সূরা আল-ফাতিহার চারটি প্রধান ফজিলত
ভূমিকা
সূরা আল-ফাতিহা কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা। এটি ইসলামের ভিত্তি, সত্যের সারাংশ, রোগের জন্য শিফা, দুশ্চিন্তার জন্য সান্ত্বনা, সুরক্ষা ও এক অদম্য দুর্গ। আল-ফাতিহা এমন এক অনন্য আসমানী ওয়াহী যা শেষ উম্মতের জন্য বিশেষভাবে নাজিল হয়েছে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মুসলিমগণ কমপক্ষে সতেরো বার এ সূরাটি তিলাওয়াত করেন। এর মাধ্যমে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে নিয়মিত এক সংলাপ স্থাপিত হয় এবং এটি সৃষ্টি জগতের হৃদয়ের জন্য নির্ধারিত চিকিৎসার মতো কার্যকরী। প্রথমত, সূরা আল-ফাতিহা কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। এর আধ্যাত্মিক গভীরতা ও আকীদাগত স্পষ্টতা অন্য সব সূরাকে ছাড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এর অবতরণ ছিল সম্পূর্ণ অনন্য; এটি ছিল নবীজি ﷺ-র উম্মাহর জন্য আল্লাহর বিশেষ উপহার। পূর্ববর্তী কোনো জাতিকে এ সূরার অনুরূপ কিছু প্রদান করা হয়নি, যা এর মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। তৃতীয়ত, এর তিলাওয়াত ছাড়া কোনো সালাত সঠিক হয় না। এটি দৈনন্দিন ইবাদতের অপরিহার্য অংশ এবং মুমিনের জীবনের আত্মিক ছন্দ নির্ধারণ করে। চতুর্থত, সূরা আল-ফাতিহা রোগের আরোগ্য ও চিকিৎসা হিসেবে কাজ করে —শরীরিক ও আত্মিক উভয় দিক থেকে। এতে কুরআনের সামগ্রিক নিরাময়ধর্মী প্রকৃতি প্রতিফলিত হয় এবং মুমিন আল্লাহর রহমত ও দিকনির্দেশনার উপর সম্পূর্ণ ভরসা স্থাপন করতে শেখে। এই চারটি ফজিলত বিশেষভাবে আলোচনা করা হবে, যেখানে সহিহ হাদিস ও আলেমদের মতামত থেকে প্রমাণ তুলে ধরা হবে।
1.সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা
সাহাবি আবু সাঈদ রাফি ইবনে আল-মু'আল্লা (রহঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘আমি কি তোমাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিক্ষা দেবো, মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগেই?’ তারপর রাসুল ﷺ আমার হাত ধরে বের হতে থাকলেন। বের হওয়ার সময় আমি তাঁকে তাঁর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিলাম তখন তিনি বললেন: ‘সেটি হলো আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন (অর্থাৎ সূরা আল-ফাতিহা), যা হচ্ছে আস-সাবআল-মাসানি (সাত বার পাঠিত আয়াতসমূহ) এবং মহান কুরআন যা আমাকে প্রদান করা হয়েছে।
বিশিষ্ট হাদিস বিশেষজ্ঞ ইবনে হাজার আল আসকালানি (রহঃ) বলেন, “এটি ‘মাসানি’ নামে পরিচিত হওয়ার বিষয়ে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, কারণ এটি প্রতি রাকাতে পুনরাবৃত্তি করা হয়; কেউ বলেন, কারণ এতে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়; আবার কেউ বলেন, এটি শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য প্রদান করা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী কোনো সম্প্রদায়কে দেওয়া হয়নি।”
সূরা আল-ফাতিহাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা বলা হওয়ার কারণ বোঝার জন্য এর ফজিলত, তাফসির এবং চিন্তা-ভাবনা (তাদাব্বুর) নিয়ে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। এর মর্যাদা বোঝার অন্যতম উপায় হলো এর প্রারম্ভিক আয়াতসমূহের মর্ম উপলব্ধি করা এবং মুমিনের হৃদয় ও জীবনে সেগুলোর প্রভাব অনুধাবন করা।
সূরার সূচনাতে রয়েছে চূড়ান্ত প্রশংসার ঘোষণা: আলহামদুলিল্লাহ। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য কামনা করে এবং সঠিক পথের সন্ধান চায়, তার হৃদয়ে ও মুখে কৃতজ্ঞতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ-ই ছিল আদম (আঃ)-এর প্রথম উচ্চারণ; এবং নূহ (আঃ) যখন নাজাত পেলেন তখন আল্লাহ তাকে বলেছিলেন: “আলহামদুলিল্লাহ বলো, যিনি আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” এটি এক পবিত্র উচ্চারণ, যা যুগের পর যুগ, নবী ও রাসূলগণের মুখে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, সময় ও পরিস্থিতির বিবর্তনকে ছাপিয়ে আল্লাহর মহত্বের চিরন্তন সত্যকে ঘোষণা করে এসেছে। এমনকি জান্নাতের দরজা যখন মুমিনদের জন্য খুলে যাবে, তখনও তারা উচ্চারণ করবে: আলহামদুলিল্লাহ — যিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং তাদের চিরস্থায়ী শান্তির স্থানে প্রবেশ করিয়েছেন।
সূরা আল-ফাতিহার সূচনা এমন এক গভীর সত্য উন্মোচন করে, যা এর বিশাল ফজিলতের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড — ফেরেশতাদের মহিমান্বিত জগত, জিনদের জগৎ এবং অসংখ্য সৃষ্টির নানা রূপ — সকলই আল্লাহর প্রশংসায় নিজেকে একাকার করেছে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগতের ঊর্ধ্বে এ সত্য চিরন্তন: সৃষ্টির প্রতিটি কোণ আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধার ঋণ স্বীকার করে। তবে যাদেরকে মুক্ত ইচ্ছাশক্তি দান করা হয়েছে — মানুষ ও জিন — তারাই এই সত্যকে সচেতনভাবে গ্রহণ করার জন্য আহ্বানপ্রাপ্ত হয়েছে, যাতে তারা পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতার সাথে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করে। এই ইচ্ছাকৃত আত্মসমর্পণ শুধুমাত্র সত্যের স্বীকৃতি নয়; বরং এটি সৃষ্টি কর্তার সন্তুষ্টির পথে এক দীর্ঘ যাত্রা। এ প্রসঙ্গে জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “সর্বোত্তম দোয়া হলো: ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।”
অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বাক্য হলো: সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি (আল্লাহ পবিত্র এবং তাঁরই সমস্ত প্রশংসা)।” এভাবেই আলহামদুলিল্লাহ দৈনন্দিন জীবনের বহু দোয়া ও আমলের অংশ — ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সময় থেকে শুরু করে রাত্রি শয়ন পর্যন্ত নানা সময়ে এটি উচ্চারিত হয়।
2.সুরা ফাতিহা এক অসাধারণ ওহি
উবাই ইবনে কা'ব (রা) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “আল্লাহ ﷻ তাওরাতে বা ইনজিলে এমন কিছু অবতীর্ণ করেননি যা কুরআনের মূলসার (অর্থাৎ সূরা আল-ফাতিহা)-এর সমতুল্য; যা সাতটি বার বার পাঠিত আয়াত নিয়ে গঠিত, এবং (আল্লাহ বলেন) এটি আমার ও আমার বান্দার মাঝে বিভক্ত, আর বান্দা তার প্রার্থিত বস্তু লাভ করবে।”
এই হাদিস সূরা আল-ফাতিহার মহত্বকে পূর্ববর্তী কোনো আসমানি গ্রন্থের কোনো অংশের তুলনায় অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। এই বর্ণনা স্পষ্ট করে দেয় যে, যিনি পূর্ববর্তী বহু মানব জাতিকে ওহি প্রদান করেছিলেন, সেই মহান আল্লাহ ﷻ তাঁর শেষ রাসূল ﷺ এবং শেষ উম্মাতকে এমন এক বিশেষ ওহি দ্বারা সম্মানিত করেছেন যা পূর্ববর্তী কোনো জাতিকে প্রদান করা হয়নি।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এই বক্তব্য সূরা আল-ফাতিহাকে একটি ঐশী চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যা কুরআনের শুরুতেই অবস্থান করে এবং প্রতিটি সালাতের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এটি সালাতের কবুলিয়াতের দ্বার খুলে দেয়—“এবং বান্দা যা চাইবে, সে তা পাবে”।
প্রবন্ধের শুরুতে বর্ণিত ঘটনাটির প্রসঙ্গে ফিরে গেলে, ফেরেশতার উক্ত "দুটি আলো" (নূরান) কথাটি বোঝার জন্য কুরআনের আলো (নূর) বিষয়ক উপমার দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, “সে কি তার তুল্য, যে মৃত ছিল, অতঃপর আমি তাকে জীবন দান করেছি এবং তার জন্য এক আলো বানিয়েছি যার মাধ্যমে সে মানুষের মাঝে চলাফেরা করে; আর অন্যজন থেকে যায় গভীর অন্ধকারে, যা থেকে সে কখনও বের হতে পারে না?” (সূরা আল-আন‘আম: ১২২)
এখানে "আলো" বলতে বোঝানো হয়েছে সেই ঐশী হেদায়েত, যা একটি আত্মাকে অন্ধকার থেকে ঈমানের আলোয় আলোকিত করে তোলে। সূরা আল-ফাতিহা, কুরআনের ভূমিকা হিসেবে, এই রূপান্তরকেই ধারণ করে। এটি প্রভুর প্রশংসা দিয়ে শুরু হয়, তাঁর গুণাবলি প্রতিষ্ঠা করে, এবং পরিশেষে সোজা পথে পরিচালনার জন্য একান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে শেষ হয়। এর মাধ্যমেই মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় এবং তার নৈতিক ও আত্মিক দিকনির্দেশনার শিকড় আল্লাহর কর্তৃত্বের সাথে সুদৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হয়।
সাধারণভাবে পুরো কুরআনকেই এক উজ্জ্বল আলো হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনে। এটি সেই মহান আল্লাহর বাণী (কালাম), যিনি নিজেই নূর (আলো)। তিনি বলেনঃ “আল্লাহ হলেন আসমান ও জমিনের আলো।” (সূরা নূর: ৩৫)
এই আলো বিষয়ক ধারণা আমাদের দোয়ার মধ্যেও উচ্চারিত হয়, বিশেষ করে তাহাজ্জুদের দোয়ায়: “হে আল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা আপনারই, আপনি আসমান ও জমিনের আলো।”
সূরা আল-ফাতিহা হল সেই প্রার্থনার শিখর, যার উত্তরস্বরূপ মুমিনরা একত্রে বলে “আমীন”। এটি একটানা সোজা পথে পরিচালনার জন্য ক্রমাগত দিকনির্দেশনার প্রার্থনা। এ দোয়া আল্লাহর প্রতি মুমিনের পূর্ণ নির্ভরতা ও তাঁর সাহায্য ও সন্তুষ্টির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে, যা ঈমান ও আমলের জটিল পথচলায় অগ্রসর হতে সহায়তা করে। একইভাবে, সূরা আল-বাক্বারার শেষ আয়াতসমূহও একটি পূর্ণাঙ্গ দোয়া, যাতে ক্ষমা, দুর্বলতা থেকে নিরাপত্তা এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল নির্ভরতার আকুতি প্রকাশিত হয়।
হাদিসের শেষে উল্লেখিত হয়েছে দোয়াগুলোর “গ্রহণযোগ্যতা”। অধিকাংশ আলেমের মতে, এখানে বিশেষত ওই দোয়াগুলোর কবুলিয়াত বোঝানো হয়েছে, যেগুলো এই কুরআনিক অংশে রয়েছে—যেমন, হেদায়েত, নিরাপত্তা ও ক্ষমার প্রার্থনা। তবে এটি এই জীবনের ও আখিরাতের অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার পূরণকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এই দোয়াগুলোর কবুল হওয়ার প্রতিশ্রুতি কুরআনের বাণীর শক্তিকেই নির্দেশ করে। সৃষ্টিকর্তার উচ্চারিত বাক্যগুলি তাঁর রহমত, বরকত, হেদায়েত এবং কবুলিয়াতের মাধ্যম হয়ে ওঠে।
কুরআনের সূচনা অধ্যায় হিসেবে সাতটি বার বার পাঠিত আয়াতসমূহ নিয়ে গঠিত সূরা আল-ফাতিহা পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনার এক নিখুঁত প্রতিফলন এবং শরিয়তের সামগ্রিক কাঠামোর ক্ষুদ্র সংস্করণ। এটি ঈমান, ইবাদত, নৈতিক বিধান, অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস এবং একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরতার মূল উপাদানগুলো ধারণ করে। এ কারণেই একে উম্মুল কুরআন বলা হয়; কারণ এই কয়েকটি আয়াতেই কুরআনের বিস্তৃত বিষয়বস্তুর মূল ভাব ও দিকনির্দেশনা সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এই সূরার আয়াতসমূহ মুমিনকে আল্লাহর দয়া ও দিকনির্দেশনার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতার দিকে পরিচালিত করে, যা ইসলামের অন্যান্য সমস্ত আদেশ ও শিক্ষার ভিত্তি।
3.সূরা আল-ফাতিহা ছাড়া কোনো সালাত (নামাজ) সঠিক নয়
এর বিশেষ মর্যাদার কারণেই কোনো সালাত (নামাজ) সূরা আল-ফাতিহা পাঠ ছাড়া সঠিক হয় না। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “যে ব্যক্তি ফাতিহাতুল কিতাব (সূরা আল-ফাতিহা) পাঠ করে না, তার নামাজ শুদ্ধ নয়।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ইবাদত হচ্ছে সালাত, যা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে, যা এ ইবাদতের গুরুত্বকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। সালাত হচ্ছে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে এক মহান সম্পর্কের বন্ধন। আর এই নামাজে সূরা আল-ফাতিহার আবশ্যকতা প্রমাণ করে যে, এই সূরাটি মুমিনের আত্মিক উন্নয়ন, ঈমানের দৃঢ়তা এবং সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য কতটা অপরিহার্য।
সূরা আল-ফাতিহা শুধু মুখে পাঠ করার বিষয় নয়; এটি সেই প্রথম অংশ, যা প্রত্যেক নতুন মুসলিম ইসলামে প্রবেশের পর শিখে নেয়। ইসলাম গ্রহণের পর সঠিকভাবে ইসলাম পালনের জন্য সূরা আল-ফাতিহা শেখা আবশ্যক। আল-ফাতিহাকে গ্রহণ করা মানেই ইসলামকে গ্রহণ করা। এটি আল্লাহর সামনে একাগ্রচিত্তে দণ্ডায়মান হওয়া, হৃদয়ে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও বিনয় বহন করা, মস্তিষ্কে তাঁর প্রজ্ঞা উপলব্ধি করা, আর অন্তরে তাঁর নৈকট্যের জন্য আকুল থাকা। এটি প্রত্যেক নামাজের প্রতিধ্বনি এবং সঠিক পথে অটল থাকার প্রত্যেক প্রার্থনার ভিত্তি।
সূরা আল-ফাতিহার নামাজে বিশেষ মর্যাদা আরো স্পষ্ট হয় রাসুলুল্লাহ ﷺ এর বর্ণিত এক হাদীস কুদসির মাধ্যমে, যা আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। সেখানে মহান আল্লাহ প্রত্যেক আয়াত পাঠের সময় বান্দার সাথে সরাসরি উত্তর দেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
আল্লাহ তাআলা বলেন: “আমি নামাজকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত করেছি এবং আমার বান্দা যা চাইবে তাই পাবে।
যখন বান্দা বলে: ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি সমস্ত জগতের পালনকর্তা,’
তখন আল্লাহ বলেন: ‘আমার বান্দা আমাকে প্রশংসা করলো।’
যখন বান্দা বলে: ‘পরম করুণাময়, অতি দয়ালু,’
তখন আল্লাহ বলেন: ‘আমার বান্দা আমাকে গুণগান করলো।’
যখন বান্দা বলে: ‘বিচার দিনের মালিক,’
তখন আল্লাহ বলেন: ‘আমার বান্দা আমার মহিমা ঘোষণা করলো।’
কখনও বলেন: ‘আমার বান্দা নিজেকে আমার উপর অর্পণ করলো।’
যখন বান্দা বলে: ‘আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য চাই,’
তখন আল্লাহ বলেন: ‘এটি আমার এবং আমার বান্দার মাঝে বিভক্ত, আর আমার বান্দা পাবে যা সে চায়।’
অতঃপর যখন বান্দা বলে: ‘আমাদের সোজা পথে চালাও; তাদের পথ যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছো, যারা পথভ্রষ্ট হয়নি এবং যাদের উপর তোমার গজব নেই,’
তখন আল্লাহ বলেন: ‘এটি আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা পাবে যা সে চায়।’ (সহিহ মুসলিম)
কুরআন নিজেই সূরা আল-ফাতিহার মাধ্যমে দোআ (প্রার্থনা) দিয়ে শুরু হয়। এটি আমাদেরকে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার, তাঁর উপর নির্ভরশীলতা প্রকাশ করার, তাঁকে সর্বান্তকরণে ইবাদত করার শিক্ষা দেয়। যদিও কুরআন মূলত পাঠের গ্রন্থ, তথাপি এর সূচনা ও সমাপ্তি উভয়টিই দোআ দিয়ে পরিবেষ্টিত (যেমন, শেষ দুই সূরা, সূরা ফালাক ও সূরা নাস)। যেন মুমিনদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, ইবাদতের মূল ভিত্তি হলো আল্লাহর নিকট দোআ করা। আবার সূরা আল-ফাতিহা হচ্ছে একমাত্র সূরা যা প্রতিটি সালাতের প্রতিটি রাকাতে আবশ্যকভাবে পাঠ করতে হয়। এর ফলে প্রত্যেক নামাজ আল্লাহর সাথে সরাসরি এক প্রার্থনামূলক সংলাপে পরিণত হয়। সূরা পাঠ শেষে সম্মিলিতভাবে উচ্চারণ করা হয় "আমীন", যা মুমিনদের কণ্ঠকে ফেরেশতাদের কণ্ঠের সাথে মেলাতে সহায়তা করে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: "যখন ইমাম আমীন বলবে, তখন তোমরাও আমীন বলো; যে ব্যক্তির আমীন ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।" (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
এই অনন্য মর্যাদা — আবশ্যিক পাঠ এবং ‘আমীন’-এর সমাপ্তি — সূরা আল-ফাতিহাকে অন্যান্য সব সূরা থেকে বিশেষ করে দেয়। এটি মুসলমানদের উপাসনার জীবনের ছন্দিত হৃদস্পন্দনে পরিণত হয়, যাতে কোনো মুমিন কখনও আল্লাহর দয়া, পথনির্দেশনা ও ক্ষমার উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে।
- রোগ-ব্যাধির জন্য শিফা (আরোগ্য)
সহাবি আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) বর্ণনা করেছেন:
“একবার আমরা সফরে ছিলাম এবং এক স্থানে বিশ্রাম নিই। তখন এক দাসী এসে বলল, ‘আমাদের গোত্রের নেতা বিষাক্ত কীটের দংশনে আক্রান্ত হয়েছেন এবং আমাদের পুরুষরা কেউ নেই। তোমাদের মাঝে কেউ কি আছে যিনি রুকিয়া (চিকিৎসামূলক কুরআন পাঠ) করতে পারেন?’
এক ব্যক্তি দাঁড়ালেন এবং তাঁর সঙ্গে গেলেন। আমরা তাকে আগে কখনও রুকিয়ার বিষয়ে পারদর্শী বলে জানতাম না। তিনি সেই ব্যক্তির উপর সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন, ফলে সেই নেতা সুস্থ হয়ে উঠলেন। এরপর সেই নেতা তাকে ত্রিশটি ভেড়া উপহার দিলেন এবং আমাদের দুধ পান করালেন।
যখন সেই ব্যক্তি ফিরে এলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি আসলেই রুকিয়া জানো, নাকি হঠাৎ করেই করেছ?’ তিনি বললেন, ‘না, আমি কেবলমাত্র উম্মুল কিতাব (সূরা ফাতিহা) পাঠ করেছি।’ আমরা বললাম, ‘এই উপহারের বিষয়ে কিছু করো না যতক্ষণ না আমরা নবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছি।’ যখন আমরা মদিনায় পৌঁছলাম, আমরা নবী (সা.)-কে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন, ‘কীভাবে সে জানল যে এটি শিফা? তা ভাগ করে নাও এবং আমার জন্যও একটি অংশ রাখো।” (বুখারি, মুসলিম)
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, যদিও সহাবিরা এটিকে শারীরিক রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করেছিলেন, সূরা আল-ফাতিহা নিঃসন্দেহে এক অপূর্ব আত্মিক শিফা ও মানসিক শান্তির উৎস।
ইবন আল-কাইয়্যিম (রহ.) বলেন: "হৃদয়ের সুস্থতার দিক থেকে এটি অত্যন্ত কার্যকর। হৃদয়ের রোগের প্রধান দুই কারণ হলো: জ্ঞানের বিকৃতি এবং অভিপ্রায়ের বিকৃতি। এ দুই থেকে দুটি মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হয়—ভ্রান্তি এবং ক্রোধ। ভুল জ্ঞান থেকে পথভ্রষ্টতা জন্ম নেয় এবং বিকৃত উদ্দেশ্য থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। এই দুই রোগই মানুষের আধ্যাত্মিক কল্যাণ নষ্ট করে দেয়। সোজা পথে হেদায়াত প্রার্থনা করার মাধ্যমে এ রোগগুলোর চিকিৎসা হয়। এ কারণে প্রতিদিন ও রাতে, প্রত্যেক সালাতে এই দোআ করা ফরজ ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই হেদায়াত ছাড়া মানুষের প্রকৃত কল্যাণ সম্ভব নয়।”
উপসংহার
অবশেষে বলা যায়, সূরা আল-ফাতিহা মানবজীবনের মৌলিক কিছু প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে: আমাদের সৃষ্টিকর্তা কে? আমরা কীভাবে তাঁর ইবাদত করবো? আমরা কীভাবে তাঁর কাছে দোয়া করবো? ইবনুল কাইয়্যিম সূরা আল-ফাতিহাকে এইভাবে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন: এটি কুরআনের উম্মুল কিতাব, সম্পূর্ণ আরোগ্য, উপকারী চিকিৎসা, দুঃখ-কষ্ট, দুশ্চিন্তা ও ভয়-ভীতির প্রতিষেধক; যে ব্যক্তি এর গুরুত্ব বুঝে যথাযথভাবে আমল করে, সে এর মাধ্যমে শারীরিক ও আত্মিক রোগ নিরাময় পায়। যেমন রমযান, মহররম, লাইলাতুল কদর, আরাফা দিবসের মতো সময়গুলো বিশেষ ফজিলতের অধিকারী, তেমনি কুরআনের সূরাগুলোর মধ্যে আল-ফাতিহা সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। যারা এর অর্থ অনুধাবন করে, হৃদয়ের উপস্থিতি নিয়ে পাঠ করে, তারা ঈমানের এক অনুপম মিষ্টতা লাভ করে। এ আলোচনা সম্পূর্ণ না হলেও, যারা কুরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়তে চান তাদের জন্য এটি এক প্রারম্ভিক দিকনির্দেশনা হতে পারে। কুরআনের সঙ্গে এই বন্ধন চিরকালীন হেদায়েতের উৎস হিসেবে কাজ করবে।