ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান সমস্যা ও সংকট (প্রথম পর্ব)

সংকট ও পরীক্ষা জাতি টিকে থাকার জন্য জরুরী পৃথিবীর প্রতিটি জাতিকে সংকট ও পরীক্ষার যুগ অতিক্রম করতে হয়। পথের কষ্ট ও সময়ের পরীক্ষা যে কোন জাতির স্থায়িত্বের পরশ পাথর। এটা আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা যা সুপ্ত শক্তিতে চেতনার সঞ্চার করে, জাতীয় জীবনে জটিলতা ও সংকট উত্তরণে সহায়তা করে এবং অগ্রগতির পথে অনুপ্রাণিত করে। যে জাতি কখনো দূঃখ-দূর্দশা ও বিপদের ঘূর্ণাবর্তে পড়েনি, সে জাতির ভেতরে পরিস্থিতি পরিবর্তনের যোগ্যতা যেমন জন্ম নেয়না তেমনি আত্মবিশ্বাসও জাগ্রত হয়না। ক্রমশ বিলাসিতা, আত্মবিস্মৃতি ও জড়তার শিকার হয়ে পৃথিবীর বুক হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

ভারতীয় মুসলমানরাও ইদানিংকালে পরীক্ষার এক দূর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছেন। জাতীয় জীবনে তাঁরা বহুবিধ সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন। এসব সংকটের মধ্যে কিছু তাদের ভুলের ফসল কিছু অতীতের উত্তরাধিকার আর কিছু এমন সব দূর্ঘটনায় সৃষ্ট যা কয়েক বছর আগে ভারতে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যাত্রা পথের এ সংকট ক্ষণস্থায়ী এবং দেখতে দেখতে পরীক্ষার মৌসুম চলে যাবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে উদ্ভুত পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় সমাধানে চেষ্টা করতে হবে যাতে তারা সত্যাশ্রয়ী, ভারসাম্যপূর্ণ, বাস্তববাদী ও দুঃসাহসী নেতৃত্বের জন্ম দিতে পারেন।

আমি এখানে ভারতীয় মুসলমানদের কতিপয় বিশেষ সমস্যার উপর আলোকপাত করবো।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ফ্যাসাদ যদিও আজ স্বাধীন ভারতের জন্য এক ট্রাজেডী তারপরেও আমরা মনে করি এ সংকট অস্থায়ী এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, সচেতন রাজনৈতিক ও আমাদের সুশীল সমাজ দায়িত্বানুভূতির পরিচয় দিলে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করতে বেশী লাগবেনা। আসল উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে ঐসব সংকট ও সমস্যা যা চেয়ে চাপা আগুনের মত ধীরে ধীরে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে  বিপন্ন করে তুলবে নিশ্চিতভাবে। 

দাওয়াত ও তাবলীগের প্রতিবন্ধকতা

ইসলাম  যে একটি মিশনারী ধর্ম -একথা কারও অজানা নয়। দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ইসলাম বিস্তৃতি ও লাভ করেছে। নিঃস্বার্থ ধর্ম প্রচারক, আমানতদার ব্যবসায়ী ও সত্যনিষ্ঠ সুফী- দরবেশদের তাবলীগের বরকতে যত মানুষ ভারতে ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়েছেন তাদের সংখ্যা ঐসব মুসলমানদের চাইতে বেশী যারা এখানে এসেছিলেন সরাসরি আরব, ইরান ও তুরস্কের মতো মুসলিম দেশ থেকে। ইসলামের নীরব ও নিঃস্বার্থ প্রচার ও ভারতীয় মুসলমানদের জন্য নতুন প্রাণ ও নতুন শোণিতধারা যুগিয়েছে নিয়মিত। একমাত্র দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে এমন নতুন অতিথি এসেছেন যারা পরবর্তীতে নিজেদের সৃষ্টিশীল মেধা ও অসাধারণ যোগ্যতার বলে মুসলিম বিশ্বের নজীর বিহীন ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হন। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে এমন বহু ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের দূরে অথবা কাছে কোথাও না কোথাও হিন্দু পরিবারের সাথে সম্পৃক্তা রয়েছে। নিকট অতীতে 'তুহফাতুল হিন্দ' এর গ্রন্থকার মাওলানা ওবাইদুল্লাহ্ পাটিয়ালভী (রহ.), মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধী (রহ.), ড. স্যার মুহাম্মদ ইকবাল (রহ.), মাওলানা সানাউল্লাহ্ অমৃতসরী (রহ.) ও শায়খুত তাফসীর মাওলানা আহমদ আলী লাহোরীর (রহ.) মত আন্ত র্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের নাম এ এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। খুব কম মুসলমানই জানেন যে, এসব বুযুর্গবৃন্দ হিন্দু পরিবারের সাথে সম্পর্কিত। পরবর্তীতে তারা ইসলামের শ্বাশত আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ইসলাম কবুল করেন।

ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের এ ধারাবাহিকতা ভারতে মুসলিম শাসনের পতনযুগে এবং বৃটিশ শাসনের সমাপ্তি দিনগুলো পর্যন্ত সফলতার সাথে অব্যাহত ছিল। প্রতিবছর  বিপুল সংখ্যক অমুসলিম স্বেচ্ছায় ও স্বপ্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এর কারণ হচ্ছে যুক্তি নির্ভর   শিক্ষা,তাওহীদবাদী চেতনা, সামাজিক ন্যায় বিচার ও বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের গৌরবোজ্জ্বল আদর্শের ফলে ইসলাম অপরাপর ধর্মের উপর শ্রেষ্টত্ব বজায় রাখে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অস্পৃশ্যতা ও বর্ণপ্রথার আদৌ কোন স্থান নেই। পবিত্র কুরআন, সীরাতে রাসূল এবং ইসলামের শিক্ষা গণমানুষের অন্তর ও বিবেককে জয় করে নিয়েছে। পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি যদি এভাবে চলতে থাকতো তাহলে সম্ভবত শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয় বরং পুরো এশিয়ায় ইসলাম বৃহত্তর ধর্মীয় শক্তি' হিসেবে আবির্ভূত হতো। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানদের রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হয়ে গেলো যা পরবর্তীতে দু'সম্প্রদায়ের অন্তরে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার আগুন জ্বালিয়ে দিলো। একে অপরের মাঝখানে সন্দেহ, ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর তৈরী হয়ে গেলো। যার ফলশ্রুতিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো। ভারত বর্ষের বিভক্তি সঠিক ছিল না ভুল ছিল? অথবা সমস্যার কোন বিকল্প সমাধান ছিল কিনা অথবা এ সমাধান গ্রহণযোগ্য হতো কিনা এ প্রসঙ্গ নিয়ে এ মুহুর্তে আমি কোন আলোচনা করতে চাইনা। 

পুরে বিষয়টি ভারতবের্ষর ইতিহাস রচয়িতাদের জন্য সংরক্ষিত রইল যারা পক্ষপাতহীনভাবে ঘটনার আনুপূর্বিক বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পাবেন। আমি কেবল এতটুকু বলতে চাই যে, তৎকালীণ রাজনৈতিক ঘটনাবলী ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক এমন এক বিরূপ পরিস্থিতির জন্ম দিল যার ফলে উভয় সম্প্রদায়ের। মানুষের মধ্যে অমোচনীয় তিক্ততা বৃদ্ধি পেলো এবং একে অপরকে ঘৃণা ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। সম্পকের এ তিক্ততা প্রতিপক্ষের ধর্ম- আকীদার সাথে হোক অথবা সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে হোক অথবা চিন্তা- চেতনার সাথে হোক সেটা বড় কথা নয়। সুতরাং অসহিষ্ণুতা ও অনাস্থার এ অনুভূতি ভারতবর্ষে ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের পথে বিরাট এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে দিল। ইসলামের ব্যাপারে ভারতবর্ষে একটি সাধারণ ধারণা জন্ম নিলো যে, ইসলাম এমন একটি দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম যা প্রতিপক্ষ হওয়ার উপযোগী অথবা এমন এক জাতির ধর্ম যারা অতীতে রাজনীতির টানাপোড়েন ও তিক্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলো। সে দুর্দিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনো অন্তরে দগদগে ক্ষত হয়ে রক্ত ঝরায়। অনেক সময় পাকিস্তানে এমন ঘটনাবলী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যা পড়লে অন্তর পুরনো ব্যথায় বিষিয়ে উঠে।

এটাই ভারতীয় মুসলমানদের অনেক বড় সমস্যা কিন্তু এতে সন্দেহ নেই যে, দিন যত যাবে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক তত উন্নত হবে, আবেগের উপর বুদ্ধি ও বিবেচনার প্রভাব যত দৃঢ়তর হবে ততই বিরাজমান সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসবে। হতাশার মেঘ কেটে যাবে এবং ইসলামের আবেদন ও জনপ্রিয়তা আবার ফিরে আসবে। তবে শর্ত হচ্ছে মুসলমানদেরকে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ, নিষ্ঠা ও নিঃস্বার্থভাবে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ চালিয়ে যেতে হবে এবং রাজনেতিক সুবিধে ও ক্ষমতায় আরোহনের কোন চিন্তা না থাকা চাই। দুনিয়া আখেরাতের মুক্তিকে সামনে রেখে মুসলমানদেরকে ওয়াজ নসীহতের ও সর্বপ্নাবী ভালবাসার প্রেরণায় উজ্জীবিত হতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মুসলমানদেরকে দেশবাসীর সামনে উন্নত নৈতিক চরিত্র ও ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালনের বাস্তব দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হবে। হিন্দি ও ভারতের আঞ্চলিক ভাষায় হৃদয়গ্রাহী ও সাড়াজাগানো বর্ণনারীতিতে রাসূলের জীবন চরিত ও ইসলামী সাহিত্য তৈরী করে সমাজের সামনে পেশ করতে হবে। মুসলমানদেরকে আন্তরিকতা, বিপুল উদ্দীপনা ও দায়িত্বানুভূতির সাথে জাতীয় উন্নয়ন, দেশ পুনর্গঠন ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক কাজে অংশ নিতে হবে। এটা অত্যন্ত জরুরী।

অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা। এ সমস্যা মুসলমানদের জাতীয় জীবন ও তাদের ভবিষ্যতের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।দ্বীনের তাবলীগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাতে কেবল ইসলামের বিস্তৃতি ও অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তাতে ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলবে। এতে মুসলমানদের বিশেষ সংস্কৃতি, বিশেষ তাহযীব ও বিশেষ আকীদা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। গণতান্ত্রিক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে প্রত্যেক ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিশ্বাস, ধর্মমত ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে গ্যারান্টি প্রদান করা হয়েছে।

 সংবিধানের দৃষ্টিতে দেশের প্রতিটি নাগরিক ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সমান অধিকার পাওয়ার দাবীদার। এ সংবিধান এমন একটি দেশের জন্য প্রণীত হয়েছে যেখানে বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন ধর্ম ও বিভিন্ন সংস্কৃতির অনুসারী বসবাস করেন। এ দৃষ্টিকোণে উক্ত সংবিধানের ধারা উপধারা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। ভারতের জন্য এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণীত হওয়া দরকার ছিল যেখানে রাষ্ট্র ও প্রশাসন বিশেষ কোন ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা না করে সবধর্মকে সমান দৃষ্টিতে দেখবেন' এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সব ধর্মের আদর্শের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। ভারতবর্ষের মতো বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশে সব ধর্মের আদর্শ ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বশীল একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন হয়তো সম্ভব নয়। শিক্ষা ব্যবস্থা যদি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ হতো এটাই ভাল ছিল, যেখানে কোন বিশেষ ধর্মের পক্ষে ওকালতি করা হবেনা। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণের বিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টির প্রশংসার দাবী রাখে কারণ তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ ব্যবস্থা বৃটিশ শাসিত ভারতে চালু ছিল। বাস্তবে রাষ্ট্রের পক্ষপাত মুক্ত ব্যবস্থায় কোন সম্প্রদায়ের আপত্তি ও অভিযোগ থাকতে পারেনা। মুসলমানগণও এ ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট থাকতে পারেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, শিক্ষা পদ্ধতির ব্যাপারে সংবিধানের ধারা উপধারা ও সরকারী ঘোষণা কেবল কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল।

পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাগণ এমন এক কারিকুলাম তৈরী করেন যা সংবিধানের মৌল চেতনার পরিপন্থী। তাঁরা ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকীদা বিশ্বাস ও দেবদেবীর কাহিনী (Mythology) দ্বারা পাঠ্যক্রম ভর্তি করে দেন। পৌত্তলিক চিন্তাধারা ও বিশ্বাস কুরআনের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা, তাওহীদ ও রাসুলুল্লাহর (সা.) আদর্শের পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক। পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা করলে সহজে বুঝা যায় এর প্রণেতাগণ ভারত বর্ষের মতো বহুধর্মের দেশকে ব্রাহ্মণের দেশ মনে করেছেন এবং ব্রাহ্মণ্যপ্রীতিকে বিবেচনায় রেখেছেন। তারা দেবতা, অবতার, উৎসব, মেলা, মন্দির, তীর্থকেন্দ্র, উপনিষদীয় রীতি-পদ্ধতিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

অধ্যয়নের জন্য যেসব গ্রন্থ নির্ধারিত হয়েছে তাতে একটি বিশেষ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জীবন কাহিনী সন্নিবেশিত হয়েছে যাতে ছাত্র- ছাত্রীগণ নিজেদের অতীত ইতিহাসের সাথে সম্যক পরিচিতি লাভ করতে পারে। পাঠ্যপুস্তক রচয়িতাগণ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পরিকল্পিতভাবে ইসলামী ব্যক্তিবর্গের আদর্শ ও ইতিহাস বর্ণনাকে উপেক্ষা করে গেছেন। ইসলামের চৌদ্দশ' বছরের ইতিহাসে কোন আধ্যাত্মিক সাধক, ন্যায়পরায়ন শাসক, বিজ্ঞ সংবিধান প্রণেতা, অকুতোভয় সমর কুশলী ও প্রাজ্ঞ পন্ডিত তাঁরা পাননি, যাদের জীবন ও কর্ম পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অথচ ভারত বর্ষের আনাচে-কানাচে এমন সব ইসলামী ব্যক্তিত্ব জন্ম লাভ করেন, যাদের নিয়ে ভারত বর্ষ রীতিমত গর্ব করতে পারে। এসব প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতীয় ইতিহাসের রত্ন। তাঁদের আলোচনা ও জীবন কর্মের ইতিহাস ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সাহস ও কর্ম শক্তি যোগাতে পারতো। বস্তুতঃ পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাগণ মুসলিম যুগের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের শিক্ষা ও ইতিহাস ক্যারিকুলামের অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিদেশী ও অপরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করেছেন। যদি কোথাও কোন ইসলামী ব্যক্তিত্বের আলোচনা আসে তাও এমন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয় যাতে তাঁর অমর্যাদা মানহানি ঘটে।' মানবতার বন্ধু, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে এমন অশালীন ও অজ্ঞতাপূর্ণ বক্তব্য কিছু কিছু পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়, যা ঐতিহাসিক বাস্তবতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং অজ্ঞতা ও বিদ্বেষ প্রসূত। এসব আপত্তিকর আলোচনা ভারতীয় মুসলমানদের সাথে অবিচারের শামিল এবং এতে তাদের ধর্মীয় অনুভূতি প্রচন্ডভাবে আহত হয়। বহুস্থানে।

মুসলমানদের 'জঘন্য' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যার অর্থ হচ্ছে অপরিচ্ছন্ন, অস্পৃশ্য, নীচ ও বিদেশী। এ ধরণের আপত্তিকর পুস্তক পাঠ্য তালিকায় সন্নিবেশ এবং মুসলমানগণ সহ সব ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বাধ্যতামুলক করণ স্পষ্টভাবে মুসলমানদের সাথে না ইনসাফীর শামিল এবং তাদের অনুভূতি ও অধিকার লঙ্ঘণের নামান্তর। এটা মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংহতি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকারের প্রতি প্রচন্ড ধরণের হুমকী। অথচ মুসলমানগণ ভারতবর্ষকে নিজের মাতৃভূমি মনে করেন, এখানে স্থায়ী বসবাসের ইচ্ছে পোষণ করেন এবং এদেশের সেবা ও উন্নয়নে নিজেদের শ্রেষ্টতম মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর ব্রত নেন।

শিক্ষা পদ্ধতি মুসলিম সন্তান সন্ততিদের দ্রুত ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক নৈরাজ্যের অতলপঙ্কে নিক্ষেপ করবে এ আশঙ্কা অমূলক নয়। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে উদাসীন এমন সব মুসলিম পরিবারে ইতোমধ্যে নতুন শিক্ষা পদ্ধতির মারাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব পরিবারের সন্তানগণ উদারভাবে অনৈসলামিক ও পৌত্তলিক শিক্ষা ও রীতি গ্রহণ করতে শুরু করেছে। সত্যিকার

অর্থে এটা মুসলমানদের জন্য বড়ই উদ্বেগের বিষয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক অধঃপতনের ইঙ্গিতবাহী। বর্তমান পরিস্থিতি সন্দেহাতীতভাবে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ক্লেশকর। 

হিজাব নিষেধাজ্ঞা ও মুসলিম পরিচয়ের উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ

২০২২ সালে কর্ণাটকের একাধিক কলেজে মুসলিম ছাত্রীদের শুধুমাত্র হিজাব পরার কারণে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়—এই ঘটনা যেন আধুনিক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীকচিহ্নে এক গভীর আঁচড় কেটে দেয়। হিজাব ইসলামি শরিয়তের একটি মৌলিক অংশ—এটি কোনো ‘ঐচ্ছিক’ পোশাক নয়, বরং এক মুসলিম নারীর আত্মমর্যাদা, লজ্জাশীলতা (হায়া), ও আল্লাহর নির্দেশ পালনের বহিঃপ্রকাশ। কুরআনে বলা হয়েছে:

"হে নবী! তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুমিন নারীদের বলে দাও—তারা যেন নিজেদের ওপর চাদর (জিলবাব) ডেকে নেয়। এটি তাদের চেনার জন্য এবং যাতে তারা হেনস্তার শিকার না হয়।"

(সূরা আহযাব ৩৩:৫৯)

অথচ আজকের ভারতবর্ষে হিজাবকে ‘বিভাজনমূলক চিহ্ন’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, যেন এটি নাগরিকতার পরিপন্থী। বাস্তবে, এটি মুসলিম নারীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার একটি সাংবিধানিক বিচ্যুতি। সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারা স্পষ্টভাবে প্রত্যেক নাগরিককে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা প্রদান করে, কিন্তু হিজাব নিষেধাজ্ঞা সেই অধিকার হরণ করছে। এই পরিস্থিতি শুধুই ধর্মীয় নয়, এটি জেন্ডার এবং শ্রেণি বৈষম্যকেও পুনরুৎপাদন করছে—কারণ গ্রামীণ মুসলিম পরিবারগুলো অনেক সময় মেয়েদের ধর্মীয় পরিবেশ ছাড়া পাঠাতে ইতস্তত করে, ফলে হিজাব নিষিদ্ধ হলে তাদের শিক্ষা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

এ প্রেক্ষিতে, প্রতিরোধের পথ শুধুই স্লোগান নয়—এটি একটি ধারাবাহিক ও বহুমাত্রিক আন্দোলন। প্রথমত, মুসলিম সমাজের অভিভাবক, আলিম ও সমাজকর্মীদের উচিত শিক্ষিত, যুক্তিবাদী এবং দৃঢ়চেতা ছাত্র-ছাত্রীদের তৈরি করা, যারা ইসলামি রীতিনীতি ও সাংবিধানিক অধিকার—দুই-ই রক্ষা করতে সক্ষম হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রয়োজন আইনি সংগ্রাম—ভারতের সংবিধানিক আদালতে হিজাব সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে তুলে ধরা, এবং স্পষ্টভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দাবি করা। তৃতীয়ত, মুসলিমদের উচিত একতা বজায় রেখে সংগঠিত নাগরিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া, যাতে সমাজকে বোঝানো যায়—হিজাব মুসলিম নারীর দমন নয়, বরং তার সম্মান ও আত্মনিয়ন্ত্রণের চিহ্ন।

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তরুণদের বড় দায়িত্ব—তারা যেন তথ্য, কুরআনের আলো এবং যুক্তি দিয়ে সমাজে সচেতনতা গড়ে তোলে। যারা ‘নারীর স্বাধীনতা’র কথা বলে, তারা যেন নিজের চোখেই দ্বিমুখীতার মুখোমুখি হয়—কেন একজন নারী বিকিনি পরতে পারে, কিন্তু হিজাব পরতে পারবে না?

সবচেয়ে বড় কথা, ইসলামী দৃষ্টিকোণে প্রতিরোধ মানেই সংঘর্ষ নয়—বরং জ্ঞান, ধৈর্য, যুক্তি, এবং সাহসিকতার মাধ্যমে অন্যায়কে রুখে দেওয়া। হিজাবের লড়াই কেবল একটি কাপড়কে ঘিরে নয়—এটি “তুমি কে”—এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম। যে জাতি নিজেকে ভুলে যায়, ইতিহাস তার কথা ভুলে যায়। তাই এই সংকট এক নতুন আত্মসচেতনতার ডাক।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter