মানুষের জন্য প্রাণ দেয় কেন? প্রকৃতিবাদ এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ।

ইসলাম কী বলে?

ইসলাম মানবজাতির উৎপত্তিকে স্রষ্টা আল্লাহর একটি পরিকল্পিত সৃষ্টি হিসেবে ব্যাখ্যা করে। কোরআনে বলা হয়েছে:

"আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে..."
— (সূরা আলে ইমরান ৩:৫৯)

"আমি তাকে (মানবজাতিকে) সৃষ্টি করেছি এক নির্ধারিত রূপে এবং তার মধ্যে আমার রূহ (আত্মা) ফুঁকেছি..."
— (সূরা সাদ ৩৮:৭২)

ইসলাম বলে, মানুষ কেবল শারীরিক অস্তিত্ব নয় – বরং তার ভেতরে আছে একটি আত্মা, যার উৎস আসমানি। এই আত্মার মাধ্যমেই মানুষ সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে সক্ষম হয়।

বিবর্তন সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
ইসলাম সরাসরি বিবর্তন তত্ত্বকে সমর্থন করে না, আবার পুরোপুরি অস্বীকারও করে না যে জীবজগতে কিছু পরিবর্তন হতে পারে। তবে আদম (আ.) কে আলাদা ও বিশেষভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তাই ইসলামিক দৃষ্টিতে মানুষ বানর থেকে আসেনি।

মানব জাতি আল্লাহর খলিফা:
ইসলাম মতে, মানুষকে শুধু একটি জীব হিসেবে নয়, বরং “খলিফা” বা প্রতিনিধির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

"আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি (খলিফা) সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।"
— (সূরা বাকারা ২:৩০)

এখানে দেখা যায়, মানুষের মধ্যে এমন কিছু দায়িত্ব ও মর্যাদা রয়েছে যা তাকে অন্যান্য সৃষ্টির থেকে আলাদা করে দেয়। এটা কেবল জৈব বিবর্তনের ব্যাখ্যায় ধরা যায় না।

বিজ্ঞান বনাম ইসলাম?

অনেকেই মনে করেন বিজ্ঞান ও ধর্ম একে অপরের বিরোধী। কিন্তু ইসলাম বলে, সত্য সবখানেই এক। বিজ্ঞান প্রকৃতির ভাষা বলে, আর কোরআন সৃষ্টিকর্তার ভাষা। দুটো যখন সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তারা একে অপরের পরিপূরক হয়।

ইসলাম বিজ্ঞান চর্চাকে উৎসাহিত করে, কিন্তু অন্ধ প্রকৃতিবাদকে নয়। ইসলাম চায় মানুষ চিন্তা করুক, পর্যবেক্ষণ করুক, তবে ভুলে না যাক — সবকিছুর পেছনে আছে এক স্রষ্টার নিখুঁত নকশা।

উপসংহার

মানুষের উৎপত্তি কেবল শারীরিক বিবর্তনের ফল নয় – বরং এটি একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ সৃষ্টির ফল, যেখানে শরীরের পাশাপাশি রয়েছে আত্মা, চেতনা ও দায়িত্ব। বিবর্তন তত্ত্ব ও প্রকৃতিবাদ কিছু প্রাকৃতিক বিষয় ব্যাখ্যা দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু মানুষের প্রকৃত অবস্থান, আত্মা, নৈতিকতা এবং চেতনার গভীরতা বুঝতে হলে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির মতো আধ্যাত্মিক দিক বিবেচনায় নিতে হয়।

বিজ্ঞানের উচিত প্রকৃতি বোঝা, কিন্তু সৃষ্টি ও অস্তিত্বের চূড়ান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় স্রষ্টার দিকে — যেমনটি ইসলাম শিক্ষা দেয়।





Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter