ইসলামের দৃষ্টিতে কবি ও কবিতা

ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে আরবদের রচিত কবিতাসমূহ ইতিহাস ও সাহিত্যের গ্রন্থে আজও বিদ্যমান। সংখ্যার দিক দিয়ে যা নিতান্ত কম নয়। সে যুগের প্রতিটি ঘটনার সাথে জড়িত অসংখ্য কবিতা আমরা দেখতে পাই। এমন কোন ছোট বড় ঘটনা নেই যার সাথে জড়িয়ে কোন পাওয়া যাবে না। রাসুলুল্লাহ সা. এর আবির্ভাবে ও তার ইসলামের দাওয়াত ছিল সে সময়ের বৃহত্তম ঘটনা। এ দাওয়াত তাদেরকে অস্ত্রধারণে বাধ্য করে। আরববাসী মুমিন ও মুশরিক এ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যারা সত্যিকারভাবে ইমান এনেছিলেন এবং যারা তাদের প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্মের পক্ষে প্রতিরোধ খাড়া করে আল্লাহর পথের প্রতিবন্ধক হয়েছিল এদের উভয়ের কার্যাবলীর বর্ণনা সে যুগের কবিতায় রয়েছে। অবশেষে আরব উপত্যকায় ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হল। তবে আবু বকর রা. এর খিলাফতকালে কোন কোন গোত্র ইসলাম পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেল। আরব উপদ্বীপে আবারও যুদ্ধের দাবানল প্রজ্জলিত হয়ে ওঠে। এসব যুদ্ধের চিত্রও সমসাময়িক কবিদের কবিতায় সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। এরপর এলো ধারাবাহিক বিজয়। আরবরা ইসলামের মশাল হাতে নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মুখে তাদের জেহাদের সঙ্গীত উচ্চারিত হত। উসমান রা. এর হত্যাকাণ্ড, আলি রা., তালহা রা. যুবায়র রা., ও আয়িশা রা. এবং আলি-মুয়াবিয়া রা. এর সংঘর্ষ প্রতিটি ক্ষেত্রেই কবিরা উচ্চকিত হয়ে ওঠে। কবিতার ভাষায় তারা চিৎকার করে ওঠে। 

এছাড়া এ যুগে বহু কবি কেবলমাত্র বিশেষ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নয়; বরং নিজ ব্যক্তিসত্তা ও গোত্রকে কেন্দ্র করেও ইসলামের আলোকে কাব্যচর্চা করেছেন। এ যুগে কবিতার গতি স্তব্ধ হয়নি বা পিছিয়েও পড়েনি। আর এমনটি হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, এ যুগের প্রায় সকল অধিবাসীই তাদের জীবনের বিরাট একটি অংশ জাহেলি যুগে অতিবাহিত করে। তাদের ভাষাগত জড়তাও কেটে গিয়েছিলো। আর কবিতার মাধ্যমে তারা তাদের চিন্তা ও আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে অভ্যস্ত হয়ে পরেছিল। ইসলামের আলোক প্রাপ্তির পরও তারা তাদের অভ্যাস অনুযায়ী কবিতা চর্চা করতে থাকে। একদিনের জন্যেও তাদের এ ধারা বন্ধ হয়েছে, এমন কোন প্রমাণ পাওয়া মুশকিল। কিতাবুল আগানী, তারিখে তাবারি, সিরাতে ইবনে হিশাম, আল-ইসাবাহ, আল-ইস্তিআব বা এ ধরনের তৎকালীন ইতিহাস ও সাহিত্যের গ্রন্থ পাঠ করলে এ কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। এসব গ্রন্থ পাঠে মনে হবে, সে সময়ের প্রতিটি জিহবা থেকে যে কবিতার ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এ সকল কবির কিছু কবিতা মুফাদ্দাল আদ-দাব্বী এবং আসমা’ঈ তাদের গ্রন্থে সঙ্কলন করেছেন। আর ইবনে কুতায়বা তার ‘আশ-শির ওয়াশ শুয়ারা’ এবং ইবনে সাল্লাম তার ‘তাবাকাতু ফুহুলিশ শুআরা’ গ্রন্থে এ যুগের শ্রেষ্ঠতম কবিদের জীবনী আলোচনা করেছেন। 

আরবি সাহিত্যের উল্লেখিত উৎসগুলি পাঠ করলে প্রতিয়মান হয়, ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে আরবদের কবিতা চর্চায় কোন অংশেই ভাটা পড়েনি; বরং তা যথেষ্ট উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভা করে। আর যারা বলে থাকেন, ইসলামের আবির্ভাবে কবিতার স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো বা এর ধারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাদের এ দাবী সত্যে অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাসুলুল্লাহ রা. কবিতার আসরে নিজে কবিতা শুনেছেন এবং কবিদেরকে তাদের সৃষ্টির উপর স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিদানও দিয়েছেন। আমরা জানি, মদিনার তিনজন কবি তার পাশে এসে দাঁড়ান এবং মক্কার মুশরিক কবিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর খাড়া করেন। এরা ছিলেন হাসসান বিন সাবিত, কা’ব বিন মালিক এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা। রাসুলুল্লাহ সা. এর জিবনের শেষ দুটি বছর, যা মূলতঃ প্রতিনিধি আগমনের বছর হিসেবে খ্যাত, আগত প্রতিটি প্রতিনিধিদলের সাথে তাদের বাগ্মী বক্তা ও কবিরা থাকত। বক্তারা আলোচনা করতো; আর কবিরা কবিতা আবৃত্তি করতো। আর রাসুলুল্লাহ সা. বক্তা ও কবিগণকে তাদের জবাব দিতেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবদের নিকট কবিতার গুরুত্ব কমে গিয়েছিল এবং তারা কাব্যচর্চা পরিত্যাগ করেছিল –এমন ধারণা যারা পোষণ করেন, তারা বলে থাকেন, কবিদের বিরুদ্ধে কুরআনের আক্রমণাত্মক ভূমিকার ফলেই এমনটি হয়েছিল। কুরআনে বলছেঃ “বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে থাকে। তুমি কি দেখতে পাও না, তারা প্রতিটি উপত্যকায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়? তারা বাস্তবে যা করে না তাই-ই মুখে বলে বেড়ায়। তবে যারা ইমান এনেছে, সৎ কাজ করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে অতিমাত্রায় তৎপর রয়েছে এবং অত্যাচারিত হলে নিজেদের আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হয়েছে তাদের সম্বন্ধে –এ কথা প্রযোজ্য নয়।“ (সূরা আশ শুআরা ২২৪-২২৭) 

এ আয়াতে কবিদের সম্বন্ধে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উপলব্ধির জন্যে আমাদের সামনে তৎকালীন আরব সমাজে কবিদের প্রভাব ও কার্যাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র থাকা প্রয়োজন। আরবে কবি একজন সেনাপতি, বিজেতা ও শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। কোন কবি শুধু তার ভাষার মাধ্যমে গোত্রের পর গোত্রকে ধ্বংস ও নামবিহীন করে দিত। অনুরূপভাবে কোন নাম-পরিচয়বিহীন একটি গোত্রকে মাত্র একজন কবিই খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিত। এ জন্যেই যখন কোন পরিবারে কোন কবির জন্ম হত তখন সব গোত্র থেকে অভিনন্দনবাণী আসতে থাকত; নিমন্ত্রণ দেয়া হত, স্ত্রীলোকেরা সমবেত হয়ে অভিনন্দন গীতি গেয়ে শুনাতো এবং কুরবানী দেওয়া হত।

আরবে কাব্য ছিল এক মহাশক্তি। কবির একটি পঙক্তিও বিফল হত না। ‘আমর ইবনে কুলসুমের এক কবিতা ‘তাগ্লাব’ গোত্রকে দু’শ বছর পর্যন্ত মর্যাদা ও বীরত্বের নেশায় বিভোর রাখে। সিফফিনের যুদ্ধে লায়লাতুল হারীরের দিনে আমীর মুয়াবিয়া হযরত আলী রা. এর সম্মুখ থেকে পালাবার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়েছিলেন, কিন্তু কয়েকটি পঙক্তি তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখে। রাসুলুল্লাহ সা. এর বিরুদ্ধে কাফিররা যে বার মদিনা আক্রমন করতো, তার মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ কবিরাই সংগঠিত করে। 

জাহেলি যুগের কবিরা ছিল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সাধারণ লোক সুখে-দুঃখে, আপদে বিপদে তাদের আদেশ উপদেশ মেনে চলতো। এ কবিদের অনেকে গোত্রে গোত্রে কলহ-বিবাদ, ঝগড়াফ্যাসাদ জিইয়ে রাখতো। তারা ফখর অথবা হিজা (কুৎসা) করে কবিতা রচনা করতো। এতে গোত্রের লোকেদের মধ্যে যুদ্ধের স্পৃহা প্রবল হত। তারা মদ, জুয়া, ও অশালীন আচরণের প্রশংসায় কবিতা রচনা করত। এভাবে মানব চরিত্রের অবনতিতে তাদের কবিতার বিশেষ অবদান ছিল। তখন পবিত্র কুরান এবং রাসুলুল্লাহ সা. নিজেও কবিদের এসব ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের নিন্দা করেছেন। মানব কল্যাণই যে মহাগ্রন্থ ও মহামানবের মূখ্য ব্রত তারা এধরনের ভাব বিলাসী ও অসংযামি কবি ও তাদের কবিতা অপছন্দ করবেন এটা স্বাভাবিক কথা। উল্লেখিত আয়াত দ্বারাই প্রমাণ হয় কুরান সেই সব মুশরিক কবিদের নিন্দা ও সমালোচনা করছে যারা রাসুলুল্লাহ সা. এর কুৎসা করে কবিতা রচনা করতো এবং তার দাওয়াতের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমগ্র কাব্য সাহিত্য এর উদ্দেশ্যে নয়; বরং যে কবিতা আল্লাহ ও তার রাসুলকে পীড়া দিয়েছে কেবলমাত্র তারই সমালোচনা করা হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হবার পর ‘আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, কা’ব ইবনে মালিক এবং হাসসান ইবনে সাবিত রাসুলুল্লাহ সা. এর খিদমতে কাঁদতে কাঁদতে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, কবিদের সম্বন্ধে এ আয়াত নাযিল হয়েছে এবং আমরা কবি।‘ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সম্পূর্ণ আয়াত পড়, ইমানদার, নেক্কারদেরকে বলা হয়নি।‘ তখন তারা নিশ্চিন্ত হলেন। একই উদ্দেশ্যে রাসুল সা. বলেনঃ ‘তোমাদের কারো পেটে (এমনি মন্দ) কবিতা থাকার চাইতে সে পেটে পুঁজ পরিপূর্ণ হয়ে তা পচে যাওয়া অনেক উত্তম।‘ আয়িশা রা. হাদিসটি শুনে বলেছিলেনঃ হুজুর সা. কবিতা দ্বারা ঐ সমস্ত কবিতা বুঝিয়েছেন যেগুলোতে তার কুৎসা বর্ণিত হয়েছে। অশালীন, অশ্লীল এবং ইসলামি মূল্যবোধের পরিপন্থী সকল কবিতাই এ হাদিসের অন্তর্ভুক্ত। 

উপসংহার 

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছে যে কবিতা আরববাসিদের জিবনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এবং সেই কারণে ইসলামে উত্তম ও সুঅর্থ সমৃদ্ধ কবিতার খেলাফে কোনরূপ আদেশ দেওয়া হয়নি তবে অশ্লীল কবিতা একটি সমাজকে অসভ্য করে তুলতে খুব বেশি ভূমিকা রাখে তাই ওইসব কবিতা ও কবিদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তার রাসুল সা. সরাসরি ও পরিস্কার ভাবে নিন্দা ও সচেতন করেছেন। কেননা একটি সাধারণ শিক্ষিত মানুষ যদি ধর্মের দিক দিয়ে নাও দেখে তবুও তার কাছে সমাজে খোলাখুলিভাবে অশ্লীল কথা ছড়িয়ে বেড়ানোকে সে অতি নিচ ও অসৎ কাজ রূপেই গণ্য করবে। আর ইসলাম যেহেতু শুধু একটি রূপকথার গল্পের মত যেরূপ অন্যন্য অনেক ধর্ম আজকাল অনেক দেখতে পাওয়া যায় ইসলাম তাদের মধ্যে একটি নয়। ইসলাম পরম ঈশ্বরের দিকে ডাকার সাথে সাথে মানুষকে একটি সভ্য জিবন যাপন করার জন্যও পথ নির্দেশনা করে। আর সেই জন্যই ইসলামকে আমরা মুসলিমেরা একটি পরিপূর্ণ ও সর্বোত্তম ও সত্য ধর্ম হিসেবে প্রচার।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter