হযরত গৌসুল আজম (রহঃ) একজন ফকীহ হিসেবে
এটি একটি সর্বসম্মত সত্য যে, কেউই সেই সময় পর্যন্ত আল্লাহর ওলীদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না, যতক্ষণ না সে কুরআন ও সুন্নাহর একজন প্রকৃত আলেম হয়। যদি কেউ শরিয়তের জ্ঞান না রেখেও নিজেকে “ওলী-ই-কামিল” বলে দাবি করে, তবে নিশ্চিতভাবে সে মিথ্যাবাদী, কারণ ইসলামী জ্ঞানের ব্যতীত কোনো সালিক কখনও আল্লাহর মারিফতের পর্যায় অতিক্রম করতে পারে না। সবাই জানে, এই পথ কতটা বিপদসংকুল — কতজন যে এই পথে হারিয়ে গেছে, তার হিসাব নেই। অনেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ধূর্ত চালে পড়ে নিজেদের ঈমান হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আল্লাহর প্রিয় বান্দারা, যারা ইসলামী জ্ঞানের অমূল্য ভাণ্ডারে সজ্জিত ছিলেন, তারা ইবলিসের ফাঁদ চিনে ফেলেছিলেন, এবং আল্লাহ তাআলার সাহায্য ও নিজেদের জ্ঞানের ভিত্তিতে সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। আজ আমাদের সমাজে দুটি বড় অনাচার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রথমত, ভণ্ড ও নামধারী পীরদের এমন ছড়াছড়ি হয়েছে যে, গলি-গলি এই প্রতারকরা সাজসজ্জাসহ নিজেদের মূর্খ মুরিদদের ঘরে ডেরা বেঁধে থাকে, আর সরল-সাধারণ মানুষ তাদের ধোঁকায় পড়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, যারা প্রকৃত অর্থে আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাদের মর্যাদাসম্পন্ন জীবনকে শুধু করামাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
যেমন আজ যখন আমাদের মনে “পীরানেপীর” হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর নাম আসে, তখন সাধারণ মানুষের চিন্তায় কেবল তাঁর করামাতই ভেসে ওঠে। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সকলেই তাঁকে “বড় পীর সাহেব” নামে স্মরণ করে। আফসোস! যদি আমরা তাঁর করামাতের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জ্ঞান ও ফিকহি জীবনও পড়তাম ও শোনাতাম, তাহলে সমাজে নবী করিম ﷺ-এর দ্বীনি জ্ঞান অর্জনের প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ সৃষ্টি হতো।
সাইয়্যিদুনা গৌসুল আজমের জ্ঞান ও ফিকহি মর্যাদা
ওলীদের ওলী, নির্বাচিতদের ইমাম, আধ্যাত্মিক কেন্দ্রের কেন্দ্রবিন্দু, গৌসুল আজম সাইয়্যিদুনা শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) যেভাবে তরিকত ও মারিফতের ইমাম, ঠিক সেভাবেই তিনি শরিয়তের মাসআলা-মাসাইল এবং কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানে অতুলনীয় প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন এক মহান ফকীহ, মুফাসসির, মুদাক্কিক, মুহাদ্দিস ও মনীষী। তিনি সারাজীবন ইলমে ফিকহ ও ফতোয়া লেখার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর দরবারে হাজার হাজার তলিবে ইলম ফিকহ শিখতে আসত।
ইমাম আহলে সুন্নত, সাইয়্যিদি আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান ফাজিলে বেরেলভী (রহঃ)-এর একটি শের থেকেই বোঝা যায় যে, সাইয়্যিদুনা গৌসুল আজম (রাঃ) কত বড় ফকীহ ছিলেন।
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (রহঃ) বলেনঃ
مفتی شرع بھی ہے قاضی ملت بھی ہے
علمِ اسرار سے ماہر بھی ہے عبد القادر
অর্থাৎ: “আবদুল কাদের (রহঃ) শরিয়তের মুফতি, উম্মতের ক্বাজি এবং গুপ্ত জ্ঞানেরও বিশেষজ্ঞ।”
আপনার দরবারে অসংখ্য ইস্তিফতা (ফতোয়ার প্রশ্ন) আসত, এবং আপনি সময় নষ্ট না করে নিজ হাতে কঠিনতম প্রশ্নেরও উত্তর প্রদান করতেন। যেমন বাহজাতুল আসরার গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, ইমাম আবুল ফারাজ আবদুর রহমান ইবনে ইমাম আবুল আলা নাজমুদ্দিন ইবনে হাম্বলী (রহঃ) বলেন—আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি:
“کان الشیخ محیی الدین عبد القادر رضی اللّٰہ عنہ، ممن سلم الیہ علم الفتاوی بالعراق فی وقتہ”
অর্থাৎ: “শায়খ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের (রাঃ) তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাঁদের যুগে ইরাকে ফতোয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।” (বাহজাতুল আসরার)
সাইয়্যিদি আলা হযরত ইমাম আহলে সুন্নত ফাজিলে বেরেলভী (রহঃ) তাঁর জ্ঞানের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন—
“الشیخ عبد القادر بحرُ الشریعۃ عن یمینہ و بحرُ الحقیقۃ عن یسارہ، مِنْ اَیِّھِما شاء اغترف السید عبدالقادر لاثانی لہ فی عصرنا ھذا رضی اللّٰہ تعالی عنہ”
অর্থাৎ: “শায়খ আবদুল কাদের (রহঃ) হলেন এমন এক সমুদ্র—যার ডান হাতে শরিয়তের সমুদ্র আর বাম হাতে হাকিকতের সমুদ্র। তিনি যেখান থেকে ইচ্ছা পানি গ্রহণ করেন। আমাদের এই যুগে সাইয়্যিদ আবদুল কাদেরের কোনো তুলনা নেই।” (ফতোয়া রেযভিয়া শরিফ)
একইভাবে বাহজাতুল আসরার-এ উল্লেখ আছে:
“کانت الفتاوی تأتی الشیخ محیی الدین عبد القادر رضی اللّٰہ عنہ، من بلاد العراق، وغیریہ، وما ر أیناہ یبیت عندہ فتوی لیطالع علیھا، أو یفکر فیھا، بل یکتب علیھا عقیب قراءتھا، وکان یفتی علی مذھبی الشافعی، و أحمد، وکانت فتاواہ تعرض علی علماء العراق، فما کان یعجبھم صوابہ فیھا أشد من تعجبھم من سرعۃ جوابہ عنھا“
অর্থাৎ: “সাইয়্যিদুনা শায়খ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের (রাঃ)-এর দরবারে ইরাকসহ অন্যান্য স্থান থেকে ফতোয়া পাঠানো হতো। আমরা কখনো দেখিনি যে, তিনি কোনো ফতোয়া নিজের কাছে রাতে রেখে পর্যালোচনা বা চিন্তাভাবনা করেছেন; বরং পড়া শেষ করেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর লিখে দিতেন। তিনি সাধারণত ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমদের (রহঃ) মাযহাব অনুসারে ফতোয়া দিতেন। তাঁর ফতোয়াগুলো যখন ইরাকের আলেমদের সামনে উপস্থাপন করা হতো, তখন তাঁরা যতটা তাঁর সঠিক উত্তরে বিস্মিত হতেন না, তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হতেন তাঁর উত্তরের দ্রুততায়।” (বাহজাতুল আসরার)
একবার ভাবো, সাইয়্যিদুনা গৌসুল আজম (রহঃ)-এর ফিকহি প্রজ্ঞা কত গভীর ছিল! আল্লাহ তাআলা তাঁকে এমন জ্ঞান ও দক্ষতা দান করেছিলেন যে, যত কঠিন মাসআলাই হোক, আপনি সঙ্গে সঙ্গে তার সমাধান লিখে দিতেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঠদান ছাড়াও আপনি ফতোয়া লেখার কাজ করতেন। কিন্তু আজ আমরা হযরত গৌসুল আজম (রহঃ)-কে কেবল করামাতের সীমায় আবদ্ধ করে ফেলেছি।
আজকের সমাজে অত্যন্ত প্রয়োজন—সাইয়্যিদুনা গৌসুল আজম (রহঃ)-এর জ্ঞানমূলক ও গবেষণাধর্মী অবদানগুলোকে উন্মোচিত করা, যাতে ছাত্ররা তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করতে পারে।
আমরা দোয়া করি—আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবাইকে হযরত গৌসুল আজম (রহঃ)-এর ফয়েজ ও বরকত থেকে উপকৃত ও আলোকিত করেন। আমিন, ইয়া রব্বাল আলামিন, বিজাহি সাইয়্যিদিল মুরসালিন ﷺ