ধর্ম না রাজনীতি?
বিগত কয়েকদিন পূর্বে বিজেপি সাংসদ সদস্যরা আবার বঙ্গভঙ্গের শ্লোগান তুলেছেন। ঝারখান্ডের গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে দাবি করেন যে মুর্শিদাবাদ, মালদা ও বিহারের তিন জেলা কিষানগঞ্জ, আরারিয়া এবং কাটিহারকে নিয়ে গঠিত হোক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। আবার বাংলার বিজেপি দল সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও অনন্ত মহারাজ উত্তরবঙ্গকে পৃথক এক রাজ্য হিসেবে দেখতে চান। সুকান্তের সাথে সুর মিলিয়ে দার্জিলিং-এর বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তার দাবি বাংলার মধ্যে রেখেই উত্তর-পূর্ব ভারতের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হোক। এমনই করেই বিজেপি হিন্দুত্ববাদী নেতারা সেই ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিকেই আপন করে নিয়েছে। এবং সেই নীতি অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। সেই প্রথমবার ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবার বড়লাট লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব দেয় কিন্তু হিন্দু মুসলিমদের মিলন বন্ধনের আন্দোলনের ফলে পরিশেষে ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর পঞ্চম জর্জকে দিল্লি দরবারে এই আইন ফিরিয়ে নিতে হয়। ও বঙ্গ পূনরায় এক থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সেই বাংলাকেই আবার ১৯৪৭ সালে দ্বিখন্ডিত করা হয়। যার মূল কারণ ছিল কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিম নেতাদের দেশের স্বার্থের উপরে রাখা নিজের ও দলের স্বার্থ। তারা জনসাধারনের মনে দ্বিজাতি তত্বের একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করেছিল যে, পাকিস্তান মুসলিমদের এবং ভারত হিন্দুদের। ভারত যে হিন্দু মোসলমানের সবার এটা প্রচারে আসেনি। হিন্দু বা মুসলমান যে কোনও পৃথক জাতি নয়, বরং কেবলই এক ধর্ম তা প্রচারে আসেনি। ফলে বাস্তবে ভারত নামে দেশটাকে পঙ্গু হয়ে জন্মাতে হয়েছিল এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘায়ে, আর জন্মমুহূর্তেই তাকে ঘোর অসুখ বলে মেনে নিতে হয়েছিল। আজ সেই ধর্ম রাজনীতিরই ধারক-বাহক-প্রচারকরা এসে বাংলাকে গিলে খাওয়ার পূনারায় স্বপ্ন দেখছে ।
কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী? ধর্ম না রাজনীতি? আদৌ কী জিন্না-নেহেরুর মতো নেতারা এই ধর্মের জন্য দেশ ভাগ করেছিল? বাস্তবেই কী সেই বঙ্গভঙ্গ ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছিল না রাজনীতির ভিত্তিতে? এবং বর্তমানেও কী সেই ধর্মের নামেই বিজেপি বাংলা ভাগ করতে চাইছে না রাজনীতিরই জেরে?
এই সমুদয় প্রশ্নগুলির উত্তর কিন্তু একই হবে যে প্রকৃতভাবে এমনটি কখনোই ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি বরং সকল কিছুই রাজনীতির ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যেই ঘটেছে ও ঘটছে। সকল কিছুই কেবল নিজের ও দলের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্যই এমনটি করে চলেছে। যদিও বা নেতারা মুখে ধর্মের ভিত্তিকেই দাবি করেছিল বা বর্তমানে করে চলেছে। যদি সত্যিই ধর্মের ভিত্তিতেই হতো তবে বাংলাদেশের জন্মই বা কেন হয়েছিল? বাঙালিরা কী মুসলমান ছিল না? এবং বর্তমানে বিজেপি এই বছর লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গে পূর্বের চেয়ে ৬টি সাংসদ পদ হারিয়েছে। এমনকি তারা অযোধ্যাতেও তারা নিজস্ব রাজ হারিয়ে ফেলেছে অথচ তারা সেইখানেই নাকি বাবরি মসজিদকে ধূলিসাৎ করে রাম মন্দির নির্মাণ করেছে। একই ভাবে তারা যেখানে চারশো পার শ্লোগান লাগাচ্ছিল সেখানে তারা ফল পেয়েছে কেবল ২৪৩। যারফলে তারা অদ্য চোখে সর্ষে ফুল দেখতে পাচ্ছে। এরই হেতু তারা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পূনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য ধর্মকে কেন্দ্র করে সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুলকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু একটু চিন্তার বিষয় যে, তাদের যদি ধর্ম ভিত্তিই সত্যি হয় তবে কেন তারা এত অসাড় হয়ে পড়ল? ভারত কী হিন্দু সংখ্যাগুরু দেশ নয়? আসলে ধর্মের একটা মূল অর্থ যা ধারণা করা হয়- কোনও লক্ষণ, প্রকৃতি বা গুণ, যেমন আগুনের ধর্ম দহন করা, বরফের ধর্ম যেমন শৈত্য। মানুষের ধর্ম কী? সব মানুষ এক দেবতার আরাধনা করে না, অনেকে কোনও দেবতারই নয়। কিন্তু সকলের মধ্যে অধিষ্ঠিত আর এক ধর্ম, মৌলিক স্তরে মানুষের ধর্ম। আর কী আশ্চর্য, মানুষের হাজারো হিংসা-অন্যায়-পাপাচারের দৈনন্দিন প্রকাশ সত্বেও সেই নিহিত ধর্মের সংজ্ঞা মানবচরিত্রের শুভ ও মহৎ লক্ষণের নিরিখে- তাকেই বলি মানুষ্যত্ব, বলি মানবিকতা। মানবধর্মের উৎস কিন্তু অভিন্ন মৌলিক মানুষ্যত্বে। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ বক্তৃতামালায় বলেছেন, “বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব”। বিবেকানন্দের কথা- “হিন্দুধর্ম তো শিখাইতেছেন- জগতে যত প্রাণী আছে, সকলেই তোমার আত্মারই বহু রূপ মাত্র। সমাজের এই হীনাবস্থার কারণ, কেবল এই তত্বকে কার্যে পরিণত না করা, সহানুভূতির অভাব, হৃদয়ের অভাব”। চতুর্দিকে চিৎকৃত ধর্মের সবচেয়ে প্রকট উপাদান বিরোধ, বর্জন ও সহিংস দমন। পৃথক আছে বলে কাউকে ঘৃণা করছি, কিন্তু সে কাছে আসতে চাইলে তাড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু শুনো হে মানুষ ভাই, সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। যারা মুসলমান, তাদের গাঁয়ে আঁচড় দিলে যে রক্ত বের হবে, সেটাও নমঃশূদ্র রক্ত। তবে কেন এত বিভেদ-বিদ্বেষ? মানুষ্যনির্মিত সেই প্রাচীর আছে বলে, যা সকল বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ। যাকে অপর কথায় বলে ধর্ম। তাই তো এই প্রসঙ্গে ২০২৩ সালের বাংলা বিভাগের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার প্রাপক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ‘জলের উপর পানি’ উপন্যাসে উল্লেখিত করেছেন, হিন্দু আর মোসলমান/ একই রক্ত একই জান/ দুনিয়াতে পইদা হইছ নিজ দোষে মইরো না/ দড়ি দিয়া বাইন্ধা রাখো, টানাটানি কইরো না।
বাঙালি জাতীয়তাবোধ ১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হওয়া আটকাতে পারেনি, কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া দেশ পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়েছে ১৯৭১-এ। তাই তো এর পূর্বে যখন সুভাষ ঘিষিং দার্জিলিংকে গোর্খাল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি করেছিল অথচ বাঙালিরা তাতে শেষ পর্যন্ত সফল হতে দেয়নি।
ঠিক তেমনই এইবারও বাঙালিরা এই ঝড়তুফানের মুখোমুখি হয়ে এক কঠিন জবাব দেবে যে বাঙালি বলতে কী? বাঙলিরা জানে এ বছর ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ৭৭ বছর হতে চলেছে কিন্তু বিজেপি নেতারা তা ভুলে স্মরন করছে সেই দেশভাগের ৭৭বছর। তারা ভুলে যাচ্ছে যে ভারত এক গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তারা ভুলে যাচ্ছে মানুষের ধর্মের মূল লক্ষ্য হলো মানবতা, সমাজের কল্যাণ, মানুষের হিতকর্ম। আর এমনটিই তো সকল ধর্মেরই মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য। তারা ভুলে যাচ্ছে রাজনীতি শাসন গণতন্ত্র হচ্ছে জনগনের সরকার, জনগনের জন্য, জনগনের দ্বারা। তারা ভুলে যাচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তা ধর্ম, ভাষা, জাতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। ভারতীয় জাতীয়তা একটি ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সেটা হল, ভারত এক চিরস্থায়ী ভূমি, যার উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীন সভ্যতা থেকে, যার অভিন্ন ইতিহাস টিকে আছে বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের জেরে। ভারতের বহুত্ববাদের মধ্যে একতার যে মহান ঐতিহ্য, যা দেশের মানুষের জাতিগত, ভাষাগত এবং সম্প্রদায়গত ভিন্নতাকে একটা সুরে বেঁধে রেখেছে, সেটা ক্রমশ এক কেন্দ্রীভূত জাতিবাদী রাষ্ট্রের ভাবনায় রূপান্তরিত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। যার মূল উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন। তাদের মনে রাখা উচিৎ যে ভারতের বহুত্ববাদ ঠিক থালার মতো, যেখানে বাটিতে বাটিতে নানা পদ থরে থরে সাজানো থাকে। এর প্রতিটির স্বাদ ভিন্ন, যা অন্যটির সঙ্গে ঠিকঠাক খাপ খায় না। কিন্তু তারা একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। তারা ভুলতে চলেছে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বিদ্বেষের মধ্যে অনৈক্য। সুতরাং, সকলেই পুনরায় হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সৌহার্দ ভ্রাতৃত্বেরর বন্ধনে আটুট হয়ে সেই সমুদয় ভুলে যাওয়া বিষয়গুলিকে তাদের স্মরণে করিয়ে দিই যে বাঙালি বলতে কেবল মুসলিম নই, হিন্দু নই, জৈন নই, বৌদ্ধ নই বরং বাঙালী বলতে এক ভারতীয় জাতি। যেমনটি কোনো এক লেখক দাবি করেছেন যে, ধর্মবিকার নাশি/ ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি।/ ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,/ এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।