কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(AI): অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ
কোটি কোটি প্রজাতির মধ্যে মানবজাতি বা হমোসাপিয়েন্সের সর্ব শ্রেষ্ঠতার একমাত্র কারণ হলো তার চিন্তাশক্তি। চিন্তাশক্তিই মানবজাতিকে সময়ের প্রতিনিয়ত চলমানে উন্নত করে এসেছে। কৃষিযুগ থেকে(AI) এর যুগের পথটা এত সহজ ছিল না। এই পথ অতিক্রম করতে শুধুমাত্র মানবজাতি হয়ে জন্মানো যথেষ্ট ছিল না, বরং এই কৃতিত্ব অর্জনের পথে রয়েছে লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিত্বের দিবারাত্রি পরিশ্রম। রয়েছে সময়ের যুগল ধরে উন্নততর চিন্তাশক্তির পরিণাম। রয়েছে প্রত্যেক জাতি, প্রদেশ ও সমাজের বহু অবদান। মানবজাতির সৃষ্টির হাত ধরেই শুরু হয় এই লম্বা যাত্রা, তারপর ইতিহাসের কতই না আরোহন ও অবরহন হয়। ভারতে হরপ্পাবাসীদের থেকে শুরু করে আর্য, নালন্দা, বুদ্ধ, মৌর্য, গুপ্ত, মুসলিম ও ব্রিটিশদের কতই না ওঠন-অবতরণ দেখলাম। বাহিরে গ্রীক রোমের মুসলিমদের হাতে পরাজয়ের পর ইতিহাসের বিভিন্ন বৈচিত্রের পরিলক্ষণ করলাম। যে আরব গোষ্ঠী কাল অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল আচম্বিত কয়েক দশক ধরে তার স্পেন থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প-চর্চায় কতইনা জাঁকজমক দেখলাম। দেখলাম কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ফ্রান্স, জার্মান ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের আশ্চর্যনিয় জাগরণ। অতঃপর ইতিহাসের পাতায় যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও ভাবনাচিন্তার নামে বজ্রবিদ্যুৎসহ মুষলধার ঘটনার লক্ষণ হয় তা অগণ্য। ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত পৃথিবী যেন সাম্রাজ্যবাদী ও শক্তির রোগে আগ্রস্ত ছিল। রাশিয়া ও আমেরিকার নামে পৃথিবী যে দুই বা তিন খন্ডে খন্ডিত হয় তার প্রতিফলতার কথাও অজানা নয়। তবুও কিছু দশক অব্দি মনে হচ্ছিল ইতিহাস যেন এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এদিকে প্রযুক্তি, সাহিত্য ও শিল্পী বিভিন্ন পথে উন্নতির পর উন্নতি করতে থাকে। নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মতো মৌলিক অধিকারকে ধাপ করে উন্মোচন হয় আধুনিকতা, অত্যাধুনিকতা ও গ্লোবালাইজেশন এর মত যুগ। অবশেষে আশ্চর্যপূর্ণভাবে ইতিহাস নতুন রূপ নিতে চলেছে। উন্মোচন হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। নতুন কিছু যা কখনো হয়নি। সত্যি ও মিথ্যার বিবেচনা যেখানে কঠিন হবে। ডিপফেকের মতো মৃত অপরাধীদের রাজত্ব চলবে। এক কথায় মানবজাতি এবার ভয়ংকর ভাবে হোঁচট খাবে। অনেকই জলের ঢেউয়ে তলিয়ে যাবে। আর যারা সমুদ্র তীরে উঠতে চাইবে তাদের খুঁজতে হবে নতুন দিশা, নতুন নাঙ্গর ও নতুন চিন্তাধারা যা তাকে সর্বদা সর্বশ্রেষ্ঠ বানায়।
প্রযুক্তি অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ এ বিষয়ে নবম শ্রেণী হতে প্রবন্ধের উপর প্রবন্ধ লিখে আসছি। একটি মুদ্রার যেমন দুই দিক থাকে, ঠিক তেমনি কোন বিষয়ে দুইটি মতামত থাকাটাই বাস্তব। কিন্তু কোন সমুদ্র কতগভীর তা আলোচনার পরেই বোঝা যায়। প্রযুক্তির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টিও গভীর আলোচনার বিষয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কত শক্তিশালী হতে পারে তার একটি উদাহরণ ছিল চ্যাট জিপিটি, যেখানে হাজার হাজার প্লাটফর্ম গুলি আকর্ষণের দ্বন্দ্বে পারস্পরিক ঠান্ডা যুদ্ধে লিপ্ত। যেখানে অন্য সোশ্যাল প্লাটফর্ম গুলিকে এক মিলিয়ন এর মাইলফলক ছুঁতে বছর খানিক সময় লেগেছে সেখানে চ্যাট জিপিটি মাত্র পাঁচ দিনে এই লক্ষ্যে পৌঁছেছে। উল্লেখ্য বিষয় এটাও যে মাত্র ৪০০ মেধাবীব ব্যক্তির কর্মের ফল হলো চ্যাট-জিপিটি, আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য জনগণের হয়রানির একমাত্র কারণ এই যে এটি নিজেকে নিজ হাতে উন্নত করতে পারে যাকে মেশিন লার্নিং বলে। অর্থাৎ কাল যে চারশো জন ব্যক্তি মিলে তাকে তৈরি করেছে আজ সেই কোম্পানিতে তাদেরও প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র একটি কোম্পানির ফল হল চ্যাট-জিপিটি, ভাবার বিষয় যে, সোশ্যাল মিডিয়ার জগতের ন্যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পিছে যখন হাজার হাজার কোম্পানির প্রতিযোগিতা হবে তখন কত উন্নত হতে পারে এই জগত।
এছাড়া AI যে এত দ্রুত বৃদ্ধি হচ্ছে তা দেখেই ভবিষ্যতে এর প্রভাবের চিত্র আঁকা যাই। ২০২২ এর শেষের দিকে(AI) এর বুদ্ধি ক্ষমতার বয়স ছিল অনুমানিক ৭ বছর, যা কিছু মাস পরে 2023 এর প্রথম দিকে নয় পর্যন্ত পৌঁছায়। চিন্তার বিষয় যে, যার বুদ্ধিশক্তি কিছু মাসে দুই বছরের ন্যায় উন্নত হতে পারে, সে যখন প্রতিযোগিতার মূল বিষয় হবে তখন কত উন্নত হতে পারে।
কিছু বছর আগে পর্যন্ত মনে করা হচ্ছিল যে এটি নীল কলার লেবারদের কাজকর্ম চুরি করবে, কিন্তু উল্টো সর্বপ্রথম AI সাদা কালারওয়ালা অফিসারদের কাজকর্ম চুরি করছে। যেখানে কোনো কোম্পানি কৃত্রিম বুদ্ধির সাহায্যে ফটোগ্রাফি তৈরি করতে পারবে, সেখানে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ডিজাইনার ক্যামেরাম্যান ও মডেলদের দিয়ে কেন কাজ করাবে। ভয় আরো এক জায়গায় স্পষ্ট ভাবে নাড়া দিচ্ছে সেটা হলো ডিপফেকের ভয়। কিছু বছর আগে বেরাক ওবামার মত অনেক ভিডিও খুব ভাইরাল হয়, যা দিপফেকের সাহায্যে জনগণকে সন্দেহের ধোঁয়াশায় ফেলার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। ভেবে অবাক লাগে যদি জনসাধারণের হাতে এই টেকনোলজি আসে তো অবস্থা কত দুরূহ হতে পারে। আর এক বিশেষ ভয় উপচে আসছে, সেটা হল মানুষ জাতি কি আর মনুষ্যত্বের সংজ্ঞায় বেঁচে থাকতে পারবে?, নাকি আমরা (মানুষজাতিও) নিজের মূল্য ভুলে অন্য জীবজন্তুর ন্যায় হয়ে উঠবো। আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই, যখন মানবজাতিকে কোটি কোটি জীবজন্তুর মধ্যে বিজয় প্রাপ্ত হওয়া হোমোস্যপিয়েন্স ভাববো, আর তার ধর্ম, বিশ্বাস ও ব্যবহারকে মনগড়া গল্প বলে উপস্থাপন করব, তখন একটি মূল্যবান মানুষের জীবনকে কুকুরের রূপদান করার মত দৃষ্টান্ত জাপানের মত সমস্ত পৃথিবীতে দেখতে পাওয়ার সময় খুব নিকটবর্তী। অবশেষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তের উন্নতি যে গতিতে হচ্ছে তাতে ভয় চারিদিকে সৃষ্টি হচ্ছে, উঠে আসছে অনেক নিত্য-নতুন প্রশ্ন, সম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদ পদ্ধতি থেকে আলাদা এই নতুন সমাজ কেমন হবে। রয়েছে আরও প্রশ্ন, এই যুগ পারবে কি মানবজাতির মূল্যবান চিন্তা শক্তিকে দমন করতে। পারবে কি মৃত্যুকে বধ করতে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত এই যুগের ভিত্তি স্থাপনের মূল্য কি হবে।
অপরদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগ উন্মুক্ত করবে অনেক নতুন দরজা। মানবজাতিকে খুঁজতে হবে অনেক নিত্য নতুন সুযোগ। যারা নিজের জীবনের মূল্য ভুলে গিয়ে বছরের পর বছর মেশিনের ন্যায় জীবন যাপন করছিল, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে নিজের জীবন। তালাশ করতে হবে কিছু সৃজনশীল কাজকর্ম, কিছু মূল্যবান, কিছু স্বার্থক, যা মানুষকে মনুষ্যত্ব দান করে। কিছু চিন্তামূলক, যা মানব জাতিকে তুলনামূলক সমস্ত জীবজন্তু থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বানায়।
প্রত্যেক বুদ্ধিমত্তা অন্য মেশিনের ন্যায় একটি জড় পদার্থ, এই ভাবনাটা পুরোপুরি বেঠিক। এটি একটা এমন মেশিন যা নিজে ভাবতে পারে, চিন্তা করতে পারে ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দীর্ঘ সময় থেকে প্রিন্টার শুধুমাত্র উদাহরণস্বরূপ বাইবেলের প্রিন্ট করে আসছিল এবার এই মেশিন বাইবেলের ব্যাখ্যা করতে পারবে। দীর্ঘ সময় ধরে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা সর্বাধিক ছিল এবার কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাই পারবে এই সমস্ত শূন্যস্থান পূরণ করতে। মানবিক বুদ্ধির তুলনায় কৃত্রিম বুদ্ধি যদি আমার আপনার বাড়ির ডিজাইন তৈরি করতে পারে, সঠিক ওষুধের পরামর্শ দিতে পারে, তবে মানবজাতি কোন দিকে সর্বাধিক আকর্ষণীয় হবে। যাই হোক মানবজাতিকে নতুন যুগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, তৈরি করতে হবে এমন কিছু যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা অসম্ভব, নয়তো আমাদেরকেও আগামীকাল তেমনভাবেই হয়তো ব্যবহার করা হবে যেমন ভাবে আমরা ইঁদুর ও ব্যাঙের সঙ্গে আজ ব্যবহার করি। নাজিবাদ ও কমিউনিজমের মতো ভুল সিদ্ধান্তের কোন অবকাশই দেওয়া যাবে না, মনে রাখতে হবে এটি অস্তিত্বের লড়াই।
 
  
             
            
                     
            
                     
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
             
            
             
            
             
            
            