এই রমজানের কিছু বিশেষ শিক্ষা: পর্ব ২
সাওম পালন, কিয়াম সাধন এবং তিলাওয়াত আল-কুরআন - রমজান এই তিনটি মূল ক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষত থাকলেও, উক্ত মাসের বিশেষণ কিছু বিষয় উল্লেখ্য না করে সমাপ্ত হয়না। এই সমগ্র সাধনার মধ্যে অন্তর্নিহিত শিখাগুলির ওপর অবশ্যই একটু দৃষ্টিগোচর প্রয়োজন - অনুধাবন এবং অনুশীলন দুই অনুসরণ করে।
সংগ্রাম - একটা করার
সুরাহ আল-বাক্বারাহর ১৮৩ আয়াত অনুসারে রোযার প্রধান উদ্দেশ্য হল তাক্বওয়া বা পরহেযগারী অর্জন করা। আভিধানিক অর্থে তাক্বওয়া হচ্ছে সুরক্ষা যেহুতু শব্দটি উইকায়া মূলপদ থেকে এসেছে। কিছুজন্য সম্পর্ক থাকলেও পরিভাষায় তাক্বওয়া অর্থ আরও বিস্তর এবং গভীর তাৎপর্যপর্ণ। বিভিন্ন ব্যাখ্যার সারাংশ হল -
তাক্বওয়া হচ্ছে এমন এক সরঞ্জাম যা বান্দা এবং আল্লাহর মধ্যবর্তী সমস্ত প্রকারের প্রতিকূলতাকে দূর করে বান্দাকে স্রষ্টার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে রক্ষা করে এবং স্রষ্টার সান্নিধ্য আরও দৃঢ় করে তুলে। সে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর আনুগত্যের কাজ করে এবং অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকে। বাংলা ভাষায় অসম্পূর্ণতার সঙ্গে অনুবাদ করা খোদাভীরুতা বলে।
অবশ্যই তাক্বওয়া হচ্ছে এক বিরাট সংগ্রাম যার মধ্যে যুদ্ধ ঘটে সরাসরি বৃহত্যম শত্রু হৃদয়ের সঙ্গে। সকল নেতিবাচক উদ্দীপনা হারিয়ে স্রষ্টার আদেশ পালন করা এবং তাঁর আনুগত্যে সমর্পিত হওয়া হচ্ছে তাক্বওয়ার একটি বড়ো অনুশীলন। সকল সৎকাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখা অবশ্যই তাক্বওয়ার একটি বড়ো পর্যায় - যেমন নামায আদায় করা, কোরআন তিলাওয়াত করা, রোযা রাখা অনুরূপ পাড়া প্রতিবেশীর খেয়াল রাখা, আত্মীয়তা বজায় রাখা, অন্যের হক্ক বা অধিকার আদায় করা, যাকাত সদকা প্রদান করা, সবার সম্পর্কে সৎ ধারণা রাখা, শুকুর ও সবর করা ইত্যাদি। রমযানের উপলক্ষে তাক্বওয়া সমৃদ্ধির একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ্য করা যেতে পারে -
সালমান আল-ফার্সী (র:) থেকে একটি মশহুর হাদীস বর্ণিত আছে: যে ব্যক্তি এর মধ্যে (রমযানে) একটি ভালো গুণ স্বেচ্ছায় (যথা নফল) পূর্ণ করবে, সে অন্যত্র ফরয আদায়কারীর ন্যায় হবে এবং যে ব্যক্তি এতে একটি ফরয (সালাত) আদায় করেছে, সে অন্যত্র সত্তরটি ফরয আদায়কারীর ন্যায় হবে।
তাহলে রমযানে ভালো কাজ করার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, বরং উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর অপকারিতা তাক্বওয়া অর্থাৎ আল্লাহভীতিই প্রদান করতে পারে।
অন্যটা না করার
অনুরূপ রমযান মাসে অনেক কিছু না করারও বিষয় আছে, যেহেতু আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকাও তাক্বওয়ার অংশ। হৃদয় আক্রান্ত ব্যধিসমূহ থেকে সর্বপ্রথম দূরে থাকতে হবে - সৎ কাজে অলসতা, হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, রদুশ্চিন্তা ইত্যাদি। রমযান উপলক্ষে এই সম্পর্কে একটি হাদিস: আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়। সিয়াম তো অসার, বাজে ও অশ্লীল কথা থেকে বিরত থাকার নাম। যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় অথবা তোমার সাথে কেউ মূর্খামি করে তবে তাকে বল, আমি সিয়াম রেখেছি। আমি সিয়াম রেখেছি। (বাইহাক্বী)
স্বরণ এবং অনুসরণ
আর একটি বিশেষ শিক্ষা হল ইতিহাস স্বরণ করে তা অনুসরণ করা। আল্লাহ তায়ালা কুরআন পাকে অতীত সম্প্রদায়ের বারবার বর্ণনা করেছেন যাতে তা মানব কুলের জন্য সত্যের নির্দেশিকা হয়। এ রমজানের পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করার অনেক বিষয় রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৭ রমজানে সংঘটিত বদরের যুদ্ধ। এবার বদর ঘটনা যে শিক্ষা দেয় তা অন্য এক প্রবন্ধের বিষয়। মূল কথায় ঈমানের দৃঢ়তা এবং সহ্যের সফলতা প্রকাশ্যভাবে দৃশ্যমান।
ফিলিস্তিন এবং বর্তমান
পৃথিবীর বর্তমান মানচিত্রের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বর্তমান ফিলিস্তিনের ঝরে যাওয়া রক্ত ইতিহাসের পাতায় অশোধিত লাল-কালো দাগ। ফিলিস্তিনের গাজা ছাড়াও, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও বহু মুসলমান দলীয়, অপমানিত এবং অত্যাচারিত। এই লাঞ্ছনার মূল কারণ আমাদের আবার ইতিহাস স্মরণ করার আহ্বান দেয়। কেন আমাদের নেই ঈমানের সেই দৃঢ়তা? কে আমাদের আঞ্চলিক, বৈশ্বিক নেতা? কোথায় গেল মুসলিম উম্মার সেই সীমাহীন, বর্ণহীন এবং ভাষাহীন ঐক্যতা - ঈমানী ভাতৃতা?
আর একটা বড় শিক্ষা হওয়া উচিত, বিশ্বব্যপী মুসলমান রমজান মাসে যে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ধার্মিক হয়ে চলে তা যেন এই মাসেই সীমিত না হয়ে বছরব্যাপী অব্যাহত থাকে।