H-পপ ভারতীয় মুসলিমকে অপবাদ করার এক নতুন কৌশল
ভূমিকা
২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় অসীন হওয়ার পরে আরএসএস-এর রাজনৈতিক শাখা ভারতীয় জনতা পার্টি হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা প্রচার করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পন্থা ও নানান পদ্ধতি গ্রহণ করে । সকল অফলাইন ও অনলাইন জগতে বিজেপি দমন রাখে। সোশ্যাল মিডিয়া, খবরের কাগজ, বলিউড, টলিউড, এবং কলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, মিম ইন্ডাস্ট্রি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ শিবির, এবং সিনেমা ও জনতা কল্যাণ শিবির ইত্যাদি কে নিজের চরমপন্থীর আইডিয়োলজি প্রচার করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। হিন্দুত্ববাদের চরমপন্থী আইডিওলজি প্রচারের এক গণ্য প্ল্যাটফর্ম এর মধ্যে হচ্ছে H-পপ বা হিন্দুত্ব পপ সংগীত।
H- পপ কাকে বলে ?
H-পপ বা হিন্দুত্ব পপ হচ্ছে ভারতীয় পপ সঙ্গীত যা হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার করে । সাধারণত হিন্দুত্ববাদী পপ সঙ্গীত গুলো হিন্দি ভাষায় রচায়ন করা হয় কিন্তু এর তরজমা সমস্ত ভারতীয় ভাষায় হয়ে থাকে । ২০১০ ও ২০২০ সালে ক্রমবর্ধমান এই সংগীত গুলির চাহিদা ভারতীয় হিন্দু সমাজে বৃদ্ধি পায়। এই গানগুলি ভারতীয় মাইনরিটি মুসলিম গোষ্ঠীকে টার্গেট করে ঘৃণা ও নির্লজ্জ কথা ও গালিতে অন্তর্ভুক্ত । উদাহরণস্বরূপ
*তুম ইনসান নেহি হো সালো, হো তুম কাসাই*
*বহুত হো চুকা হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই*
(তোমরা মানুষ নই তোমরা হচ্ছ কসাই। অনেক হয়েছে হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই)
এটি একটি হিন্দু ভজনের ছন্দ যা প্রেম কৃষ্ণবংশী নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিন বছর আগে আপলোড করেছিল এবং হিন্দু চরমপন্থীদের থেকে বিশাল আকারের সাহায্য পেয়েছিল।
ঘৃনার এই রাজনীতিতে H-পপ সংগীত শিল্পীদের মধ্যে প্রেম কৃষ্ণবংশী, লক্ষ্মী দুবে, উপেন্দ্র রানা, কবি সিং এবং প্রমুখ প্রচলিত।
প্রেম কৃষ্ণবংশী
প্রেম কৃষ্ণবংশী উত্তরপ্রদেশের লখনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতক। সে প্রথমত বলিউডে নিজের সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রবেশ করার চেষ্টা করে কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ার কারণে হিন্দুত্ব পপ এর রাস্তায় নেমে পড়ে । ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী পার্টি, ভারতীয় জনতা পার্টি মোদির হাত ধরে সরকার গঠন করলে তার জীবনে এক নতুন সন্ধিক্ষণ আসে।ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজে আতঙ্ক ও হিন্দুদের মধ্যে তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার জন্য H-পপ সিঙ্গার হিসেবে তাকে নিয়োগ করে।
কৃষ্ণবংশী বিশেষভাবে হিন্দি এবং ভোজপুরি ভাষায় গান তৈরি করে থাকে, উত্তর প্রদেশ এবং তার পার্শ্ববর্তী জেলা গুলি থেকে তার ইউটিউব চ্যানেলের ফলোয়ার আছে। সে নিজের গানের মাধ্যমে এই পরামর্শ দিয়ে থাকে যে মুসলমানরা হচ্ছে দেশবিরোধী, তাদেরকে ভারত ছেড়ে পাকিস্তান চলে যাওয়া উচিত। সে নিজের একটি গানে এও বলে যে মুসলমানরা হিন্দুদের নামাজ পড়তে বাধ্য করবে যদি হিন্দু সমাজ এখনও না জাগ্রত হয়।
একদা এক সময় আল-জাজিরার রিপোর্টার যখন তাকে তার ঘৃণা প্রচারক সংগীতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তখন সে বলে ““আমি মনে করি না আমার সঙ্গীত ইসলামফোবিক। আমার সংগীত সত্যকে নির্দেশ করে এবং কেউ যদি এটিকে ইসলামফোবিক বলে মনে করে তবে আমি তাদের সেভাবে অনুভব করা থেকে বিরত রাখতে পারি না”।
সম্প্রতি, উত্তরপ্রদেশ সরকার তাকে রাজ্যের কট্টরপন্থী মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের প্রশংসা করার জন্য একটি পুরস্কার দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ তার একটি গান:-
“চীর কে রাখ দেঙ্গে উসকো বুড়ি নাজার জো ডালেগা
হাম হে ভাগয়াধারি কউন তুমহে বাচা লেগা
সাড়কো পে আব মাযহাব কা তামাশা আব নেহি হোনে দেঙ্গে
ভাগো জাহা সে আয়ে হো তুম ফাতওয়া ইহা না চালেগা”
পাড়ে গা ডাণ্ডা পিছ্বারে মে তো ভান্দে মাতরাম গাওগে
লাক্সমি দুবে
ছোটো থেকেই হিন্দু সূফী সঙ্গীত শুনেছিল ভোপাল শহরে জন্মগত লাক্সমি দুবে, তার পূর্বপুরুষ সকলেই হিন্দু ধর্মে ভক্তিমুলক সংগতি রচায়ন করত। শৈশব কাল থেকেই হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই গান গেয়ে বেড়াতেন এই মহিলা, কিন্তু কৃষ্ণবংশীর মতই ২০১৪ সালে মোদীর সরকার গঠন হওয়ার পর সে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই সঙ্গীত ছেড়ে হিন্দুত্ব পপ সঙ্গীত গাইতে শুরু করে।
লাক্সমি দুবে ৩১ বছর বয়সে একটি নিউজ চ্যানেল-এ কর্মরত ছিল, কিন্তু মোদী সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদের চিন্তাধারা দেখে সে এই পথ গ্রহণ করে। যখন আল-যাজীরার একজন রেপোর্টার তাকে তার রাজনৈতিক পার্টির সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করে তখন তার প্রতুত্তরে সে বলে যে “আমি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নাই কিন্তু মোদী সরকার হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্য যা করছে আমি তার প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানাই”।
বিভিন্ন H-পপ সিঙ্গার দের মত লাক্সমি দুবেও মুসলিম বিরোধী অনেক গান লেখে। তার H-পপ এর মধ্যে সব থেকে প্রচলিত হল
আগার হিন্দুস্তান মে রেহেনা হোগা তু ভান্ডে মাত্রাম কাহেনা হোগা (যদি ভারতে থাকতে চাও তাহলে বন্দে মাতরম বলতে হবে)
জওহারলাল নেহেরু বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রফেসর ব্রাহ্ম প্রকাশ বলেন যে “ঘৃণা সঙ্গীত ভারতে ধর্মীয় সহিংসতার ধরণ বদলে দিয়েছে, প্রথমে কোনো রাজনৈতিক নেতা কটাক্ষ ভাষণ দিতেন যার কারণে রাস্তায় দাঙ্গা ছড়াবে কিন্তু এখন কোনো রাজনৈতিক নেতার ভাষণের দরকার নেই এই ধরনের সঙ্গীত মাইকে বাজিয়ে দিলেই ধর্মীয় দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে” ব্রাহ্ম প্রকাশ এই বিষয়ে নিন্দা জানিয়ে বলেন যে ঠিক এই ধরনেরই ঘৃণা সঙ্গীত প্রচার করে ১৯৩০ সালে অ্যাডলফ হীটলার জার্মানিতে নাযি সরকার গঠন করেছিল।
লাক্সমি দুবে ইউটিউব চ্যানেলে ত্রিশ হাজারের অধিক সহযোগী আছে এবং তার প্রত্যেকটি ভিডিওতে পাঁচ হাজারের অধিক মুসলিম বিরোধী মন্তব্য। লাক্সমি দুবেকে যখন তার মুসলিম বিরোধী সঙ্গীতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয় তখন সে তার প্রতুত্তরে বলে আমার সংগীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কিছু নেই কিন্তু আমার সঙ্গীত তাদের বিরোধী যারা ভারতে থেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করে থাকে।
লাভ জিহাদ ও মুসলিম নারীদের শিশু উৎপাদনের মেশিন বলে কটাক্ষ করে সে মন্তব্য করে যে মুসলিমরা হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে ৫-১০ এর অধিক ছেলে জন্ম দিচ্ছে যার কারণে প্রত্যেকদিন তাদের জনসংখ্যা বাড়ছে ।
উত্তর প্রদেশ রাজ্য কোর্টের আইনজীবী আরীবুদ্দিন সাহেব বলেন “বিদ্বেষপূর্ণ গান ঘৃণামূলক বক্তব্যের সমান”। এখন সময় এসেছে যে ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে আইনশাস্ত্রের স্থান নেওয়া উচিত এবং আদালত বা সংশ্লিষ্ট আইন প্রণেতাদের এমন ক্ষেত্রে নির্দেশিকা তৈরি করা উচিৎ”
সে এটাও বলে যে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজন অন্যায় ছিল। “আমার সংগীত দ্বারা আমি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়কে জাগরণ করতে চাই, তাদের সকলকে একত্রিত করে এক হিন্দু ফৌজ তৈরি করতে চাই” তিনি আল জাযীরাকে বলেছিলেন।
উপসংহার
এ ছাড়াও ভারতীয় সিনেমা জগতে বিভিন্ন এই ধরনের মুভি দেখা যায় যা হিন্দুত্ব চিন্তাধারাকে প্রচার করে। আদিপুরুষ, পাদ্মাভাত, তানহাজি, সম্রাট পৃথ্বীরাজ, পানিপাত, মানিকারনিকা, দি কেরালা স্টোরি, ৭২ হুরাইন, স্বতন্ত্রবীর সাভারকার, আক্সিডেন্ট অর কন্সপিরাসি গোধ্রা, দি কাশ্মীর ফাইল, দি আজমির ফাইল ইত্যাদি। ভারতীয় ইতিহাস মুছে নতুন ইতিহাস তৈরি করার পথে বিজেপি সরকার, এদেরকে বাধা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন, আসুন এই ভোটে নিজের শক্তি দেখিয়ে এই সরকার উৎপাটন করে ফেলি।